অবকাঠামো খাতে গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক সৃষ্টির মতো আলোচিত ঘটনা থাকলেও বছর জুড়ে ডলার সংকট ও মূল্যস্ফীতির উর্ধ্বগতি বিষিয়ে তুলেছিল দেশের অর্থনৈতিক খাত ও মানুষের স্বাভাবিক জীবনকে৷
একদিকে বিরোধীদের জ্বালাও-পোড়াও আর সহিংস আন্দোলন, অন্যদিকে সরকারের দমন-নিপীড়ন, ঢালাও গ্রেপ্তার অভিযান ও ‘কিংস পার্টি' গঠনের উদ্যোগকে ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত নির্বাচনমুখী দেশের রাজনীতি৷ অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য মার্কিন ভিসা নীতির চাপ বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের কূটনৈতিক সম্পর্কের অবনতি ঘটালেও একই চাপ অন্য তিন বৈদেশিক শক্তি চীন-রাশিয়া-ভারতকে বাংলাদেশের কাছাকাছি এনেছে৷ এমন বেশ কিছু আলোচিত-সমালোচিত ঘটন-অঘটন এবং ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হতে চলেছে বাংলাদেশের ২০২৩ সাল৷
অর্থনৈতিক দিক থেকে বাংলাদেশের জন্য ২০২৩ সাল ছিল মন্দা আর মূল্যস্ফীতির চাপের বছর৷ উচ্চ মূল্যস্ফীতি, ডলারের বিপরীতে টাকার মানের অবনতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাওয়া, তীব্র ডলার সংকট, ব্যাংক খাতে খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকট বেড়ে যাওয়া এবং রাজনৈতিক সহিংসতায় বেসরকারি বিনিয়োগ কমে যাওয়ায় বিদায়ী বছরে সংকটের মধ্য দিয়ে গেছে বাংলাদেশের অর্থনীতি৷ এ বছর দেশের অর্থনীতি চাপের মধ্যে থাকায় সংশোধিত বাজেটে সরকার জিডিপির প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা সাড়ে সাত শতাংশ থেকে কমিয়ে সাত শতাংশ করেছিল৷ অবশ্য বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের পূর্বাভাস ছিল, বিদায়ী বছরে জিডিপির প্রবৃদ্ধি ৬ শতাংশের বেশি হবে না৷ তবে আইএমএফের হিসেব অনুযায়ী, দেশের অভ্যন্তরে মাথাপিছু আয়ের ক্ষেত্রে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ৷
বছরের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত প্রায় সব পণ্যের চড়া দাম পরিশোধ করতে হওয়ায় সাধারণ মানুষকে চরম দুর্ভোগের মধ্যে দিয়ে দিনাতিপাত করতে হয়েছে৷ বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সবশেষ তথ্যানুযায়ী, ২০২৩ সালের অক্টোবরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১২ দশমিক ৫৬ শতাংশ, যা গত ১১ বছর ৯ মাসের মধ্যে ছিল সর্বোচ্চ৷ খাদ্য মূল্যস্ফীতি বেশি বেড়েছে গ্রামীণ এলাকায়, যার পরিমাণ ছিল ১২ দশমিক ৭১ শতাংশ৷ উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে মানুষের জীবনযাত্রার ওপর বিরূপ পড়েছে৷ বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির (ডব্লিউএফপি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের ৬৮ শতাংশ মানুষ খাবার কিনতে হিমশিম খাচ্ছে৷ একদিকে নিত্যপণ্য ও সেবার মূল্য অনেক বেড়ে গেছে, অন্যদিকে মানুষের আয় কমে যাওয়ায় খাদ্য-শিক্ষা-চিকিৎসার মতো অপরিহার্য ব্যয় থেকে কাটছাঁট করতে বাধ্য হচ্ছে বেশির ভাগ মানুষ৷ টিসিবির মাধ্যমে কম দামে পণ্য বিক্রির উদ্যোগ কিছুটা কাজে দিলেও ডিম, পেঁয়াজ, আলুর মত নিত্যপণ্য আমদানির ঘোষণা বাজারে পণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি৷ বছর শেষে পেঁয়াজের দাম নিয়ে হুলস্থুল কাণ্ড বাজার ব্যবস্থাপনায় সরকারের নিয়ন্ত্রণহীনতার একটি বড় উদাহরণ হয়েই থাকলো৷ আন্তর্জাতিক বাজারে ক্রমান্বয়ে পণ্যের মূল্য কমে গেলেও বাংলাদেশে এর প্রভাব খুব একটা দেখা যায়নি বছরটিতে৷ বছর জুড়েই নিত্যপণ্যের চড়া দামের কারণে নিম্ন আয়ের মানুষকে কখনও পেঁয়াজের ঝাঁজ কিংবা কাঁচা মরিচের ঝাল, কখনও ডিমের তেলেসমাতি কিংবা গরুর মাংসের কারসাজি, কখনও আবার আটার বাহাদুরি কিংবা চিনির তিক্ত স্বাদ নিতে হয়েছে৷
