ইন্টারনেট, যৌন হয়রানি ও কলকাতার সংস্কৃতিচর্চা
২৪ অক্টোবর ২০১৯কিছুদিন আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভাইরাল হয় দু'টি নারীর কথা৷ তাদের মতে, নাট্য পরিচালক ও অধ্যাপক সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় নাটকের মহড়ার অছিলায় অশালীন আচরণ করেন তাদের সাথে৷ উত্তরে একটি সংবাদসংস্থাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সুদীপ্ত জানান, যে যা ঘটেছিল তা সম্মতিবহির্ভূত ছিল না৷ এবং আসলেই এই আচরণ একটি বিশেষ ধরনের অভিনয়-পন্থা৷ সুদীপ্ত আরো বলেন যে এই বিশেষ পন্থা তিনি শিখেছিলেন তার নাট্যগুরু প্রখ্যাত অভিনেতা অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছে৷ অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দীর্ঘদিনের নাট্যসঙ্গী ও শিষ্যা মায়া ঘোষ যদিও এমন পন্থার সত্যতা নাকচ করে দেন৷ একই মত অজিতেশের অন্যান্য সঙ্গীদেরও৷ শেষ পাওয়া খবর, সুদীপ্তকে একটি এফআইআরের ভিত্তিতে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ বর্তমানে তিনি পুলিশি হেফাজতে রয়েছেন৷
দ্বিতীয় ঘটনাটির কেন্দ্রে বিখ্যাত বাংলা ব্যান্ড ‘মহীনের ঘোড়াগুলি'র প্রতিষ্ঠাতা সদস্য রঞ্জন ঘোষালের নাম৷ ১৬ বছর বয়েসি এক কিশোরী ফেসবুক মেসেঞ্জারে তার পাঠানো অশালীন মেসেজের স্ক্রিনশট সম্প্রতি প্রকাশ করেন সোশাল মিডিয়ায়৷ এরপর নতুন করে আলোচনায় উঠে আসে ১৫ বছর আগে রঞ্জন ঘোষালের বিরুদ্ধে ওঠা আরেকটি অভিযোগ৷ প্রথম অভিযোগকারিণী দেবলীনা মুখোপাধ্যায়, যিনি ঘটনাচক্রে লেখক শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের কন্যা৷ দেবলীনা জানান যে রঞ্জনের সাথে দীর্ঘ পারিবারিক বন্ধুতা ছিল তাদের, এমনকি রঞ্জনকে ‘কাকু' সম্বোধন করতেন তিনি৷ ২০০৪ সালে এই ঘটনার প্রেক্ষিতে আদালতের দ্বারস্থও হয়েছিলেন তিনি৷ আনন্দবাজার পত্রিকাকে বলেন তিনি, ‘‘ সেই সময় তো সোশ্যাল মিডিয়া ছিল না৷ কাউকে পাশে পাইনি৷ আমার চেনা এক জনের সঙ্গেও এমনটা করেছিলেন উনি৷
তিনিও চেপে যান৷ রঞ্জনকাকুর পরিবার ভেঙে যাবে, এমনটাই বোঝানো হয়েছিল আমাকে৷'' সরকারি আইনজীবী বনাম রঞ্জনের নামী আইনজীবীর সঙ্গে পেরে ওঠেননি তিনি৷ এবং পরে মামলা তুলে নিতেও বাধ্য হন৷ যদিও রঞ্জন ঘোষালকে লিখিত ক্ষমা চাইতে হয়েছিল সেই সময়৷ ১৬ বছর বয়েসি কিশোরীর পোস্ট ছড়িয়ে পড়ার পরই ফেসবুকে এই ঘটনার পুনরাবৃত্তি করেন দেবলীনা৷ তাঁর মতে, রঞ্জন একজন ‘সিরিয়াল অফেন্ডার'৷
কিন্তু সুদীপ্তর মতো অভিযোগ অস্বীকার করেননি রঞ্জন৷ ফেসবুকেই একটি পোস্টে তিনি লেখেন, ‘‘আমি জানি আমার কথায় এবং আচরণে কারুর কারুর ব্যক্তিগত সীমারেখা (personal space) লঙ্ঘন করেছি, আমি এখন তার জন্য অনুতপ্ত ও নিঃশর্তে ক্ষমাপ্রার্থী৷ আমার নিজেকে শোধরাতে হবে৷ কেউ যেন কখনো আমার সান্নিধ্যে এসে নিরাপত্তাহীনতা বোধ না করে, সে বিষয়ে এখন থেকে বিশেষভাবে যত্নবান থাকব৷''
কিন্তু আসলেই কি রঞ্জন বা সুদীপ্তর আচরণের মধ্যে কোনো নীতিগত পার্থক্য রয়েছে? নাকি দুই ক্ষেত্রেই কাজ করছে সমকালীন সমাজের কিছু নির্দিষ্ট ধারা বা ট্রেন্ড?
এবারে কি কি শিখলো কলকাতা?
