উগ্রপন্থিদের মোকাবিলায় গণতন্ত্রকে হতে হবে ‘আপোশহীন'
৩০ অক্টোবর ২০১৪সিরিয়া ও ইরাকের সংঘাত কুর্দি ও ইসলামিক স্টেট (আইএস) সমর্থকদের সংঘর্ষের মাধ্যমে জার্মানিতেও ঢুকে পড়েছে৷ এতে বোঝা যায়, কিছু শরণার্থী, অভিবাসীদের একটি অংশ এবং উগ্র ইসলামপন্থিরা বিশ্বের অন্যান্য অংশ থেকে তাদের রাজনৈতিক আদর্শ এ দেশে আমদানি করছে৷ জার্মানিতে বেড়ে ওঠা অভিবাসী বংশোদ্ভূত কিছু ছেলে-মেয়ে, আজকাল মধ্যপ্রাচ্যের কিছু মানুষের ধ্যাণধারণাকে গ্রহণ করছে, যাদের প্রতি তারা সহানুভূতিশীল৷
মনে হচ্ছে, এখানেও রাস্তায় মানুষের মৃত্যু দেখা এখন সময়ের ব্যাপার৷ আরেকটি বড় বিষয়, সিরিয়া ও ইরাক থেকে তথাকথিত ইসলামিক স্টেট-এর অস্ত্র নিয়ে কিছু মানুষ জার্মানিতে ফিরছে, যার ফলে ভবিষ্যতে তারা সাধারণ জার্মানদের বিরুদ্ধে সন্ত্রাসী কার্যক্রম পরিচালনা করতে পারে – এমন আশঙ্কাও দেখা দিচ্ছে৷
জার্মানি, ফ্রান্স, ব্রিটেন ও বেলজিয়ামের মতো উদার গণতন্ত্রী দেশ, যারা বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষদের আসতে দিয়েছে, তাদের জন্য এটা সতর্ক হবার সময়৷ জার্মানির সামনে খুব সহজ একটা প্রশ্ন – গণতন্ত্র এবং শান্তিপূর্ণ জনমতের ওপর গড়ে ওঠা জার্মান সমাজ কি জনগণ ও প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপর যে ধকল পড়ছে, তা সহ্য করতে পারবে?
উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে৷ কয়েক দিন আগেই জার্মানির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান জানান, দেশে এখন ছয় হাজারের মতো উগ্র সালাফিস্ট আছে৷ তাদের মধ্যে কয়েক'শ লোক আবার তথাকথিত ইসলামিক স্টেট-এর হয়ে যু্দ্ধ করতে সিরিয়ায় গিয়েছে৷ তিনি এ কথাও বলেছেন যে, জার্মানিতে উগ্র ইসলামপন্থিদের প্রকৃত সংখ্যা অনেক বেশিও হতে পারে৷
গত সপ্তাহান্তে সালাফিস্টদের বিরুদ্ধে কোলন শহরে উগ্র ডানপন্থি নব্য নাৎসিরাও সমাবেশ করেছে৷ সমাবেশকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সংঘর্ষ হয়েছে৷ উগ্র ডানপন্থিরা এতে যে জার্মানির সংবিধান স্বীকৃত বহুজাতিক সমাজের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার একটা মওকা পেয়ে গেল, তাতে কোনো সন্দেহ নেই৷ নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের মাধ্যমে তারা ইসলামি উগ্রপন্থিদের এটাও বোঝাতে চেয়েছে যে, জার্মান সমাজ অত সহনশীল নয়৷
