ইস্টবেঙ্গলকে সুপার লিগে ফেরালেন যাঁরা
৪ সেপ্টেম্বর ২০২০পশ্চিমবঙ্গে বাঙালির কাছে ফুটবল মানেই মোহনবাগান ইস্টবেঙ্গল৷ চির প্রতিদ্বন্দ্বী দুই ফুটবল ক্লাবের মধ্যে সম্পর্কটা অনেকটা কার্টুনের টম অ্যান্ড জেরির মতো৷ বেড়াল আর ইঁদুরের মধ্যে যত ঝগড়াই থাক, একজনকে ছাড়া অন্যজনের স্রেফ চলে না৷ ভারতীয় ফুটবলে চালু হওয়া ইন্ডিয়ান সুপার লিগে এবার এমন পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল যে, মোহনবাগান খেলতে পারলেও ইস্টবেঙ্গল পারবে না৷ কারণ, অনেক চেষ্টা করেও শতাব্দী-প্রাচীন এই ক্লাব আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা জোগাড় করে উঠতে পারেনি৷ অবশেষে একেবারে শেষ মুহূর্তেই সমস্যার সমাধান হলো৷ বাঙুর শিল্পগোষ্ঠীর অধীনস্থ শ্রী সিমেন্ট এগিয়ে এসে দাঁড়ালো ইস্টবেঙ্গলের পাশে৷ পরমুহূর্ত থেকেই অবশ্য শুরু হয়ে গেছে মোহনবাগানিদের ব্যঙ্গ-বিদ্রুপ যে, অবশেষে ভিক্ষের ঝুলিতে কেউ দু'মুঠো খুচরো পয়সা দিলো৷ কেউ বলছে, বিশ্রী ইস্টবেঙ্গল এবার শ্রী সিমেন্টের দাক্ষিণ্যে হলো শ্রী ইস্টবেঙ্গল৷ নামের পর পদবি হিসেবে এখন থেকে বাঙুর লেখা হবে কিনা, সেই নিয়েও ঠাট্টা–তামাসা চলছে৷ কিন্তু যে যা-ই বলুক, লিগ ফুটবলের এই চাপান উতোর, এই উত্তেজনা ইস্টবেঙ্গলের বিহনে যে এবার মাঠে মারা যেতে বসেছিল, সেকথাও মনে মনে অনেকেই স্বীকার করছেন৷
ইস্টবেঙ্গলের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা পাওয়া নিয়ে অনিশ্চিয়তা এবং শেষে সমস্যার সমাধানের গোটা প্রক্রিয়াটা খুব কাছ থেকে দেখেছেন ক্রীড়া সাংবাদিক অনিলাভ চট্টোপাধ্যায়৷ তিনি জানাচ্ছেন, মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি খুব চেষ্টা করছিলেন অবশ্যই, কিন্তু আরো একজন উদ্যোগী হয়েছিলেন৷ তিনি এখনকার ভারতীয় ক্রিকেট কন্ট্রোল বোর্ডের সভাপতি, জাতীয় ক্রিকেট দলের প্রাক্তন অধিনায়ক সৌরভ গাঙ্গুলি৷ দক্ষ ক্রিকেট প্রশাসক হিসেবে অল্প দিনেই সুনাম অর্জন করা সৌরভ ইন্ডিয়ান সুপার লিগের যারা মূল উদ্যোক্তা, সেই ফুটবল স্পোর্টস ডেভলপমেন্ট লিমিটেড এবং বাণিজ্যিক গোষ্ঠীগুলির মধ্যে গাঁটছড়া বেঁধে দেওয়ার কাজটা করে দিয়েছেন৷ ডয়চে ভেলে–কে অনিলাভ জানালেন, ‘‘এফএসডিএল যারা চালায়, তাদের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের অফিশিয়ালদের একটা কোথাও মানসিক দূরত্ব তৈরি হয়েছিল৷ যেটা তৈরি হয়েছিল এফএসডিএল যখন ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে এটিকে-র মার্জার করাতে আসে আর কী৷ মানে এফএসডিএল-এর থেকেই উদ্যোগটা নেওয়া হয়েছিল, যাতে এটিকের সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের