‘যাদের বিশেষ জ্ঞান আছে, তাদেরই পর্যটনের দায়িত্ব দেয়া উচিত’
৩১ মে ২০২৪এসব বিষয়েই ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন এফবিসিসিআই'র ট্যুরস, ট্র্যাভেল এবং হসপিটালিটি সংক্রান্ত স্ট্যান্ডিং কমিটির সভাপতি, ট্যুর অপারেটর্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (টোয়াব)-এর তিন বারের সাবেক সভাপতি ও ট্যুরিজম বোর্ডের গভর্নিং বডির সাবেক সদস্য মো. রাফিউজ্জামান।
ডয়চে ভেলে: বাংলাদেশের পর্যটন শিল্প আকারে কত বড়?
মো. রাফিউজ্জামান: আমাদেরপর্যটন শিল্পের তিনটি দিক। ডমেস্টিক ট্যুরিজম, ইনবাউন্ড ট্যুরিজম এবং আউটবাউন্ড ট্যুরিজম । আমাদের ডমেস্টিক ট্যুরিজমের অবস্থা বেশ ভালো। আমাদের পর্যটন স্পটও বাড়ছে। আগে ১০টির নিচে ছিল, এখন ৩০টির মতো স্পট আছে। ডমেস্টিক ট্যুরিজমের নতুন নতুন স্পট তৈরি হয়েছে। আর ইনবাউন্ড ট্যুরিজমে বিদেশ থেকে বোনাফাইড ট্যুরিস্ট বাংলাদেশে খুব কমই আসে। ব্যবসার উদ্দেশ্যে অনেকে আসেন। টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমায় আসেন। আর দেশ থেকেও বিপূল সংখ্যক পর্যটক দেশের বাইরে যান। তবে আগের চেয়ে একটু কম, কারণ দেশের ভেতরে, বিশেষ করে কক্সবাজার ও সিলেটে আন্তর্জাতিক মানের রিসোর্ট হওয়াতে কেউ কেউ এখন সেখানে যাচ্ছেন।
আরেকটু সুনির্দিষ্ট করে যদি বলতেন। বছরে এই খাতে কত অর্থ ব্যয় হচ্ছে।বা কত আয় হচ্ছে?
এটা সুনির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। কারণ, এর সঙ্গে অনেক মন্ত্রণালয়, অনেক ধরনের খাত যুক্ত। তবে ডমেস্টিক ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে বলতে পারি, বছরে ১০ মিলিয়ন মুভমেন্ট হয়। তারা যদি প্রত্যেক মুভমেন্টে ১০ হাজার টাকাও খরচ করেন, তাহলে অঙ্কটা অনেক বড়।
প্রচলিত কক্সবাজার, কুয়াকাটা, সুন্দরবন বা সিলেটের বাইরে আমাদের পর্যটনের আর কোন কোন দিকে বিস্তৃত হয়েছে?
আমরা শুরু করেছি ৫০ বছর হলো। কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশগুলো অনেক আগে শুরু করেছে। তারপরও বাংলাদেশের কোনো কোনো অঞ্চলে এক হাজার কোটি টাকাও বিনিয়োগ হয়েছে পর্যটন শিল্পে ব্যক্তিখাতে। তবে যদি ব্যবসা না হয় তাহলে তো বিনিয়োগ হবে না। বাংলাদেশে এখন রুম ভাড়া ২৪ ঘন্টার জন্য ২০০ ডলারের নিচে পাবেন না। থাইল্যান্ড , নেপাল ও মালয়েশিয়ার তুলনায় এটা অনেক বেশি। তারপরও সেখানে রুম খালি থাকে না। কক্সবাজার, সিলেট, সুন্দরবনে হলিডেতে প্রচণ্ড ভিড় থাকে। যদি ডেস্টিনেশন বলেন, তাহলে তা খুব বেশি নাই। তারপরও পর্যটন এগোচ্ছে বলেই তো হোটেল খালি থাকছে না।
দেশে কত ট্যুর অপারেটর আছে?
আমাদের টোয়াবের সদস্য আছেন ৮৮৫ জন। কিন্তু দিন দিন এই সংখ্যা বাড়ছে। তরুণরা এই ব্যবসায় আসছেন। অনেকে পড়াশুনা শেষ করে পর্যটন ব্যবসাকে পেশা হিসেবে নিচ্ছেন। বাংলাদেশের ১৯টি বিশ্ববিদ্যালয় এখন ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি পড়াচ্ছে । আরো ১০টা ইনস্টিটিউট আছে শুধু এই বিষয়ের ওপর।
এখানে যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পর্যটকদের নিরাপত্তা কেমন?
যাদের জিডিপিতে পর্যটনের অবদান অনেক বেশি, যারা এই শিল্পে বিশ্বে এক থেকে দশের মধ্যে আছে সেইসব দেশেও পর্যটকরা হামলার শিকার হচ্ছেন।
আমি বাংলাদেশের অবস্থা জানতে চাইছি...
কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া সার্বিক পরিস্থিতি ভালো। এখানে আলাদা ট্যুরিস্ট পুলিশ আছে। বিচের জন্য আলাদা ম্যানেজমেন্ট আছে।
এখানে পর্যটনের খরচ বেশি কেন?
কারণ, আমাদের এখানে আন্তর্জাতিক মানের পর্যাপ্ত হোটেল রিসোর্ট নাই। সেই কারণে ভাড়া বেশি।
পর্যটক মানেই তো সবাই ধনী না। তাহলে তাদের জন্য কী ব্যবস্থা?
সেটা ঠিক। আসলে পর্যাপ্ত হোটেল রিসোর্ট হলে খরচ কমে আসবে।
পর্যটন কর্পোরেশন, ট্যুরিজম বোর্ড কী করছে?
