বিচ্ছিন্নতাবাদ
২ ডিসেম্বর ২০১২জাতীয় ফুটবল দল জিতলে স্টেডিয়ামে জাতীয় সংগীত বাজানো হয়৷ কিন্তু স্পেনের জাতীয় সংগীতে যে শুধুই সুর রয়েছে, কথা নেই! অতএব সবাই ‘লা-লা-লা' করে সুরে সুর মেলানোর চেষ্টা করে৷ গানের কথা থাকলে তা কোন ভাষায় হতো? স্প্যানিশ তো স্পেনের একমাত্র ভাষা নয়৷ রয়েছে কাটালান ও বাস্কের মতো একেবারে আলাদা ভাষাও৷
ক্যাটালোনিয়া রাজ্য স্পেনের সবচেয়ে শিল্পোন্নত অঞ্চল বলে পরিচিত৷ গোটা দেশে আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যেও এই রাজ্যের সাফল্য তুলে ধরার মতো৷ কিন্তু কাটালানদের কাছে সেই সাফল্যও কাল হয়েছে৷ তাদের অভিযোগ, ফেডারেল কাঠামোয় তাদের কাছ থেকে মাদ্রিদ যে অর্থ আদায় করে, তা দিতে গিয়ে ক্ষতি হচ্ছে ক্যাটালোনিয়া রাজ্যের৷ এই অবস্থায় রক্ষণশীল-বিচ্ছিন্নতাবাদী শিবিরের মুখ্যমন্ত্রী আর্তুর মাস আগাম নির্বাচন ডেকে জনগণের রায় নিয়েছেন৷ তাঁর আশা ছিলো, বাড়তি ক্ষমতা নিয়ে তিনি স্পেন থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পথে আরও এগিয়ে যাবেন৷ কিন্তু নির্বাচনে তাঁর দল উল্টে ১২টি আসন হারিয়েছে৷
মিউনিখ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজনীতি বিভাগের অধ্যাপক ব্যার্টল্ড রিটব্যার্গার ইউরোপের আঞ্চলিক কাঠামোর ক্ষেত্রে একজন বিশেষজ্ঞ৷ ক্যাটালোনিয়ার বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই নির্বাচনে স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে যে বিচ্ছিন্নতাবাদের অ্যাজেন্ডা সামনে রেখে অবশ্যই ভোট পাওয়া যায়৷ তবে তার অর্থ এই নয় যে ভোটাররা শুধু এই বিষয়টিকেই অগ্রাধিকার দিচ্ছেন৷
ক্যাটালোনিয়ার বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রয়াসে অবশ্য শুধু রক্ষণশীল দল একাই সামিল হচ্ছে না৷ একটি আঞ্চলিক বামপন্থী দলও একই অ্যাজেন্ডা সামনে রেখে নিজেদের আসনসংখ্যা প্রায় দ্বিগুণ করে নিয়েছে৷ এই অবস্থায় ক্ষমতাসীন দলের নেতা ও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী গণভোটের মাধ্যমে রাজ্যের জনগণের রায় নিতে চান৷ মানুষ চাইলে স্পেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করার পথে এগোবে ক্যাটালোনিয়া৷
ইউরোপের ইতিহাসে রাষ্ট্রের ভাঙাগড়া বা মানচিত্র পরিবর্তন কোনো নতুন ঘটনা নয়৷ অনেক ক্ষেত্রেই আজকের ইউরোপের সঙ্গে অতীতের কাঠামোর কোনো মিলই নেই৷ তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর সেই মাত্রার পরিবর্তন আর দেখা যায় নি৷ ফলে ক্যাটালোনিয়া সত্যি স্বাধীন হলে তা হবে বিরল এক ঘটনা৷ ১৯৯৩ সালে চেকোস্লোভাকিয়া ভেঙে যখন চেক ও স্লোভাক প্রজাতন্ত্রের জন্ম হয়েছিল, তখন দুই পক্ষেরই সায় ছিল৷ শান্তিপূর্ণভাবেই সেই বিভাজন ঘটেছে৷ ইয়ুগোস্লাভিয়া যখন ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যায়, তখন দেশের মধ্যে প্রতিটি প্রজাতন্ত্রে গণভোটের আয়োজন করা হয়েছিল৷ তারপর যুদ্ধও বেঁধে যায়৷ তারপর ২০০৮ সালে সার্বিয়া প্রজাতন্ত্র ভেঙে স্বাধীনতার ঘোষণা করে কসোভো৷ আজও বিষয়টির চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হয় নি৷
এই প্রেক্ষাপটে প্রশ্ন উঠতে পারে, ইউরোপে বিচ্ছিন্নতাবাদের পেছনে মূল কারণ কী? প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিভিন্ন কারণ কাজ করছে৷ ভাষাগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের ভিত্তিতে মূল রাষ্ট্র থেকে আলাদা হয়ে যাওয়ার একটা প্রবণতা প্রায়ই দেখা যায়৷ তাছাড়া স্বাধীনতা বা স্বায়ত্ত্বশাসনের আকাঙ্ক্ষার ক্ষেত্রে অর্থনৈতিক কারণও বড় হয়ে ওঠে৷ সেই সব অঞ্চলই বাকি দেশ থেকে বিচ্ছিন্ন হতে চায়, যাদের অর্থনৈতিক ক্ষমতা বাকিদের তুলনায় বেশি৷ স্পেনের ক্যাটালোনিয়া, ইটালির দক্ষিণ টিরোল রাজ্য, বেলজিয়ামের ফ্ল্যান্ডার্স অঞ্চল – এদের সবার অভিযোগ, দেশের বাকি দুর্বল অংশ তাদের আর্থিক ও অর্থনৈতিক ক্ষমতার উপর নির্ভর করে রয়েছে৷ তাদের অর্থই ভরতুকি হিসেবে চলে যাচ্ছে অন্যান্য অঞ্চলে৷ বিশেষ করে বর্তমানে ইউরোপ জুড়ে আর্থিক ও অর্থনৈতিক সংকটের সময় আরও কড়া সুরে এই অভিযোগের কথা শোনা যাচ্ছে৷ ফলে মাথা চাড়া দিচ্ছে উগ্র জাতীয়তাবাদ৷ তবে ইউরোপীয় ইউনিয়নের ছত্রছায়া ছেড়ে তারা কেউ চলে যেতে চায় না৷ ক্যাটালোনিয়া, দক্ষিণ টিরোল বা ফ্ল্যান্ডার্স স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ইইউ'র সদস্য থেকে যেতে আগ্রহী৷
শুধু স্কটল্যান্ডে ভিন্ন এক প্রবণতা লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ এই অঞ্চল মোটেই অর্থনৈতিকভাবে তেমন উন্নত নয়৷ তা সত্ত্বেও ব্রিটেন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে উঠতে চায় এই অঞ্চল৷ এমনটা করলে তাদের নিজস্ব বাজেটের জন্য যথেষ্ট অর্থ থাকবে কি না, তা নিয়েও সংশয় রয়েছে৷ ২০১৪ সালে এই প্রশ্নে এক গণভোট আয়োজন করা হবে৷ তবে বর্তমান জনমত সমীক্ষা অনুযায়ী স্কটল্যান্ডের মাত্র এক তৃতীয়াংশ মানুষ স্বাধীনতার পক্ষে৷ স্কটল্যান্ড ও ক্যাটালোনিয়ার নিজস্ব ফুটবল টিম রয়েছে৷ রয়েছে নিজস্ব জাতীয় সংগীতও৷