একটা মার্জার হয়৷ যাতে এটিকে–ও থাকে৷ এটিকের থাকাটা জরুরি এই কারণে ছিল, আইএসএল যখন একটা কনসেপ্ট মাত্র, তখন থেকেই (এটিকের মালিক, শিল্পপতি) সঞ্জীব গোয়েঙ্কা ইনভেস্ট করে আসছেন৷ তার ওপর (এটিকে) তিন বারের চ্যাম্পিয়ন৷ ছ'বারের লিগে, তিন বারের চ্যাম্পিয়ন৷ কাজেই ওদের অর্গানাইজেশন বা গোয়েঙ্কাদের হারাতে চায়নি এফএসডিএল৷ (তারা) একই সঙ্গে ইস্টবেঙ্গল, মোহনবাগানকেও চাইছিল এই লিগে৷ তো এটিকের সঙ্গে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল ইস্টবেঙ্গলকে৷ সেখানে ব্যাপারটা খুব একটা ভালো দিকে যায়নি৷ আলোচনার মধ্যে এমন কিছু একটা হয়েছিল, যেখান থেকে একটা দূরত্ব তৈরি হয়েছিল৷’’
অনিলাভ জানাচ্ছেন, যে কারণে খোদ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি আন্তরিকভাবে উদ্যোগী হলেও এফএসডিএল-এর সঙ্গে ইস্টবেঙ্গলের দূরত্ব কমছিল না৷ এই অচলাবস্থার মধ্যেই একদিন সৌরভ গাঙ্গুলির সঙ্গে কথা হয় ইস্টবেঙ্গল ক্লাব কর্তাদের৷ তারপরই জটিলতা দূর করতে উদ্যোগী হন সৌরভ৷ তিনি প্রথম টেক্সট মেসেজ করেন শিল্পপতি মুকেশ আম্বানির ছেলে আকাশকে, যিনি আম্বানি গোষ্ঠীর মালিকানায় থাকা ‘মুম্বই ইন্ডিয়ানস্’ ক্রিকেট দল থেকে শুরু করে খেলার মাঠে আম্বানিদের একাধিক বাণিজ্যিক উদ্যোগের দায়িত্বে আছেন৷ আকাশ কথা বলেন তাঁর মা নীতা আম্বানির সঙ্গে, যিনি নিজেও খেলার ব্যাপারে খুবই উৎসাহী৷ এই সময় মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জিও সরাসরি কথা বলেন মুকেশ আম্বানির সঙ্গে৷ আম্বানিরাও শেষ পর্যন্ত খুঁজে দেন বাঙুর শিল্পগোষ্ঠীকে, যারা ইস্টবেঙ্গলের আর্থিক পৃষ্ঠপোষকতা করতে রাজি হলো৷
এখানেও সৌরভ গাঙ্গুলি একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নিয়েছিলেন৷ তার আগে তিনি আকাশ আম্বানিকে বলেছিলেন, তিনি নিজে দায়িত্ব নিচ্ছেন সমঝোতা করানোর, কিন্তু ইন্ডিয়ান সুপার লিগে ইস্টবেঙ্গলের থাকা দরকার৷ কলকাতায় তা হলে মাঠের গ্যালারি ভর্তি রাখার জন্য ভাবতে হবে না৷ একই আশ্বাস তিনি এফএসডিএলকেও দেন৷ অনিলাভ চট্টোপাধ্যায় বললেন, ‘‘সৌরভ তাদেরও বোঝায় যে, ইস্টবেঙ্গলের সঙ্গে ডিল করার ক্ষেত্রে প্রবলেম হবে না৷ একটা ভালো স্পন্সর, একটা ভালো ইনভেস্টর যদি এসে যায়, ব্যাপারটা অনেক প্রফেশনালি ডিল করা হবে৷ যে প্রবলেমগুলো আপনাদের হতো, সেগুলো আর হবে না৷ এবং দরকার হলে আমি মাঝখানে থেকে আপনাদের মধ্যে (সমস্যা)ঠিক করে দেবো৷ আমি কথা দিচ্ছি, এরকম কোনো সমস্যা আগামীদিনে হবে না৷’’
বস্তুত তারপর থেকেই বল গড়িয়েছে এবং এবারের ইন্ডিয়ান সুপার লিগে নাম লেখাতে চলেছে ইস্টবেঙ্গল৷ নতুন করে উজ্জীবিত ফুটবল-প্রেমিকরা৷