একজন ‘মানবিক’ পুলিশের গল্প শুনুন
২১ ফেব্রুয়ারি ২০২০কতটা মনোবল, ধৈর্য্য, সদিচ্ছা আর সেবার মন থাকলে দুই যুগ ধরে এমনটা করতে পারছেন ডয়চে ভেলেকে সেই গুল্প শুনিয়েছেন পুলিশ কনস্টেবল মুহাম্মদ শওকত হোসেন৷
ডয়চে ভেলে: অসহায় ও বেওয়ারিশদের সেবা করার চিন্তাটা কীভাবে মাথায় এলো?
মুহাম্মদ শওকত হোসেন: ২০০৫ সালে পুলিশে যোগ দিয়েই চোখে পড়ে অসহায়, দুঃস্থ ও বেওয়ারিশ মানুষরা নিভৃতে কাঁদে৷ ভেবেছিলাম পুলিশে চাকরি করব না, কারণ, কষ্ট হয়। পরে পরিবারের লোকজনের কথায় সিদ্ধান্ত নিলাম কিছুদিন চাকরি করব। তখন দেখলাম, পুলিশে চাকরি করে আমি অনেক মানুষের উপকার করতে পারি। কাউকে অন্যায়ভাবে নির্যাতন করছে, আমি তার সাপোর্ট হিসেবে দাঁড়াতে পারি, কাউকে জোরপূর্বক কিছু চাপিয়ে দিলে বা বল প্রয়োগ করলে তাকেও সাপোর্ট দিতে পারি। দেখলাম, পুলিশে চাকরি করে অনেক সেবামূলক কাজ করা যায়। তখন থেকে মানুষের জন্য কাজ করার ইচ্ছা বাড়তে থাকে।
২০০৫-২০০৯ পর্যন্ত ঢাকায় চাকরি করি৷ পরে রাঙ্গামাটিতে পোস্টিং হয়৷ তিন বছরের ডিপ্লোমা এবং দুই বছরের প্যারামেডিকেল কোর্স থাকায় চট্টগ্রাম বিভাগীয় পুলিশ হাসপাতালে পোস্টিং হয়। মাঝেমধ্যে ডাস্টবিনে, ড্রেন ও বহুতল ভবনের পাশে, ময়লা-আবর্জনা ফেলে এমন জায়গায় অসহায় মানুষদের শরীরে ক্ষত নিয়ে পড়ে থাকতে দেখি। তাদের অনেকের গায়েই পোকা পড়ে গেছে, তাদের মধ্যে মানসিক প্রতিবন্ধীও আছে। ওইসব মানুষকে দেখে খুব খারাপ লাগে। গায়ে দূর্গন্ধ থাকায় কোনো মানুষ তার পাশ দিয়ে চলাচলও করে না। পোকাগুলো তাদের শরীরটাকে খেয়ে ফেলছে। চিন্তা করলাম সৃষ্টির সেরা জীব এভাবে শেষ হবে, কিছু করা উচিত। মন কাঁদত, কিন্তু প্রথমে আমিও এদের ধরতাম না। ২০১০ সালের মাঝামাঝি সময়, এক পুলিশ সদস্যকে হাসপাতালে পৌঁছে দিয়ে ফেরার পথে রাস্তার পাশে এক মানসিক ও বাকপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিকে দেখি, তার শরীরের একাংশে পোকা ধরে গেছে। তাকে দেখে রাতে ঘুম এলো না। চিন্তা করতাম- ওই লোক যদি আমার ভাই, বাবা বা মা হতো, আমি কী করতাম? আমি কি এভাবে চলে আসতে পারতাম? আমি আমার বিবেকের কাছে পরাজিত হই। পরের দিন সকালে সিদ্ধান্ত নেই, আমি তাকে মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা করাবো।
