ইতিহাস শেখায় দেশপ্রেম
২০ মে ২০১৬আমার ছোট্ট মেয়ে নীলিমা এখন সতের৷ কলেজ শেষ করে প্যারিস ইউনিভার্সিটিতে ভাষা সাহিত্য ও ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করবে তারই প্রস্তুতি নিচ্ছে সে এখন৷ সম্প্রতি ওর সাথে বিশ্বের চলমান ঘটনা ও মানবধিকার নিয়ে তুখোর আলোচনা চলছিল আমার৷ এক পর্যায়ে নীলিমা জিজ্ঞেস করে, ‘‘আচ্ছা পাপা, কোনো ঘটনা ঘটে যাওয়ার কত দিন পরে ইতিহাসে স্থান পায়, একবছর, দশবছর, একশ’বছর পরে?'' তাৎক্ষণিক কোনো উত্তর দিতে পারিনি৷ তাই বলে উঠি, ‘‘আমার সাথে নাৎসিদের কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ‘সাক্সেনহাউজেন' দেখতে যাবি? সেখানেই পাবি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ইতিহাসের বিভৎস নরহত্যার সন্ধান৷'' নীলিমা রাজি হয়ে গেল৷ পরদিনই আমরা বেরিয়ে পড়লাম বার্লিন থেকে ৫০ কিলোমিটার দূরের সেই বিভৎস নাৎসি জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্পের উদ্দেশ্যে৷
সাক্সেনহাউজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্প ১৯৩৬ সনের জুলাই মাসে তৈরি হয় বার্লিনের উত্তরে ওরানিয়েনবুর্গে, নাৎসি পুলিশ প্রধান হাইনরিশ হিমলারের নিজস্ব উদ্যোগে৷ বার্লিন থেকে দূরত্ব বেশি না হওয়ায় নাৎসি বাহিনীর সর্বোচ্চ নজরদারিতে ছিল এই ক্যাম্পটি৷ ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত ৯ বছরে শুধু এই সাক্সেনহাউজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পেই দুই লক্ষ মানুষকে হত্যা করে নাৎসি বাহিনী৷ যাদেরকে হত্যা করে তাদের মাঝে ইহুদি ছাড়াও রোমা, সিন্টি, জিপসি, সমকামী এমনকি কমিউনিস্ট জার্মানরাও ছিল৷ এছাড়া প্রায় ১৩ হাজার যুদ্ধবন্দি সোভিয়েত সৈন্যও ছিল৷ তাদেরকেও গ্যাস চেম্বারে হত্যা করে পুড়িয়ে ফেলা হয়৷
৪০০ হেক্টর এলাকা জুড়ে এই সাক্সেনহাউজেন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি পৃথিবীর সকল মানুষের জন্য এখন উন্মুক্ত এক বিশাল জাদুঘর৷ প্রায় ৬ ঘণ্টা ধরে কনসেনট্রেশন ক্যাম্পটি পরিদর্শন করেও পুরো শেষ করতে পারিনি৷ একসময় নীলিমা বলছিল, ‘‘কাঠের তৈরি শতাধিক ছোট ছোট ব্যারাকে বন্দিরা থাকত, যার উচ্চতা ২.৫ মিটার, চওড়া ৪ মিটার আর ৫৪ মিটার দীর্ঘ৷ একেকটি ব্যারাকে ৪০ জন বন্দি শুধু রাতে ঘুমাত৷ সারাদিন তাদের ব্যারাকের বাইরে বন্দি শিবিরে কাজ করতে হতো৷ তাই তো ক্যাম্পটির মূল ফটকে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল, ‘‘কাজই তোমাদের মুক্ত করে৷''
আর অপেক্ষাকৃত কর্মঠ বন্দিদের প্রধান কাজ ছিল গ্যাস চেম্বারে মেরে ফেলা হাজার হাজার মানুষের লাশ মরা পোড়াবার চুল্লিতে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা৷ বন্দিদের মাঝে অনেক ডাক্তারও ছিল৷ তাঁরা বন্দিদের নিয়ে বিশেষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাত৷ তাই এক ফলকে লেখা ‘‘এখানে এক বাভেরিয়ান ডাক্তার বন্দি ১০৫ জন শিশুর উপর পরীক্ষা চালায়৷''
বর্তমান গণতান্ত্রিক জার্মান সরকার নাৎসিদের নিগ্রহের কাহিনি ও তার দলিল তথ্য উপস্থাপন করেছে৷ তাই হাজার হাজার মানুষ এই গণহত্যার কাহিনি অনুধাবন করার জন্য এই কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে আসেন৷ স্কুল-কলেজের ছাত্র-ছাত্রীই বেশি চোখে পড়ল৷ দেখলাম, একদল স্কুল ছাত্র-ছাত্রী নরওয়ে থেকে একদিনের সফরে এসেছে৷ এই যুব সমাজ ইউরোপের ইতিহাস জানতে আর উপলব্ধি করতে অত্যন্ত আগ্রহী৷ মনে মনে শুধু ভাবলাম, আমরা কবে পারব আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যুবসমাজের জন্য তথ্যসমৃদ্ধভাবে জাদুঘরে সাজাতে!
১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১ আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ শেষ হয়েছে৷ কিন্তু মুক্তির সংগ্রাম একটি চলমান যুদ্ধ৷ তাই যখন স্বাধীনতা বিরোধীরা ও যুদ্ধাপরাধীরা সুযোগ পেলেই মুক্তিযুদ্ধকে অস্বীকার করার ধৃষ্টতা দেখায় ও মুক্তিযুদ্ধে শহিদের সংখ্যা ৩০ লক্ষ থেকে কমিয়ে দেখাবার চেষ্টা করে তখন মুক্তি সংগ্রামের প্রকৃত ইতিহাস আমাদের দরকার৷ এখনো মুক্তি পায়নি আমাদের গণতন্ত্র, এখনো সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, ধর্মীয় গোড়ামিমুক্ত হয়নি বাংলাদেশ৷ এখনো মুক্তির লক্ষ্যেই যুদ্ধ চলছে মুক্তমনা মানুষদের৷ সেজন্যই মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে আরো ‘নিরপেক্ষ চর্চা' প্রয়োজন৷
নীলিমা প্রশ্ন করলো, ‘‘আচ্ছা পাপা গণহত্যাই কি হলোকস্ট?'' বললাম, ‘‘হ্যাঁ, হলোকস্ট হলো ব্যাপক হত্যাকাণ্ড৷'' জাতিসংঘের গণহত্যাবিষয়ক কনভেনশনে গণহত্যার সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, কোনো জাতি, নৃগোষ্ঠী বা ধর্মীয় সম্প্রদায়কে পুরোপুরি বা আংশিক নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে যে হত্যাকাণ্ড সম্পাদিত হয়, তা-ই গণহত্যা৷ যেমনটি ঘটেছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে৷ ১৯৩৩ থেকে ১৯৪৫ পর্যন্ত নাৎসি বাহিনী সারা ইউরোপে ৬০ লক্ষ ইহুদি, রোমা, সিন্টি, জিপসি ও সমকামী হত্যা করেছিল৷ ১৯১৫ থেকে ১৯১৭ সালের মধ্যে তুরস্কের অটোমান সম্রাট ১৫ লক্ষ আর্মেনীয় হত্যা করেছিল, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে মাত্র ৯ মাসে ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছি পাকিস্তানি স্বৈর সরকার৷ '৭১-এর হলোকস্টের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল বাঙালি জাতিকে সমূলে উৎপাটন করা৷
মোনাজ হক, প্রকৌশলী ও ইউরো এশিয়া টুডের সম্পাদক