রঞ্জন ঘোষাল ও সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় দুজনেই সমাজের শিক্ষিত, উচ্চবিত্ত বা উচ্চ মধ্যবিত্ত অংশের মানুষ৷ দুজনেই বাংলার সাংস্কৃতিক জগতের অঙ্গ হয়ে কাজ করেছেন কয়েক দশক ধরে৷ সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায়ের সাথে পড়াশোনার খাতিরে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে বলতে পারি, নারী স্বাধীনতা, সামাজিক কাঠামো ও বাংলায় যৌনাচারণের পরিমিতি সম্পর্কে তিনি জনসাধারনের চেয়ে বেশ অনেকটাই বেশি অ্যাকাডেমিক জ্ঞান রাখেন৷ শুধু তাই নয়, তার গোটা কেরিয়ারের সাথে যেভাবে একাত্ম হয়েছে রিচার্ড শেখনার বা জাক দেরিদার মতো ‘মুক্তমনা' স্কলারদের নাম৷
তারপরেও কেন এমন অভিযোগ? এই অভিযোগের ধারা কি আসলেই বিচ্ছিন্ন ঘটনা? নাকি সংস্কৃতি জগতের ভেতরে প্রচলিত কোনো ট্রেন্ডের বহিপ্রকাশ?
এখানে আসলে কাজ করছে খুব সহজ দু'টি বিষয়৷ প্রথম, বর্তমানে সংস্কৃতির পরিসর ও ‘অবাধ' যৌনাচারের মধ্যে রয়েছে একটি সমান্তরাল যোগসূত্র, তা যতই জাঁদরেল ব্যক্তিত্বরা বিষয়টি এড়িয়ে যান না কেন৷ ভারতে, এমনকি বাংলাতেও, ‘কাস্টিং কাউচ' নামের একটি প্রথা প্রচলিত আছে, যেখানে যৌন আনুকূল্যকে বেশ বহু বছর ধরেই পরিণত করা হয়েছে একটি স্বাভাবিক বাস্তবিকতায়৷ ফলে, ‘কাজ পেতে গেলে বা কাজ শিখতে গেলে কিছু কিছু যৌন ইঙ্গিতকে প্রশ্রয় দিতেই হবে', এই ধারণা বাস্তবে পুরোপুরি ফেলনা নয় মোটেই৷ সংস্কৃতি জগতকে যদি পুরোদস্তুর পেশাদারিত্বের জায়গায় নিয়ে যেতে হয়, তবে অন্যান্য কর্মক্ষেত্রের মতো সেখানেও নিশ্চিত করতে হবে কিছু সীমারেখা৷ প্রয়োজনে আনতে হবে ‘বিশাখা গাইডলাইনস'র মতো নির্দিষ্ট আইনও৷
দ্বিতীয়ত, সোশাল মিডিয়া ও পরবর্তীতে মিডিয়া ট্রায়ালের রীতি গত কয়েক বছরে বর্তমান জীবনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে উঠেছে৷ ফলে, অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ, ক্ষমা প্রার্থনা বা বিচারকার্যও হয়ে পড়েছে আন্তর্জালনির্ভর, যা আরো বেশি করে চোখে আঙুল দিয়ে বুঝিয়ে দেয় যে, অভিযোগ তোলা বা দায় এড়ানো কোনোটাই এখন আর আইননির্ভর নয়৷ যৌন হয়রানির মতো গুরুতর অভিযোগের উত্তরে দুই-এক মাসের জন্য ফেসবুক প্রোফাইল ‘ডিএক্টিভেট' করে দেওয়াই এখন দ্রুত সমাধান৷ বা নিদেনপক্ষে এক-দুটো ক্ষমাপ্রার্থী স্ট্যাটাস, ব্যস৷
হয়তো ২০০৪ সালে সোশাল মিডিয়ার এত জোর ছিলনা বলেই রঞ্জন ঘোষাল সেই যাত্রায় আইনী মারপ্যাঁচে পড়তে বাধ্য হয়েছিলেন, যা এইবারের মতো তার কপালে নেই এখন পর্যন্ত৷ ফেসবুকে ক্ষমা চাওয়া হয়ে গেছে তার৷ উল্টোদিকে, অন্য অভিযোগকারিণী আইনের ওপর আস্থা রেখেছিল বলেই হয়ত সুদীপ্ত চট্টোপাধ্যায় আজ কারাবন্দি৷
আমার মতে, কলকাতায় এই দ্বিতীয় দফার ‘মিটু' ঝড় থেকে উঠুক দু'টি দাবি৷ এক, সংস্কৃতি জগতের আনাচে কানাচে গজিয়ে ওঠা এই ‘কাস্টিং কাউচ' ও সীমালঙ্ঘনের প্রতি সহনশীলতা অবিলম্বে বন্ধ হোক৷ বন্ধ হোক অল্পবয়েসি সংস্কৃতিকর্মীদের অসহায়ত্ব ও আর্থিক দুর্বলতার সুযোগে তাদের হেনস্থার স্বাভাবিকীকরণ৷ দুই, ফেসবুকে লেখা হোক হয়রানির জবানবন্দি, কিন্তু আইনের সাথে এক পর্যায়ে তাকে না রেখে৷ যৌন হয়রানিকে মোকাবিলা করতে আইনই হোক মূল হাতিয়ার, দিনে ১৫০ রুপিতে হাতের মুঠোয় পাওয়া এক জিবি ইন্টারনেট নয়৷