বিশ্ববাজারে চাহিদা কমে যাওয়া ও মজুরি নিয়ে শ্রমিক অসন্তোষের কারণে রপ্তানি আয় হ্রাস পাওয়া, রেমিট্যান্স বা প্রবাসী আয়ে ধীরগতি ও ডলারসংকটের কারণে বৈদেশিক লেনদেনের ভারসাম্যে বিগত বছরে বড় ধরনের চাপ ছিল৷ ২০২২ সালের মাঝামাঝি থেকে ডলার সংকট শুরু হলেও তা তীব্র আকার ধারণ করে ২০২৩ সালের শুরু থেকে৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণমূলক নীতি ডলার সংকটের তীব্রতা এতটা ঘনীভূত করেছিল যে, ব্যবসায়ীরা এলসি খুলতে না পারায় শিল্পের মূলধনি যন্ত্রাংশ ও কাঁচামালের আমদানি ব্যাপক হারে কমে গিয়েছেল৷ ফলশ্রুতিতে বিনিয়োগে নেমে এসেছিল মন্দা ভাব এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে নিত্যপণ্যের মূল্য অস্থির হয়ে পড়েছিল৷ মুদ্রার বিনিময় হার বাজারভিত্তিক করা, ডলারের আলাদা রেট নির্ধারণ, পুনরায় অভিন্ন রেটে ফিরে যাওয়াসহ বাংলাদেশ ব্যাংক নানা উদ্যোগ নেয়ার পরও ডলারের বাজারে অস্থিরতা এখনও চলছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসেব অনুযায়ী, ডলারের বিপরীতে টাকার মান গত দুই বছরে প্রায় ৩০ শতাংশ পতন ঘটে৷ জানুয়ারিতে মোট রিজার্ভ ছিল ৩ হাজার ২২২ কোটি ডলার৷ ডিসেম্বরে এসে তা দাঁড়ায় ২ হাজার ৫৮২ কোটি ডলারে৷ অর্থাৎ কমেছে ৬৪০ কোটি ডলার বা প্রায় ২০ শতাংশ৷ তবে আইএমএফের ৬৮ কোটি ৯৮ লাখ ডলার ও এডিবির ৪০ কোটি ডলার ঋণ বছরের শেষ দিকে রিজার্ভে কিছুটা হলেও স্বস্তি ফিরিয়ে এনেছে৷
রাজস্ব খাতে বিশাল ঘাটতির কারণে সরকারের ঋণ নির্ভরশীলতা বেড়ে যাওয়ায় পরিস্থিতি আরো জটিল হয়েছে৷ বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরে সরকার ব্যাংক খাত থেকে ১ লাখ ৩২ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকা ঋণ নেয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে৷ বিভিন্ন প্রকল্পে ভারত, চীন ও রাশিয়া থেকে কঠিন শর্তে ঋণ নেয়ার প্রবণতা বেড়েছে৷ ব্যাংকিং খাতের সব সূচকই ছিল নিম্নমুখী৷ একদিকে খেলাপি ঋণ ও তারল্য সংকট বেড়েছে অন্যদিকে আয় কমেছে ব্যাংকগুলোর৷ কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য মতে, জুন শেষে খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ায় ১ লাখ ৫৬ হাজার ৩৯ কোটি টাকায়, যা ছিল বিতরণকৃত ঋণের ১০ দশমিক ১১ শতাংশ৷ বেসরকারি খাতের ঋণপ্রবাহ কমায় বিনিয়োগের গতি ছিল শিথিল৷ ঋণের সুদ হার বাজারভিত্তিক করেও পরিস্থিতির খুব একটা উন্নতি করা যায়নি৷
আর্থিক ও ব্যাংকিং খাতের খারাপ অবস্থা সত্ত্বেও বছর জুড়ে ইতিবাচক দিক ছিল বেশ কয়েকটি মেগাপ্রকল্প উন্মুক্ত করার মধ্য দিয়ে সরকারের উন্নয়ন চমকের ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা৷ নির্বাচনকে সামনে রেখে সেপ্টেম্বর থেকে নভেম্বরের মধ্যে একে একে খুলে দেওয়া হয় সরকারের বেশ কিছু মেগাপ্রকল্প৷ এরমধ্যে আছে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল, কর্ণফুলী নদীতে বঙ্গবন্ধু টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, ঢাকা-কক্সবাজার রেলপথ চালু অন্যতম৷ এছাড়া পদ্মাসেতুতে রেল সংযোগ (ঢাকা-ভাঙ্গা), আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত মেট্রোরেল, আখাউড়া-আগরতলা ডুয়েল গেজ রেললাইন, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একাংশ চালু হয়েছে৷ ২০২৩-২৪ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে প্রকল্পভিত্তিক বরাদ্দে মেগাপ্রকল্পে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে৷ বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচির (এডিপি) আওতায় ১৪টি মেগা প্রকল্প ও কর্মসূচি মিলে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হয় ৬৫ হাজার ৭৬০ কোটি টাকা৷
