কাটুক আঁধার
১৩ ডিসেম্বর ২০১২৮ই ডিসেম্বর, শনিবার, ২০১২৷ সময় বিকেল পাঁচটা৷ সেই হবু হবু সন্ধ্যাতেই মোমের আলো দিয়ে ঢাকার কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার আলোকিত করলো নারীপক্ষ৷ প্রতি বছরের মতো এবারও অনুষ্ঠিত হলো ‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার' কর্মসূচি৷ সেখানে দেশের সকল অশুভ শক্তিকে ধ্বংস করে অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র গঠনে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানালো তারা৷ মোমের আলোয় সুরতীর্থের শিল্পীদের কণ্ঠে কবিগুরুর ‘আগুনের পরশমণি ছোঁয়াও প্রাণে' গানটি যেন স্বপ্নের আবেশ ছড়ালো৷ উপস্থিত সকলেরই হৃদয় গেল ছুঁয়ে...৷
‘আলোর স্মরণে কাটুক আঁধার' শিরোনামে এই শ্রদ্ধাঞ্জলির অনুষ্ঠান ১৯৮৮ সাল থেকে আয়োজন করে আসছে নারীপক্ষ৷ কী রয়েছে এর প্রেক্ষাপটে? সংস্থাটির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যা শিরীন হক বললেন, ‘‘এটা একটা ‘মেমোরিয়াল' অনুষ্ঠান, যেখানে আমরা আমাদের হারানো স্বজনদের স্মরণ করি৷ সেই সঙ্গে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধের কিছু ঘটনা এবং মুক্তিযুদ্ধের কিছু চিন্তা ও দর্শন৷ শুরুতে এটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য৷ আমরা সাধারণত বক্তা হিসেবে যাঁদের ডাকি, তাঁরা নাম করা কোনো রাজনৈতিক নেত্রী নন, নন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা৷ আসলে সাধারণের কথাকে তুলে ধরার একটা মঞ্চ হিসেবে আমরা এই অনুষ্ঠানটাকে দেখি৷ সাধারণ মানুষের যুদ্ধে সাধারণ মানুষের অভিজ্ঞতাই তুলে ধরার চেষ্টা করি আমরা৷''
এ বছর অনুষ্ঠানটির প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল: ‘সকলের তরে সকলে আমরা, প্রত্যেকে মোরা পরের তরে'৷ কিন্তু কেন? শিরীন হক জানালেন, ‘‘সম্প্রতি রামুতে, টেকনাফে যে ঘটনা ঘটে গেল .... বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ওপর যে হিংসাত্মক একটা আক্রমণ হলো, সেটার সাথে সাথে এ দেশে আরো যে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সংখ্যালঘুদের ওপর যে আক্রমণ, আহমেদিয়াদের ওপর আক্রমণ – এগুলো সব মাথায় রেখেই অসাম্প্রদায়িক বোধটাকে জাগ্রত করা যে, আমরা সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি যে কোনোভাবে অটুট রাখবো৷ এই বোধটা যদি প্রতিটা মানুষের মধ্যে থাকে, তাহলে আর এ ধরণের ঘটনা ঘটতে পারে না৷ মানুষ যদি ‘কমিটেড' থাকে, ‘ডিটারমাইন্ড' থাকে যে সাম্প্রদায়িকতা তারা মেনে নেবে না, একমাত্র তাহলেই সেটা সম্ভব৷ এই জিনিসটাকেই তুলে ধরার জন্য আমরা এবার এই বিষয়টি নিয়েছিলাম৷''
অনুষ্ঠানে উপস্থিত নারীপক্ষের সভানেত্রী ইউএম হাবিবুন নেসা জানান যে, তাঁরা অন্যায়-অবিচারের অন্ধকারকে দূর করতে মোমবাতি জ্বেলেছেন, যাতে এ আলো এনে দেয় একাত্তরে নির্যাতিত সেই অসংখ্য নারীর জীবনে প্রশান্তি, ফিরিয়ে দেয় সম্মান ও আত্মমর্যাদা৷
তিনি বলেন, সে সময়কার বর্বর পাকিস্তানি সেনারা এ দেশের নারীদের ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে৷ জঘন্য অপরাধ করেছে৷ কিন্তু এর ৪১ বছর পরও আমরা নির্যাতিত নারীদের প্রাপ্য সম্মানটুকু দিতে পারিনি৷ তাই এবার নারীপক্ষ উত্থাপন করে তিন দফা দাবি – যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে ধর্ষিতা, ইজ্জতহানি, সম্ভ্রমহানি ইত্যাদি শব্দ ব্যবহার বন্ধ করা এবং বীরাঙ্গনাদের যথাযথ সুযোগ-সুবিধা ও প্রাপ্য অধিকার নিশ্চিত করা৷
নারীপক্ষের অন্যতম সদস্যা শিরীন হকের কথায়, ‘‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে আমরা যখন প্রথমে এ দাবি তুলি, তখন এই যুদ্ধকালীন ধর্ষণকে যুদ্ধাপরাধই কেউ কখনও বলেনি৷ এখনও রাজনৈতিক বা সামাজিক নেতৃবৃন্দ বলুন, সবাই এক কথায় একে মা-বোনের ইজ্জতহানি বলেই বর্ণনা করেন৷ কেউ কিন্তু সরাসরি ওভাবে উল্টিয়ে দেয় না জিনিসটা৷ আমি মনে করি, প্রথমত আমার ইজ্জত, আমার সম্ভ্রম, আমার ‘চ্যাসটিটি'-র মধ্যে পড়ে না৷ এই যে ‘চ্যাসটিটি' বা ‘অনার' – এই জিনিসটাকেই আমরা ‘চ্যালেঞ্জ' করছি৷ দ্বিতীয়ত এত বড় একটা অপরাধ, সেটাকে মা-বোনের ইজ্জতহানি বলে বর্ণনা করলে নারীকে আরো বেশি অপমান করা হয়৷ আর তৃতীয়ত, এর বিচার হওয়া দরকার৷ এটাকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত করে ‘প্রসিকিউশন'-এ যাওয়া দরকার৷ ধর্ষণের শিকারকে ধর্ষিতা বলে চিহ্নিত না করে যে ধর্ষণ করছে, তাকে অপরাধী বলে চিহ্নিত করা প্রয়োজন৷''
প্রসঙ্গত, শনিবারের ঐ অনুষ্ঠানে ঘোষণাপত্র পাঠ করেন মনীষা মজুমদার৷ শারমিন সাথী ইসলাম গেয়ে শোনান ‘জয় হোক, জয় হোক' গানটি৷ ছিল ‘ছোটদের বড়দের সকলের' এবং ‘এমন মানব জনম আর কী হবে' গান দুটির পরিবেশনাও৷ এছাড়া, অনুষ্ঠানে আবৃত্তি পরিবেশন করেন ভাস্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, স্বরচিত ‘তালাশ' উপন্যাসের কিছু অংশ পড়ে শোনান লেখিকা শাহীন আখতার আর মুক্তিযু্দ্ধের স্মৃতিচারণ করেন মুক্তিযোদ্ধা ড. লায়লা বানু, সাফিনা লোহানী ও মোজাহেরুল হক৷
মোমের আলো, গান আর স্মৃতিচারণের মাধ্যমে আবারো প্রকাশিত হয় অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন, যেখানে আলোর স্মরণে কেটে যাবে আঁধার, অধিকার নিশ্চিত হবে সকলের৷