আমরা সব বিশেষজ্ঞের দল
১৯ নভেম্বর ২০২১রীতিমতো আলোড়ন ফেলে দিয়েছিলেন পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের প্রধান ও সিপিএম নেতা বিমান বসু৷ ২০০৪ সালের ঘটনা৷ বিমান বসু স্লোগান দিলেন, ‘লালা, বাংলা ছেড়ে পালা’৷ লালা মানে বিচারপতি অমিতাভ লালা৷ তিনি তখন কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি৷ তাকে বাংলা ছেড়ে পালাবার পরামর্শ দেয়ার কারণ হলো, তিনি হাইকোর্টে আসছিলেন৷ গুরুত্বপূর্ণ মামলা ছিল৷ কিন্তু সিপিএমের মিছিলের জেরে তার গাড়ি রাস্তায় আটকে পড়ে৷ তিনি হাইকোর্টে পৌঁছে বলেন, কাজের দিনে কলকাতায় মিটিং মিছিল বন্ধ করা উচিত৷ এই পর্যবেক্ষণেই রীতিমতো ক্ষুব্ধ বিমান বসু একজন বিচারপতিকে শুধু ‘তুই’ করে বলে পশ্চিমবঙ্গ ছেড়ে চলে যাওয়ার পরামর্শই দেননি, একটি অতি অশোভন মন্তব্য করেছিলেন৷ পরে তার জন্য বিমান বসুকে ক্ষমা চাইতে হয়েছে৷
এই ঘটনাটি একটা বিষয় বোঝাবার জন্য যথেষ্ট যে, বিচারক বা বিচারপতিদের রায় বা পর্যবেক্ষণ পছন্দ না হলে তাকে কী রকম মন্তব্যের সামনে পড়তে হয়৷ বিচারব্যবস্থার উপর সরকার চাপ দেয় কিনা, চাপ দিলে সেই চাপ কতটা কার্যকর হয়, সেসব জটিল ও কুটিল প্রশ্নের মধ্যে ঢোকার দরকার নেই৷ শুধু এটুকু মনে রাখাই যথেষ্ট যে, ভারতে বিচারক বা বিচারপতিরা তাদের পর্যবেক্ষণের সময় প্রচুর বেফাঁস কথা বলেন৷ আবার রাজনীতিক থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষও বিচারক বা বিচারপতিদের বিরুদ্ধে অশোভন মন্তব্য করতে ছাড়েন না৷ দুই তরফের এমন উদাহরণ প্রচুর৷ এমনকি সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতিদের বিরুদ্ধে ভয়ংকর অভিযোগ আনার জন্য বিচারপতি কামরানকে তো জেলে পাঠিয়েছিল সর্বোচ্চ আদালত৷ খোদ বিচারপতিকে সর্বোচ্চ আদালত বিরূপ মন্তব্যের জন্য জেলে পাঠাচ্ছে এমন ঘটনা এর আগে বা পরে কখনো ঘটেনি৷
ফলে ভারতে সব ধরনের উদাহরণ আছে৷ সাবেক প্রধান বিচারপতি বোবদে ধর্ষককে বিয়ে না করলে কড়া শাস্তির কথা বলে বিতর্কের ঝড় তুলেছিলেন৷ আবার বিচারপতি পুষ্প গনেড়িওয়ালা ১২ বছরের মেয়ের বুকে হাত দেয়া নিয়ে যে কথা বলেছিলেন, তা নিয়েও আলোড়ন কম হয়নি৷ একটা সহজ কথা মনে রাখা দরকার৷ বিচারপতি, রাজনীতিক, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক সকলেই তো এই সমাজ থেকেই উঠে আসছেন৷ তাদের কারো মধ্যে চিরাচরিত ধ্যানধারণা থেকে যেতেই পারে৷ তাই এক বিচারপতি এমন কথাও বলতে পারেন যে ময়ূর ব্রক্ষ্মচারী৷ গরুর দুধে সোনা থেকে শুরু করে ব্রক্ষ্মচারী ময়ূর পর্যন্ত অনেক কথাই তো আমরা রাজনীতিক থেকে শুরু করে বিচারপতিদের কাছে শুনেছি৷ তাই আর অবাক হই না৷
