আস্থার ঘাটতি পূরণ
২৭ জুন ২০১৪ঐতিহাসিক বন্ধনে আবদ্ধ ভারত ও বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে আস্থার ঘাটতি রাতারাতি দেখা দেয়নি৷ এই দশকের একেবারে গোড়ার দিকে ভারতের সীমান্ত সংলগ্ন বাংলাদেশের মাটি যখন হরকত-উল-জিহাদ সংক্ষেপে হুজি এবং ইউনাইটেড লিবারেশন ফ্রন্ট অফ আসাম সংক্ষেপে উলফার ভারত-বিরোধী জঙ্গি তৎপরতার বড় আখড়া হয়ে ওঠে, তখন তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে দিল্লির ক্রমাগত চাপে কান দেয়নি তৎকালীন বিএনপি সরকার৷ বরং বিএনপি নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার সঙ্গে হাত মিলিয়ে জামাতের ভারত-বিরোধিতা ওঠে তুঙ্গে৷ দু'দেশের সীমান্ত বাহিনীর মধ্যে গুলি বিনিময় নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে দাঁড়ায়৷ চলতে থাকে ‘অবৈধ বাংলাদেশিদের অবাধ অনুপ্রবেশ'৷ সংখ্যাটা দাঁড়ায় প্রায় ১২ লাখের মতো৷ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা পড়ে চাপের মুখে, বিশেষ করে আসাম ও ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলি৷ বলা বাহুল্য, ঢাকার ওপর দিল্লির অটুট আস্থায় টান পড়তে থাকে৷
চিত্রপটটা পাল্টে যায় ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর৷ হাসিনা সরকার কড়া হাতে ভারত-বিরোধী জঙ্গি শিবিরগুলি উৎখাত করে৷ ২৫ জন ‘মোস্ট-ওয়ান্টেড' জঙ্গিকে তুলে দেয় ভারতের হাতে৷ জঙ্গিদের সঙ্গে যারা হাত মিলিয়েছিল, হাসিনা রেহাই দেননি তাদেরও৷ যেমন উলফা জঙ্গি নেতা পরেশ বড়ুয়া এবং এ বছরের জানুয়ারি মাসে দু'জন বাংলাদেশি মন্ত্রীসহ ১৩ জনকে দোষী সাব্যস্ত করে বাংলাদেশের আদালত৷ ভারত-বাংলাদেশের ৪,০০০ কিলোমিটার সীমান্তে ফিরে আসে শান্তির আবহ৷ নিয়মিত চলে সীমান্ত বাহিনীর ফ্ল্যাগ মিটিং৷ খোলা হয় সীমান্ত হাট৷
এত সব হওয়ার পরেও কিন্তু দ্বিপাক্ষিক জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট দুটি প্রধান ইস্যু – তিস্তা নদীর জলবণ্টন সমঝোতা এবং ১৯৭৪ সালে স্বাক্ষরিত ইন্দিরা-মুজিব স্থলসীমা বা ছিটমহল হস্তান্তর চুক্তি মনমোহন সিং-এর ১০ বছরের শাসনকালে দিনের আলো দেখতে পায় না৷ এটা হাসিনা সরকারও মেনে নিতে পারে না৷ শুধু তাই নয়, তথাকথিত ভারত-তোষণ নীতিতে হাসিনা সরকারকে পড়তে হয় বিরোধী দলগুলির সমালোচনার মুখে৷ বাংলাদেশের জনমানসেও পড়ে এর বিরূপ ছায়া৷
মনমোহন সিং-এর সদিচ্ছার হয়ত অভাব ছিল না৷ কিন্তু জোট-ধর্ম পালনে এবং সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠতার অভাবে মনমোহন সিং সরকার নীরব থাকতে বাধ্য হয়৷ তখন সেই কাজে বিরোধীতা করতে পিছু পা হয়নি আজকের বিজেপি সরকার৷ ভোটের সময় ‘অবৈধ অনুপ্রবেশকারী বাংলাদেশিদের' ফেরত পাঠানোর জিগির ছিল বিজেপির৷ কিন্তু কথায় আছে, প্রয়োজন বড় বালাই৷ সেটা মাথায় রেখে ক্ষমতা গ্রহণের পর মোদী সরকার তার বিদেশ নীতিতে বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্ব দিতে চলেছে, যাতে প্রতিবেশী দেশে আর বৈরিতা মাথা না তোলে৷ কারণ বৈরিতা বাড়ার পরিণামে ভারতের ভূ-রাজনৈতিক গুরুত্ব মার খাবে৷ আর সেই স্থান দখল করছে এবং করবে চীন৷ উল্লেখ্য, জুন মাসে শেখ হাসিনা বেজিং সফরে গিয়ে চট্টগ্রামে বিশেষ অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ অঞ্চল স্থাপনের সমঝোতা চুক্তিপত্র সই করে এসেছেন৷ এই সবই হচ্ছে ভারতের প্রতি বাংলাদেশের আস্থার ঘাটতির ফলে৷
ভারত যদিও বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ বাণিজ্যিক অংশীদার, কিন্তু দিল্লি তার সবটুকু বাণিজ্যিক সম্ভাবনা কাজে না লাগানোয় বাংলাদেশে একটা পুঞ্জীভূত ক্ষোভ লক্ষ্য করা যাচ্ছে৷ সেটা মোদী সরকারকে দূর করতে হবে৷ তাছাড়া বাংলাদেশের সঙ্গে সহযোগিতা না বাড়ালে ভারতের ‘পুবে-তাকাও নীতি' হোঁচট খাবে৷ যেহেতু দুটি ইস্যুই পশ্চিমবঙ্গ সংশ্লিষ্ট, তাই যেভাবেই হোক পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিতেই হবে৷ তাঁকে যেন-তেন প্রকারেণ রাজি করাতেই হবে৷
তাই তো, ঢাকার বিমান ধরার আগে সুষমা স্বরাজ তাঁর আলোচ্যসূচি নিয়ে মমতার সঙ্গে ফোনে এক দফা কথা বলেছেন৷ মোট কথা, ভারতের প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনতে সুষমা স্বরাজকে যা করতে হবে, তা হলো, তিস্তা ও স্থলসীমা চুক্তির আশু বাস্তবায়ন, বাংলাদেশিদের জন্য ভিসা ব্যবস্থার উদারীকরণ এবং অবৈধ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশের জিগির না তোলা৷