জার্মানির প্রথম গণতন্ত্র ‘দ্য ভাইমার রিপাবলিক' ধ্বংস করা হয়েছিল ১৯২০ এবং ১৯৩০-এর দশকের গোড়ার দিকে৷ একদিকে নাৎসি, অন্যদিকে সমাজতান্ত্রিক – দু'পক্ষ মিলেই তা করেছিল৷ দু'পক্ষই গণতন্ত্রকে নাকচ করে সর্বাত্মক সমাধানের উপায় খুঁজেছিল৷ এ কারণেই যু্দ্ধ পরবর্তী সময়ে সাংবিধানিক আদালত ‘মিলিটান্ট ডেমোক্র্যাসি' বা ‘আপোশহীন গণতন্ত্র'-এর কথা বলে, যা নিজেকে রক্ষা করতে সক্ষম৷ এখন গণতন্ত্রের জন্য যে হুমকি দেখা যাচ্ছে তা অবশ্য ১৯২০-এর দশকের সঙ্গে তুলনীয় নয়৷এখন দু'তরফ থেকেই যে হুমকি আসছে – এ সত্য অগ্রাহ্য করার মতো নয়৷
কিন্তু এ দেশ এমন পরিস্থিতির মুখোমুখি হলো কীভাবে? জার্মানি শুরুতে অনেক বছর অভিবাসীরা পরিপূর্ণভাবে অঙ্গীভূত হোক, গণতান্ত্রিক মূ্ল্যবোধকে গ্রহণ করুক – তা সেভাবে চায়নি৷ মৌলবিরা যে ঘৃণা ছড়ান আর তা থেকে যে বিপদের আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে – এ বিষয়টির দিক থেকে দৃষ্টি সরিয়ে রাখা রাজনীতিবিদদের জন্যও ছিল সুবিধাজনক৷ বিষয়টিকে স্রেফ সাংস্কৃতিক তারতম্য-প্রসূত বিষয় হিসেবে দেখলেই তখন চলেছে৷ আর এ কারণে কেউ ধারণাও করতে পারেনি যে, যুক্তরাষ্ট্রে চালানো ৯/১১-র হামলায় এমন কেউ অংশ নিতে পারে যে, হামবুর্গে থেকেছে এবং সেখানে লেখাপড়াও করেছে৷ কেউ ঘৃণা ও ব্যাপক হত্যাকাণ্ডের নীলনকশা করার মতো নোংরা দর্শণকে জার্মানিতে বসবাস করেই ঝালিয়ে নিতে পারে – এটাও কেউ ভাবতে পারেনি৷ অবশ্য এমনও হতে পারে যে, কিছু বললেই তাঁকে অসহিষ্ণু, বর্ণবাদী বা নাৎসি বলা হবে – এই ভয়েই তখন এমন দর্শনের বিরুদ্ধে কেউ কিছু বলেনি৷ সম্প্রতি জার্মানির এক শহরে সালাফিস্টরা শরিয়া পুলিশের পোশাক পরে ব়্যালি করার পরই সবার টনক নড়ে৷ ধর্মনিরপেক্ষতার দেশ জার্মানিতে সমান্তরাল কোনো আইন তো চলতে পারে না৷
উগ্র ডানপন্থিদের হুমকি এবং তাদের অন্তরের বর্ণবাদী চেতনাকেও অনেককাল ছোট করে দেখা হয়েছে৷ তাই গত কয়েক দশকে অনেক অভিবাসী হত্যার পেছনে যে ‘ন্যাশনাল সোশ্যালিস্ট আন্ডারগ্রাউন্ড' নামের একটি সন্ত্রাসী সংগঠন জড়িত থাকতে পারে, জার্মানির নিরাপত্তা বাহিনী তা ধারণাই করতে পারেনি৷
এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, গত সপ্তাহান্তে কোলনের সমাবেশটির পর রক্ষণশীলরা আইন আরো কঠোর করার দাবি তুলেছে৷ তা করা হলে এ সমাজে যে কোনো বিশ্বাস গ্রহণ করা বা না করার স্বাধীনতা উপভোগ করছে এমন কিছু নিরীহ মানুষের হয়ত সমস্যা হবে৷
তবে রাজনীতিবিদদের আরেকটি অংশ বলছেন, আইন বদলানোর কোনো প্রয়োজন নেই৷ তাঁরা ঠিকই বলছেন৷ তবে নিরাপত্তা বাহিনীকে উগ্র দুটি সংগঠনের বিরুদ্ধে বর্তমান আইনে স্বীকৃত পূর্ণ শক্তি প্রয়োগ করতে হবে৷ হিটলারের আদর্শ অনুসরণ বা বিদেশ থেকে উগ্র ইসলামি চেতনা আমদানি করা কোনো সমস্যা নয় – এমন ভান করাটা বন্ধ করতে হবে৷ জার্মানির সহনশীল সমাজকে এ সব প্রতিহত করতে হবে৷ একেই বলে ‘মিলিটান্ট ডেমোক্র্যাসি' বা ‘আপোশহীন গণতন্ত্র'৷