গত ২ সেপ্টেম্বর উদ্বোধন হয় ১৯.৭৩ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে৷ উদ্বোধনের পরদিন থেকে কাওলা-তেজগাঁও পর্যন্ত অংশে সাধারণ যানবাহন চলাচল করতে খুলে দেওয়া হয়৷ তবে দুটি এক্সপ্রেসওয়ে পুরোপুরি চালু হওয়ার আগেই উন্মুক্ত করে দেয়ায় এগুলোর সুবিধা ও কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষজ্ঞ মহলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে৷ বিশেষ করে রাজধানীতে এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েতে চলাচলকারীর ৯৯ শতাংশই প্রাইভেট কার৷ ৭ অক্টোবর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের তৃতীয় টার্মিনাল উদ্বোধন হয় যার মাধ্যমে বছরে অতিরিক্ত ১ কোটি ২০ লাখ যাত্রীকে সেবা দেওয়া সম্ভব হবে৷ ২১ হাজার ৩৯৯ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই টার্মিনালে পুরো কার্যক্রম নতুন বছরের শেষ দিকে চালু হওয়ার সম্ভাবনা আছে৷ নতুন এই টার্মিনালটি দেশের এভিয়েশন খাতকে আমূল বদলে দিতে পারে বলেই বিশেষজ্ঞদের ধারণা৷ ২৮ অক্টোবর চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর নিচ দিয়ে ১০ হাজার ৬৯০ কোটি টাকা খরচে তৈরি করা বঙ্গবন্ধু টানেল উদ্বোধন করা হয়, যা দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে নদী তলদেশে প্রথম টানেল৷ তবে টানেলটি টোল ভাড়া বেশি হওয়ায় প্রত্যাশিত হারে গাড়ি চলাচল হচ্ছে না বলে অভিযোগ রয়েছে৷ ফলে টানেলের আয়ের চেয়ে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয় বেশি হতে পারে বলে অনেক বিশেষজ্ঞের মত ইতিমধ্যে বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে৷ এছাড়া রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি অংশ খুলে দেওয়া হয়েছে৷ যার মাধ্যমে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের যুগে প্রবেশ করলো বাংলাদেশ৷
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিদায়ী বছরে উত্তপ্ত ছিল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন৷ অন্যান্য বছরের মতই এই অঙ্গনে ছিল হানাহানি, সংঘাত আর পাল্টাপাল্টি অভিযোগ৷ বছর জুড়ে বিএনপির শীর্ষ নেতাদের গ্রেপ্তার উত্তাপ ছড়ায়৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে সরকার বিরোধী দলগুলোর রাজনৈতিক কর্মসূচি পালনের ব্যাপারে নমনীয় ছিল৷ এরপর থেকে বিএনপি বেশকিছু কর্মসূচির মাধ্যমে রাজনীতির মাঠে সরব ছিল৷ কিন্তু ২৮ অক্টোবরের সহিংস ঘটনাকে কেন্দ্র করে পরিস্থিতি পাল্টে যায় রাতারাতি৷ শুরু হয় বিএনপি নেতা-কর্মীদের অবাধে গ্রেপ্তার অভিযান৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের ওপর ভুতুড়ে মামলা দায়েরেরও ঘটনা ঘটেছে৷ পুরাতন নাশকতার মামলাগুলোতে বছরের শেষ দিকে এসে সহস্রাধিক বিএনপি নেতা-কর্মীর বিরুদ্ধে কারাদণ্ডের রায় হয়৷ এর আগে বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া, ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী জোবাইদা রহমানের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলার রায় হয়৷ আবার বিএনপির ডাকে অবরোধ হরতাল কর্মসূচিতে পরিবহণে অগ্নিসংযোগ, মানুষ পুড়িয়ে মারার মত ঘটনা ঘটেছে৷ বিএনপির রাজনীতি মোকাবিলায় আওয়ামী লীগও ব্যাপক কর্মসূচি পালন করে৷ সংঘাতময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে নির্বাচন কমিশন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজনের উদ্যোগ নেয়, নির্বাচনী তফসিল ঘোষণা করে৷ নির্বাচনকে ঘিরে বিএনপি ও সমমনা দলগুলোকে ভাঙ্গনের মাধ্যমে কিংস পার্টি গঠনেরও আয়োজন