গ্লাভস, মাস্ক পরে তাকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাই৷ আমার গায়ে পুলিশের পোশাক থাকায় তারা ভর্তি নেয়। বলে যে, আপনি তো ভর্তি করিয়ে চলে যাবেন, এরপর তার পরিচর্যার দায়িত্বে কে থাকবেন? কোনো মানুষের কেউ না থাকলে কি পচে মরে যাবে? আমি এই যুক্তি দেখাই। কিন্তু উনাদের বাস্তব যুক্তির কাছে আমি হেরে যাই। দুদিন পর আমি ওই ওয়ার্ডে গিয়ে দেখি ওই রোগী নেই। খোঁজ নিলে তারা জানায়, দূর্গন্ধে অন্য রোগীদের সমস্যা হওয়ায় ওই রোগীকে তারা সেই ডাস্টবিনের পাশে রেখে এসেছেন। আমি চিন্তা করলাম শরীরে পোকা ধরার পর যে মানুষটি যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছে, সে আমাদের পুরো সমাজ ও জাতিকে অভিশাপ দিয়ে যাচ্ছে। হয়ত সে ভাবছে, পৃথিবীতে এমন মানুষ কি কেউ নেই যে তাকে সহযোগিতা করবে। এভাবে একজন মানুষ নিঃশেষ হয়ে যাবে? কেউ রেসপন্স করবে না? আমি মেনে নিতে পারি না৷ সিদ্ধান্ত নিলাম, কেউ ইনভল্ব না হলেও আমি ইনভল্ব হবো। আমার প্যারামেডিকেল কোর্স করা থাকায় এবং হাসপাতালের কাজে অভিজ্ঞতা থাকায় আমি এদের নিয়ে একাই ২০১২ সাল পর্যন্ত কাজ করি।
সঙ্গে অন্যদের যুক্ত করলেন কীভাবে?
রোগীর সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় সমমনা কিছু পুলিশ বন্ধুকে আমার কাজ দেখানো শুরু করি। তারাও মেডিকেলেই চাকরি করে। তারা দেখতো, আমি নিজের টাকায় এসব করছি। পরে তারাও সহায়তা শুরু করলো। এখন ১০ জন আছে আমার সঙ্গে। যখন যার ডিউটি থাকে না, তখন আমার সঙ্গে কাজ করছে। মূল ডিউটি শেষ করে আমরা বের হই।
বেতনের কত টাকা দুঃস্থদের জন্য খরচ করেন?
ড্রেসিং ছাড়াও ওষুধ, পোশাক ও খাবার কিনতে খরচ হয়৷ বেতনের টাকা থেকেই এসব কিনি। বেতনের বেশিরভাগই যাতে এদের জন্য খরচ করতে পারি, সেজন্য পরিবারের অন্যদের গ্রামে রেখেছি। বড় ভাই পরিবারের খরচ জোগান। বেতনের টাকা মানবিক কাজে খরচ করার একটা নেশা হয়ে গেছে। প্রথম প্রথম একটু খারাপ লাগতো। ভাবতাম, আমি তো টাকা খরচ করে ফেলছি, আমার বন্ধুরা তো অনেক টাকা জমাচ্ছে, জমি বা গাড়ি কিনবে, আমি জমাচ্ছি না৷ আমার ভবিষ্যৎ কি? এই চিন্তাটা মাথায় আসতো। কিন্তু যখন মানুষগুলো আমার টাকায় কেনা খাবার খেয়ে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে নিষ্পাপ হাসি দেয়, সেই হাসি টাকা দিয়ে কেনা যায় না। সমাজের কিছু মানুষকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়ার জন্য এটা করছি। প্লিজ আপনারাও এই মানুষগুলোর পাশে দাঁড়ান।
কেমন করে হলো মানবিক টিম?
