আলোকচিত্রীর ক্যামেরায় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ
১৯৭১ সালে ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের ফটোগ্রাফার হিসেবে শরণার্থী শিবির ও মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ শিবিরের প্রায় সাড়ে ৫০০ ছবি তুলেছেন আলোকচিত্রী আবদুল হামিদ রায়হান৷ ছবিঘরে দেখুন তার কয়েকটি৷
২৫ মার্চ, কুষ্টিয়া
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ই মার্চের ভাষণের পর থেকেই উত্তপ্ত হতে থাকে কুষ্টিয়া৷ ২৩ মার্চ ইসলামিয়া কলেজ মাঠে যুদ্ধের প্রস্তুতিতে শোডাউন করেন ছাত্র-মজুর-জনতা৷ ২৫ মার্চ ১৯৭১, কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে হয় আরেকটি সমাবেশ৷ ছবিটি সেই সময়ের৷
পতাকা উত্তোলন
কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠের সেদিনের সমাবেশে ছাত্র নেতারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করেন৷ সেখানে উপস্থিত ছিলেন গোলাম কিবরিয়া, আব্দুর রউফ চৌধুরী, নূরে আলম জিকো প্রমুখ৷ সেই আন্দোলনে হামিদ রায়হান নিজে শুধু যুক্তই থাকেননি ক্যামেরায় ছবিও তুলে রেখেছেন৷
তির-ধনুকে প্রস্তুতি
কয়েক হাজার মানুষ সেদিন জড়ো হয়েছিলেন কুষ্টিয়া হাইস্কুল মাঠে৷ পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রস্তুতি হিসেবে লাঠি, তির-ধনুক, দা ও নকল রাইফেল নিয়ে জড়ো হন তারা৷ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে নানা বয়সের মানুষ অংশ নেন সেই সমাবেশে৷
শিকারপুর ট্রেনিং ক্যাম্প
প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা তখন বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন শুরু করেছেন৷ পুরোদমে চলছে যুদ্ধ৷ বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর কাজ করছিল বিভিন্ন শরণার্থী ক্যাম্পে৷ ১৫ সেপ্টেম্বর ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের ফটোগ্রাফার হিসেবে যোগ দেন আবদুল হামিদ রায়হান৷ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার শিকারপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে মুক্তিযোদ্ধাদের অনুশীলনের এই ছবিটি তিনি তুলেছেন ২০ নভেম্বরে৷
প্রশিক্ষণে মুক্তিযোদ্ধারা
একই সময়ে শিকারপুর ট্রেনিং ক্যাম্পে অনুশীলনরত আরো কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা৷ আবদুল হামিদ রায়হান ঘুরে বেড়িয়েছেন বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্প, শরণার্থী ক্যাম্প ও মুক্তাঞ্চলগুলোতে৷ পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর হামলায় ধ্বংস হওয়া সেতু, কালভার্ট ও ভবনের ছবিও উঠে এসেছে তার ক্যামেরায়৷ সেসব ছবি স্বাধীনতার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সহায়ক হয়েছিল।
পাক সেনাদের রকেট বোমা
এই ছবিটি তোলা হয়েছে ১৯৭১ সালের ১১ ডিসেম্বর৷ যশোরের পিকনিক কর্নারের পাক বাহিনীর ফেলে যাওয়া তাজা রকেট বোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে দুই শিশু৷
রাজাকার আটক
চার রাজাকারকে আটক করেছেন মুক্তিযোদ্ধারা৷ একজন মুক্তিযোদ্ধার হাতে একটি পোস্টার দেখা যাচ্ছে যাতে লেখা, ‘‘রক্তের ঋণ রক্তে শুধবো, দেশকে এবার মুক্ত করবো৷’’ ছবিটি কুষ্টিয়া থেকে তুলেছিলেন আবদুল হামিদ রায়হান৷
এ এইচ এম কামরুজ্জামানের পরিদর্শন
সাতক্ষীরার কালিগঞ্জে মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন তৎকালীন অস্থায়ী সরকারের স্বরাষ্ট্র, কৃষি এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী এ এইচ এম কামরুজ্জামান৷ তার সঙ্গে ছিলেন মেজর জলিল, ব্যারিস্ট্রার আমীর-উল-ইসলাম, মেজর হায়দার প্রমুখ৷ আবদুল হামিদ রায়হান এই ছবিটি তুলেছেন ০২ ডিসেম্বর৷
স্বেচ্ছাসেবীদের দল
ভারতে শরণার্থী ক্যাম্পগুলোতে স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়োগ দিতো বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোর৷ ক্যাম্পগুলোতে স্কুল চালানো, স্বাস্থ্য ও চিকিৎসা সেবা দিতেন তারা৷ ক্যাম্পের যুবক-যুবতীদের সংগঠিত করে বিভিন্ন কাজে যুক্ত রাখতেন স্বেচ্ছাসেবীরা৷ ছবিতে ভলান্টিয়ার সার্ভিস কোরের সঙ্গে যুক্তদের একাংশকে দেখা যাচ্ছে৷
অস্ত্র হাতে মুক্তিযোদ্ধা
এক মুক্তিযোদ্ধার বন্দুক তাক করা এই ছবিটি তোলা সাতক্ষীরার দেবহাটায়৷ কয়েকবছর আগে দৃক গ্যালারিতে ছবিটি প্রদর্শিত হয়৷ সেটি দেখে ছবির মুক্তিযোদ্ধাকে খবর দেন তার এক নিকটাত্মীয়৷ আবদুল হামিদ রায়হান জানান, ‘‘নারায়ণগঞ্জ থেকে এসে একাত্তরে নিজের ছবি দেখে আমাকে কান্নায় জড়িয়ে ধরেন ওই মুক্তিযোদ্ধা৷ তখনই জানি তার নাম মোসলেহ উদ্দিন৷’’
স্বীকৃতি পাওয়ার উল্লাস
১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ভারত৷ সেদিন কলকাতায় মিছিল বের করেন বাংলাদেশিরা৷ একটি মিছিলে প্ল্যাকার্ড হাতে ট্রাকের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন কবি নির্মলেন্দু গুণ৷
৫৪০টি ছবি
একাত্তর সালে আবদুল হামিদ রায়হান তার ক্যামেরা দিয়ে সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের ঐতিহাসিক সচিত্র দলিল৷ শরণার্থী ক্যাম্প ও সীমান্ত এলাকার বিভিন্ন অ্যাকশন ক্যাম্পে প্রায় সাড়ে ৫০০ ছবি তোলেন তিনি৷ সেগুলো ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সংস্থায় পাঠানো হতো৷ ছবি দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলায় ভূমিকা রাখেন এই আলোকচিত্রী মুক্তিযোদ্ধা৷