ছিল রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বছরের আলোচিত ঘটনা৷ ৭ জানুয়ারি অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনটি বিগত ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মত প্রশ্নবিদ্ধ হবে না বলে নির্বাচন কমিশন বারবার আশ্বস্ত করার চেষ্টা করলেও বিএনপি ও এর সমমনা বেশ কিছু রাজনৈতিক দল এই নির্বাচনের বর্জন করে৷ অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও এর সমমনা রাজনৈতিক দলগুলো নানাভাবে সমঝোতার মাধ্যমে আসন ভাগাভাগির মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে৷ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হিসেবে প্রমাণের জন্য আওয়ামী লীগের বিদ্রোহী প্রার্থীদের অবাধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে দেয়ার ঘটনা বাংলাদেশের নির্বাচনে নতুন নজির সৃষ্টি করেছে৷ নির্বাচনি হলফনামায় দায়েকৃত সম্পত্তির হিসেবে ক্ষমতাসীনদের অস্বাভাবিক হারে সম্পত্তির বৃদ্ধির হার ছিল বছরের শেষ দিকে গণমাধ্যম আধেয়ের অন্যতম উপজীব্য৷
বাংলাদেশে অভ্যন্তরীণ রাজনীতি ও জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে ঘিরে বিদেশি পরাশক্তিগুলোর মধ্যকার স্পষ্টত বিভক্তি ছিল ২০২৩ সালের বিশেষ উল্লেখযোগ্য ঘটনা, যা বাংলাদেশের এতদিনকার ‘ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্র নীতি'কে চ্যালেঞ্জের মুখে ঠেলে দিয়েছিল৷ ২০২৩ সালে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীন রাজনীতি নিয়ে বৈশ্বিক পরাশক্তিগুলোর তৎপরতা, বিবৃতি, অভিযোগ-পাল্টা অভিযোগ দেখে মনে হতে পারে, বিশ্বের নতুন রাজনৈতিক মেরুকরণে বাংলাদেশ শক্তিশালী দেশগুলোর আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে৷ এটি স্পষ্ট যে, বাংলাদেশ যুগপৎভাবে যুক্তরাষ্ট্র এবং রাশিয়া-চীন ও ভারত-চীন ভিত্তিক ভূরাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বৃত্তের জটিল সমীকরণের মধ্যে আটকা পড়েছে৷
ভারত, চীন ও রাশিয়া রাজনৈতিক সংঘাত ও নির্বাচনকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় হিসেবে বিবেচনা করে বছর জুড়ে ক্ষমতাসীন সরকারকে সমর্থন দেয়৷ কিন্তু যুক্তরাষ্ট্র এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা বাংলাদেশে অবাধ, সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের জন্য নানাবিধ চাপ প্রয়োগের চেষ্টা করছে৷ সেই ধারাবাহিকতায় গত ২৭ মে ভিসানীতি ঘোষণা করে যুক্তরাষ্ট্র৷ এই ভিসা নীতি অনুযায়ী, বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী বা জড়িত বলে মনে করা যেকোনো বাংলাদেশি নাগরিকের ভিসা প্রদানে বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে৷ এর পাশাপাশি সরকার ও বিরোধী দলের সাথে দফায় দফায় বৈঠকসহ ঢাকায় নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইস্যুতে বেশ তৎপর ছিলেন৷ যার প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো প্রভাব খাটাচ্ছে বলে অভিযোগ তুলেছিল রাশিয়া৷ এ অভিযোগ অস্বীকার করে যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা অভিযোগে বলেছিল, রাশিয়া ইচ্ছাকৃতভাবে রাষ্ট্রদূত পিটার হাস সম্পর্কে ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে৷
গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে চাপ দেয়ায় যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্কে বছর জুড়েই টানাপোড়েন লক্ষ্য করা গেছে৷ বিপরীতে চীন ও রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক অনেক পোক্ত হতে দেখা গেছে৷ ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বাংলাদেশের বাণিজ্যেও নিম্নমুখীতা লক্ষ্য করা গেছে৷ বাংলাদেশের তৈরি পোশাকের সবচেয়ে বড় গন্তব্য যুক্তরাষ্ট্র৷ যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল ট্রেড কমিশনের তথ্যানুযায়ী, গত জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশের পোশাক রফতানি ২৪ দশমিক ৭৫ শতাংশ কমে ৬ দশমিক ৩৫ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে৷ অথচ এ সময়ে চীন ও রাশিয়ার সাথে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বেড়েছে৷ যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা নীতি ঘোষণার আগে ও পরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তাঁর দলের নেতাকর্মীরা যুক্তরাষ্ট্রের তীব্র সমালোচনা করে বক্তব্য দিয়েছিলেন৷ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মে মাসে লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বলেছিলেন, ‘‘আমি বাংলাদেশের জন্য যেসব উন্নতি করেছি, সেটা তারা হয়তো গ্রহণ করতে পারছে না৷ এটা আমার অনুভূতি৷'' অন্যদিকে রাশিয়া তাদের ৩০টিরও বেশি ‘বন্ধু ও নিরপেক্ষ' দেশের তালিকায় বাংলাদেশের নাম অন্তর্ভুক্ত করেছিল৷ গত নভেম্বরে রাশিয়া-বাংলাদেশ সম্পর্কের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে বন্ধুত্বপূর্ণ সফরে বাংলাদেশে আসে রাশিয়ার প্রশান্ত মহাসাগরীয় নৌবহরের তিনটি জাহাজ, যা নিয়ে মার্কিন ব্লকের বিশ্লেষকদের মধ্যে বেশ উত্তেজনা দেখা দেয়৷ বড় বড় প্রকল্পগুলো আর্থিক বিনিয়োগের পাশাপাশি বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব, স্বাধীনতা ও ভৌগোলিক অখণ্ডতা রক্ষায় পাশে থাকার ঘোষণা দেয় বেইজিং৷ মার্কিন সরকারের ভিসা নীতির বিরুদ্ধে চীন বাংলাদেশ সরকারের অবস্থানকে বেশ দৃঢ়ভাবে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়ে মার্কিন আধিপত্যবাদের সমালোচনা করেছিল৷ আবার ভারত-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে চীন-যুক্তরাষ্ট্র চলমান দ্বৈরতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের অভিন্ন স্বার্থ থাকলেও বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যে তোড়জোর ছিল তার সঙ্গে সুর মেলাতে পারেনি বাংলাদেশের প্রতিবেশী সবচেয়ে বড় রাষ্ট্রটি৷ বরং পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রীদের ‘টু-প্লাস-টু' বৈঠকে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে ভারতের অবস্থান যুক্তরাষ্ট্রকে জানিয়ে দেয় দেশটি৷ যুক্তরাষ্ট্র যাতে বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বেশি চাপ না দেয় সে বার্তা দেয়া হয়েছিল বলে গণমাধ্যমের খবরে প্রকাশিত হয়েছে৷ এরপর থেকে মূলতঃ রাষ্ট্রদূত পিটার হাসের তৎপরতা কমে আসে এবং ‘তলে তলে সমঝোতা হওয়ার' কথাও শোনা যায় আওয়ামী লীগের নেতাদের মুখে৷
সব মিলিয়ে ২০২৩ সালে উন্নয়নপ্রকল্পের ধারা ঊর্ধ্বগামী থাকলেও গণতন্ত্র সূচকের ক্ষেত্রে ধারাটি ছিল বিপরীত৷ পারস্পরিক সংঘর্ষের ফাঁদের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও কূটনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতাকে সঙ্গী করে ২০২৩ বিদায় নিচ্ছে৷ স্বাগত জানাতে হবে ২০২৪-কে৷ এই নতুন বছর হচ্ছে নির্বাচনের বছর৷ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য আন্তর্জাতিক চাপ সামলানোর পাশাপাশি দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের পর নতুন সরকারকে দেশের বর্তমান অর্থনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বেশ কিছু শক্ত চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে হবে৷ বিগত বছরের সাফল্য-ব্যর্থতার প্রেক্ষাপটে নতুন বছরটি সুখময় ও শান্তিপূর্ণ হোক – সেটাই নববর্ষে মানুষের প্রত্যাশা৷