বেওয়ারিশ মানুষের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় কাজ করতে সমস্যা হচ্ছিলো। কারণ, আমার একার পক্ষে সব বেওয়ারিশের দেখাশোনা করা সম্ভব নয়। চট্টগ্রামের বর্তমান পুলিশ কমিশনারকে বিষয়টি বলার পর উনি একটি মনবিক টিম গঠন করে দেন, যারা পচে যাচ্ছে, পুলিশ অনেক সময় তাদের নিয়ে কাজ করে না। এখন এসব মানুষও পুলিশের সেবার মধ্যে চলে এসেছে। সব বিভাগে মানবিক ইউনিট চালু হলে কোনো মানুষ ক্ষুধার্ত অবস্থায় মারা যাবে না। সন্ধ্যার পর যাদের ডিউটি থাকে না, তাদের নিয়েই এই টিমে কাজ করি।
বদলি হলে অন্যত্রও এই সেবা অব্যাহত রাখবেন?
মানবিক ইউনিটকে মানবিক বিবেচনা করে স্বতন্ত্র ইউনিট হিসেবে চালু করলে ভালো হবে। সবাই আমার কাজে সন্তুষ্ট থাকলে আমি এই কাজ করে যেতে চাই। যেখানেই পোস্টিং হোক, যদি এই কাজগুলো না করতে পারি, আমি চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছি। পুলিশে ভালো-খারাপ সব ধরনেরই মানুষই আছে। কোনো কারণে আমাকে এখান থেকে সরিয়ে দেওয়া হলে নতুন জায়গায় গিয়েও এই কাজ করে যাবো।
চাকরি ছাড়লে টাকা পাবেন কোথায়?
অনেকে যোগাযোগ করেছেন, তারা সহযোগিতা করতে চান। আমি মনে করি, যদি পুলিশের চাকরি না-ও করি, তবে কেউ না কেউ আমাকে চাকরি দেবে। আমি পুলিশ ডিপার্টমেন্টকে ভালোবাসি, এই চাকরির মাধ্যমে মানুষের সেবা করে যেতে চাই। আমি কখনো এই চাকরি ছাড়তে চাইবো না। তবে কখনো অসৎ মানুষের ছায়ায় পড়ে গেলে চাকরি ছেড়ে দেবো।
কত মানুষের সেবা করেছেন?
সব মিলিয়ে পাঁচ শতাধিক মানুষকে সেবা দিয়েছি। এখন প্রতিদিন ১০ জন বেওয়ারিশ মানুষের খাওয়ার ব্যবস্থা করছি। একটি শেড হলে সেখানে ৫০ থেকে ১০০ জনের খাবার রান্না হবে। বেওয়ারিশ মানুষ ওখানে এলে খাবার ও বস্ত্র পাবে। সরকারিভাবে না হলেও সুশীল সমাজের মানুষদের অনুদানে এটা করতে চাই। বড় ভাইকে কেউ গিফট করলে সেখান থেকে আমাকে জামাকাপড় দেয়, আমি সেগুলোই ব্যবহার করি। এক হাজার টাকা দিয়ে একটা জামা না কিনে বেওয়ারিশদের জন্য ১০টি টিশার্ট কিনতে পারি৷ এটা সব সময়ই আমার মাথায় থাকে৷ গত ১০ বছরে কোনো নতুন কাপড় কিনিনি।
আপনার পরিবারের সদস্যরা বিষয়টি কীভাবে দেখছেন?
আমার বোনের বিয়ের বেনারশি শাড়ি ধার নিয়ে বিয়ে করি। এরপর ওই শাড়িটি ধূয়ে বোনকে ফিরিয়ে দেই। স্ত্রী দুই মাস পর লন্ড্রি থেকে শাড়ি আনার কথা বললে আমি তাকে বলি, লন্ড্রি শাড়িটি ইস্ত্রি করার সময় পুড়িয়ে ফেলেছে৷ সে এটা বিশ্বাস করেছে। স্ত্রীসহ পরিবারের সব সদস্যই এই কাজে সমর্থন দিয়ে আসছে।
একসাথে যারা চাকরিতে জয়েন করেছি, তাদের অনেকেই ভালো ফ্ল্যাটে থাকেন। তাদের ভালো সোফা, খাট, আসবাবপত্র, টিভি আছে। ওসব দেখে আমার স্ত্রী প্রশ্ন করতো। তবে আমার কর্মকাণ্ড দেখে সে এখন কিছু বলে না। আমার এসব কাজে সে সাপোর্ট দিয়ে আসছে।
আপনার কাছে মানবিকতার অর্থ কী?