পর্যটন কর্পোরেশন কিছু স্থাপনা করে, হোটেল মোটেল করে। তারা তাদের ব্যবসা বাড়াতে চায়। আর ট্যুরিজম বোর্ডের কাজ হলো বাংলাদেশের পর্যটনকে ব্র্যান্ডিং করা।
তারা কি বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করতে পারছে? পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে পারছে?
তারা আসলে সেটা সন্তোষজনকভাবে পারছেন না। তাদের আরো তৎপর হওয়া প্রয়োজন। বাংলাদেশকে বিদেশি পর্যটকদের কাছে উপস্থাপন করার জন্য, আকৃষ্ট করার জন্য অনেক কিছু করার আছে।
বাংলাদেশকে ব্র্যান্ডিং করার ক্ষেত্রে কোথায় কোথায় ঘাটতি আছে?
আমাদের যে আইকনিক ট্যুরিজমের জায়গাগুলো আছে, আমাদের ঋতু বৈচিত্র্য, সংস্কৃতি, খাবার- এগুলো বিদেশে আমাদের দূতাবাসের মাধ্যমে তুলে ধরতে হবে।
আমাদের সংস্কৃতিকে জানার জন্য কী ব্যবস্থা আছে? পর্যটকরা কি এখানকার জনজীবনে , পরিবারে মিশে যেতে পারেন?
আমরা ‘হোম স্টে'র প্রবর্তন করেছি। উত্তরবঙ্গের দুইটি গ্রামে আমরা পরিবারের সঙ্গে থেকে সেখানকার সংস্কৃতি, জীবন যাতে তারা বুঝতে পারেন তা চালু করেছিলাম। কিন্তু নিরাপত্তার জন্য শেষ পর্যন্ত আমরা তা অব্যাহত রাখতে পারিনি।
আমাদের পার্বত্য চট্টগ্রাম তো পর্যটনের বড় জায়গা। সেখানে কি বিদেশিরা আদিবাসীদের পরিবারের সঙ্গে থাকতে পারে? সব জায়গায় যেতে পারে?
ওই জায়গাটা সেনসিটিভ। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা আছে সেখানে। নিরপত্তার প্রশ্ন আছে। তবে বিদেশি পর্যটকদের ক্ষেত্রে বিধিনিষেধ ধাকলেও দেশি পর্যটকরা সেখানে যেতে পারেন।
বিদেশি পর্যটকদের আমরা কি সব ধরনের সুবিধা দিতে পারছি? তাদের মতো থাকার ব্যবস্থা করতে পারছি?
বিদেশি পর্যটকদের জন্য আলাদা জোন হচ্ছে। ওই সব জোনে বিদেশি পর্যটকদের জন্য নাইট ক্লাব ও লিকারের ব্যবস্থা থাকবে। আবার সুন্দরবন কিন্তু সবার জন্য না। সেখানকার জীববৈচিত্র্য রক্ষা করতে হবে। ইকো ট্যুরিজমের আলাদা চরিত্র আছে। আর সি বিচে এনজয় করার জন্য ব্যবস্থা হচ্ছে।
কক্সবাজারের সি বিচ তো দখল হয়ে গেছে। অপরিকল্পিত স্থাপনা হয়েছে, অপরিকল্পিত পর্যটন হচ্ছে...
আগে যেসব অপরিকল্পিত স্থাপনা তৈরি হয়েছে, সেগুলো আছে। কিন্তু এখন আর নতুন করে তৈরি করতে দিচ্ছে না। বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি হয়েছে৷ তারা এগুলো দেখছে। যেগুলো হয়ে গেছে, সেই জঞ্জাল থেকে সি বিচ কীভাবে বাঁচানো যায় তার পরিকল্পনা হচ্ছে।
তরুণরা কতটা এগিয়ে নিচ্ছেন?
তারাই এখন মূল শক্তি। তারা নতুন নতুন আইডিয়া নিয়ে আসছে। তারা টাঙ্গুয়া হাওড় এলাকায় হাউজবোট চালু করেছে, তারা পর্যটনের নতুন নতুন ক্ষেত্র তৈরি করছেন। সাবেক রাষ্ট্রপতির বাড়ি হাওড় এলাকায় সড়ক হওয়ার পর সেখানে এখন তরুণরা যাচ্ছেন। তারা নতুন নতুন কাজ করছেন।
হাওড়ের ওই সড়ক নিয়ে তো প্রশ্ন আছে। ওটা কি পরিবেশবান্ধব হয়েছে?
না, সেটা নিয়ে তো বিতর্ক আছে। আসলে পর্যটনের নানা বিষয় আছে। কখনো পরিবেশের সঙ্গে দ্বন্দ্ব হয়।
সরকারি বিভিন্ন পর্যায়ে যারা পর্যটনের জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত তারা কি বোঝেন যে পরিবেশ, প্রতিবেশ রক্ষা করে কিভাবে কাজ করতে হয়? কিভাবে ব্র্যান্ডিং করতে হয়?
যরা হর্তাকর্তা আছেন, তারা সরকারি কর্মকর্তা। তারা আমলা। তাদের এখানে পাঠানো হয়। তারা প্রশাসনের কর্মকর্তা। কিন্তু তাদের এই খাতের জন্য আলাদা দক্ষতা বা বিশেষ জ্ঞান নাই। তারা পর্যটন বোঝেন না, তারা চাকরি করেন। দরকার হলো যারা এটা নিয়ে পড়াশোনা করেছেন, যাদের এই খাত নিয়ে বিশেষ জ্ঞান আছে, তাদের দায়িত্ব দেয়া, তাদের কাজে লাগানো।