ইস্তানবুলে সাকিরিন মসজিদের স্থপতি একজন মহিলা
১৯ মার্চ ২০১০পুরুষদের কাজ আর মহিলাদের কাজ কি নির্দিষ্ট করে ভাগ করে দেয়া আছে ? একজন পুরুষ যা পারেন একজন মহিলা কি তা পারেন ? বলা যেতে পারে, মহিলারা একটু বেশিই পারেন৷ তাঁরা সন্তানের জন্ম দেন৷ কিন্তু যদি কখনো জোর করে বলা হয়, ‘এই বিশেষ কাজটি পুরুষদের জন্য, মহিলারা এটা করতে পারবে না', এবং তখন যদি কোন মহিলা এগিয়ে এসে সেটা করে দেখিয়ে দেন, তাহলে বিষয়টি কেমন দাঁড়াবে ? ঠিক এরকম ঘটনা ঘটেছে তুরস্কের ইস্তানবুলে৷ জায়নাব ফাদিলিউগ্লু পেশায় একজন আর্কিটেক্ট৷ তিনি একটি মসজিদের স্থপতি হিসেবে কাজ করেছেন৷
প্রথমেই ইস্তানবুলের সাকিরিন মসজিদটির চত্বরে ঘুরে আসা যাক৷ বেশ কয়েক মাস আগে সাকিরিন মসজিদের উদ্বোধন করা হয়েছে৷ একটি তুর্কি-সৌদি পরিবার বাবা-মায়ের স্মৃতিচিহ্ন হিসেবে মসজিদটি তৈরির সিদ্ধান্ত নিয়েছিল এবং এরকম মসজিদ এই প্রজন্মের জন্য ছিল সত্যিই একটি চমক৷ এই মসজিদে চীন এবং ব্রিটেন থেকেও শিল্পীরা এসে কাজ করেছেন৷ তুরস্কে এই প্রথম কোন মহিলাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে একটি মসজিদ ডিজাইনের৷
তুরস্কের অন্যান্য মসজিদ থেকে এই মসজিদটি দেখতে আলাদা৷ এই মসজিদের গম্বুজ দেখলে মনে হবে বিশাল একটি গেলাস এ্যালুমিনিয়ামের চাদর দিয়ে ঢেকে দেয়া হয়েছে৷ নিত্য নতুন ডিজাইন বা উপাদান ব্যবহার করে নতুন আকার তৈরি করা জায়নাবের কাছে কোন ব্যাপারই না৷ স্থপতি হিসেবে ইতিমধ্যে তিনি দেশে বিদেশে সুনাম কুড়িয়েছেন৷ দুবাই, লন্ডন, মুম্বই – সব জায়াগাতেই তাঁকে কাজের জন্য যেতে হয়েছিল৷ কিন্তু মসজিদের জন্য কাজ করা জায়নাবের জন্য ছিল এক সুবর্ণ সুযোগ৷ প্রথমে তিনি বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলেন৷
‘‘খবরটি শুনেই আমি কেঁদেছিলাম৷ আমি বোধ হয় খুব সহজেই কাঁদি৷ আমার মনে হয় একজন মহিলা হওয়া সত্ত্বেও আমাকে এই দায়িত্ব দেয়া হয়েছে সেই আনন্দে আমি অভিভূত ছিলাম৷ বিশেষ করে এমন একটি সময় যখন ইসলাম ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা চলছে সর্বত্র৷ ইসলাম ধর্ম মেয়েদের কী করতে দেয় আর কী করতে দেয় না তা নিয়ে জোর সমালোচনা৷ ঠিক সেই সময়েই একজন মহিলাকে বলা হল – একটি মসজিদ তৈরি করো৷''
মসজিদের বিশেষত্ব