প্রতি বছর আপনি এক ব্যাগ রক্ত দিলেন, কাউকে ১০০ টাকা দান করলেন, অথবা একটা পুরানো শার্ট দিয়ে দিলেন- আমার চোখে এটা মানবিকতা নয়। আমার কাছে মানবিকতার হলো, আপনি আপনার জীবনের কষ্টাজির্ত যে কোনো অধ্যায় যদি তাদের পেছনে ব্যয় করেন। যে চিকিৎসক হাজার টাকা ভিজিট নেন, তিনি যদি একদিন ভিজিট না নিয়ে ওইদিন যে পরিমাণ ভিজিট পেতেন তার সমপরিমাণ টাকা নিঃস্ব মানুষের পেছনে ব্যয় করেন, সেটাই মানবিকতা।
আপনার চাওয়া কী?
আমি চাই সরকার সব বিভাগীয় মেডিকেল কলেজে নিঃস্ব ও বেওয়ারিশ ওয়ার্ড চালু করবে; সেখানে বিনা পয়সায় তারা চিকিৎসার পাশাপাশি ওষুধও পাবে। বেওয়ারিশদের দেখাশোনার জন্য সেখানে কিছু সেবক নিয়োগ দিতে হবে। তাদের পোশাকও কিনে দিতে হবে এবং সুস্থ হওয়ার পর কোনো একটা শেডের নীচে যেন আশ্রয় মেলে সেই ব্যবস্থা করতে হবে। এটা করলে কোনো মানুষ আমাদের অভিশাপ দিয়ে মারা যাবে না। বেসরকারিভাবে প্রত্যেক বিভাগে বেওয়ারিশদের জন্য চিকিৎসা, খাবার ও পোশাকের ব্যবস্থা করে একটা শেডের নীচে রাখার ব্যবস্থা নিতে হবে। বিত্তশালীরা একটু সহায়তা করলেই এটা সম্ভব।
আপনার কাজ নিয়ে মানুষ কী বলছে?
আমার মতো অনেকেই এমন কাজ করছেন, কিন্তু প্রচারে আসেন না। যারা ভালো কাজ করছেন, আপনারা তাদের পাশে দাঁড়াবেন। পুলিশ সহকর্মীরা আমার কাজকে অ্যাপ্রিশিয়েট করছেন। তবে কেউ কেউ সমালোচনাও করে। তবে ১৫ বছরের চাকরি জীবনে আমি প্রমোশন, ভালো পোস্টিংয়ের পেছনে দৌঁড়াইনি। আমার ব্যাচমেটদের ৯০ শতাংশ পদোন্নতি পেয়েছে। আমার নিজস্ব কোনো সম্পদ নেই। আমার ছেলেকে কোনো সম্পদ দিয়েও যেতে পারবো না৷ তাই তাকে হাফেজ বানাতে চাই, যেন সে মসজিদের ইমামতি বা মুয়াজ্জিনের চাকরি করে জীবন পার করতে পারে।
আপনার স্বপ্ন কী?
চট্টগ্রাম থেকে যেটা শুরু করেছি, তা সারা দেশে ছড়িয়ে যাক। প্রত্যেক বিভাগে শেড থাকবে, যেখানে পুরো বিভাগের বেওয়ারিশ মানুষ থাকা, খাওয়া ও চিকিৎসাসেবা পাবে। যেদিন আমার এই স্বপ্ন পূরণ হবে, সেদিনই আমার জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করবে। সবার উদ্দেশে বলব, ৩৬৫ দিনের মধ্যে একটা দিন এসব নিঃস্ব, অসহায় ও বেওয়ারিশ মানুষদের জন্য ব্যয় করুন।
প্রিয় পাঠক, আপনি কি কিছু বলতে চান? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