মসজিদের চত্বরে এবং ভেতরে অনেকাংশ জুড়ে রয়েছে ইস্পাত৷ সঙ্গে কাঁচের অসংখ্য ঝাড়বাতি৷ কাঁচের এই সুদৃশ্য ঝাড়বাতিগুলোই মূল আকর্ষণ৷ অনেকেই বলছে, নতুন ধরণের যুগোপযোগী ডিজাইন তৈরি করা হয়েছে৷ কিন্তু জায়নাব ফাদিলিউগ্লু বলেন, তুরস্কের মতই নতুন এবং পুরোনোর সংমিশ্রণে তৈরি করা হয়েছে এই মসজিদ৷
তিনি জানালেন, ‘‘আমরা যা কিছু ডিজাইন করি, সেটাই অত্যন্ত আধুনিক ধাঁচে করতে চাই৷ আর যাই হোক, আমরা চাই না সাধারণ মানুষ এখানে আসা বন্ধ করুক৷ আমরা চাই, এই মসজিদটি যেন সাধারণ মানুষদের দৈনন্দিন জীবনের একটি অংশ হয়ে ওঠে৷ শুধু দূর থেকে দেখে প্রশংসা করুক - সেটা আমি চাই না৷ তবে তারা দিনে পাঁচবার মসজিদে আসবে, নাকি সপ্তাহে একবার আসবে - সেটা সম্পূর্ণ তাদের ব্যাপার৷''
ইস্তানবুলের সবচেয়ে পুরোনো কবরস্থানের কাছে তৈরি করা হয়েছে মসজিদটি, শহরের সবচেয়ে রক্ষণশীল এলাকায়৷ যখনই কেউ মসজিদের পাশ দিয়ে হেঁটে যাবে, চোখে পড়বে স্থপতি হিসেবে বড় বড় অক্ষরে লেখা জায়নাব ফাদিলিউগ্লুর নাম৷ প্রকল্পের প্রধান তিনিই৷
পুরুষদের প্রতিক্রিয়া
একজন মহিলা একটি মসজিদ তৈরি করছে - সাধারণ মানুষরা সেটা কীভাবে দেখছে ? এক ভদ্রলোক জানালেন, সবার কাজ ভাগ করে দেয়া আছে৷ ইসলাম ধর্ম মেয়েদের সব ধরণের কাজ করার সুযোগ দিয়েছে, অনুমতি দিয়েছে৷ সমাজ জীবনে সব কিছুই পরিবর্তনশীল৷ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন উঠতে পারে, একজন মহিলা কেন মসজিদ তৈরি করতে পারবে না ? অবশ্যই পারবে৷
তবে সম্পূর্ণ বিপরীত ধর্মী কথা বললেন আরেক জন৷ তিনি বললেন, এটা সম্পূর্ণ অস্বাভাবিক৷ মসজিদ পুরুষদের জন্য, মহিলাদের জন্য নয়৷ মহিলাদের কাজ হচ্ছে, বাড়িতে থেকে বাচ্চাদের দেখাশোনা করা৷ পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা আছে - মসজিদে মহিলাদের কোন স্থান নেই৷ পুরুষদের কাজ মহিলাদের কাজ থেকে ভিন্ন৷ দুটিকে কখনোই এক হতে দেয়া উচিত নয়৷
এ ধরণের উত্তপ্ত বক্তব্য শোনার পর জায়নাব'এর প্রতিক্রিয়া কী রকম ? তিনি জানান, তাঁর সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিলেন তিনি নিজেই৷ জায়নাব বললেন, আমি বিশেষ কোন সমস্যার সম্মুখীন হইনি৷ আমি আমাকে নিয়েই চিন্তিত ছিলাম বেশি৷ যার কারণে প্রতিটি পদক্ষেপ আমাকে খুব সাবধানে নিতে হয়েছে৷
কিন্তু তিনি মনে করেন, একজন নারী বলেই তিনি এই বিশাল দায়িত্ব পেয়েছেন৷
প্রতিবেদক: মারিনা জোয়ারদার
সম্পাদক: অরুণ শঙ্কর চৌধুরী