তবে অনেক সময়ই দেখা যায়, তারা আদালতে যে পর্যবেক্ষণ দেন, তার সঙ্গে রায় মেলে না৷ খুব কড়া কড়া পর্যবেক্ষণ দেয়ার পর দেখা যায়, তিনি রায়ে সেসবের দিকে গেলেনই না৷ আসলে যারা দীর্ঘদিন ধরে বিচার করছেন, নিম্ন আদালতের বিচারক থেকে হাইকোর্ট বা সুপ্রিম কোর্টের বিচারপতি হয়েছেন, তাদের মধ্যে এরকম প্রবণতা থাকাটা স্বাভাবিক৷ একটা কথা মনে রাখা দরকার, বিচারপতি যে বিচার করেন, তা মামলার সাক্ষ্য, প্রমাণের উপর নির্ভর করে৷ আমার পরিবারের এক বিচারপতির সঙ্গে এই নিয়ে দীর্ঘ আলাপচারিতার সূত্রে এবং বহু মামলা চলার সময় আদালতকক্ষে উপস্থিত থাকার সুবাদে জানি যে বিচারক বা বিচারপতিদের অনেক সময়ই এক ধরনের হতাশা আসে৷ তারা একটা কথা হামেশাই বলেন, পুলিশ যেভাবে মামলা সাজাবে, তার উপর শাস্তি দেয়া বা না দেয়া অনেকাংশে নির্ভর করে৷ পুলিশ যদি ঠিকভাবে মামলা না সাজায় তাহলে বিচারপতিদের কিছুই করার থাকে না৷ ফলে বিচারক বা বিচারপতি হয়তো বুঝতে পারছেন, এই মামলায় অভিযুক্ত আসলে অপরাধ করেছে, কিন্তু তাও তাকে ছেড়ে দিতে হয়৷ তখন তারা মামলা চলার সময় পুলিশের বিরুদ্ধে অনেক সময়ই প্রচুর বিরূপ মন্তব্য করেন৷ সেই সব পর্যবেক্ষণ কেউ লিখলে মহাভারত হয়ে যাবে৷
আর পুলিশও তো রাজনৈতিক, অরাজনৈতিক, অর্থনৈতিক নানা কারণে তদন্তের অভিমুখ ঘুরিয়ে দেয় বলে হামেশাই অভিযোগ ওঠে৷ ফলে বিচারপতি বা বিচারকেরা আর কীই বা করবেন, শুধু ক্ষোভপ্রকাশ করা ছাড়া৷ সেই ক্ষোভ কখনো মাত্রাছাড়া হয়ে যায়৷ কখনো অভ্যাসেও পরিণত হয়ে গেলে অবাক হওয়ার কিছু নেই৷ আর বাইরে থেকে বিচারপতিদের প্রচুর ক্ষমতাধর মানুষ বলে মনে হলেও সত্যিই কি তাই? তাদের উপরেও চাপ থাকে, সুবিচার দেয়ার তাগিদ থাকে, কিছু ক্ষেত্রে আমজনতার মতামতের একটা গুরুত্ব থাকে৷ একটা রায় দেয়ার আগে তাদের যেরকম পরিশ্রম করতে হয়, সেটাও সাধারণ মানুষের অগোচরে থেকে যায়৷ আমার পরিচিত বিচারপতিকে দেখেছি, একটু জটিল মামলার ক্ষেত্রে আদালতের সময় পার হয়ে যাওয়ার পর বাড়িতে এসে ঘণ্টার পর ঘণ্টা তিনি আইনের বই পড়ছেন, চিন্তা করছেন, তারপর দীর্ঘ রায় ডিকটেশন দিচ্ছেন স্টেনোগ্রাফারকে৷ টাইপ হয়ে গেলে তা শুদ্ধ করছেন৷ এই কর্মকাণ্ডের চাপ যথেষ্ট এবং তার জন্য সরকারি চাকরির সময়ের বাইরেও প্রচুর সময় দিতে হয়৷
তবে বিচারক বা বিচারপতি হতে গেলে এই ঝক্কিটা তাদের নিতেই হবে৷ সবই ঠিক৷ কিন্তু আমরা যখন খুব সহজে বিচারক, বিচারপতি বা কোনো রায়ের সমালোচনা করি, বিচার শুরুর আগেই টিভির আলোচনায় চূড়ান্ত রায় দিয়ে দিই, তখন এই সব কথা মনে রাখি না৷ আমরা এটাও মনে রাখি না, বিচারের রায় হয় আইন মেনে৷ আইনের গণ্ডির বাইরে তারা যেতে পারেন না৷ আর ফৌজদারি মামলা হলে সেখানে পুলিশের রিপোর্ট, সাক্ষী, প্রমাণ সবই খুব গুরুত্বপূর্ণ৷ সেসব ঠিক না থাকলে বড় অপরাধীও ছাড়া পেয়ে যাবেন৷ বেহুলা-লখিন্দরের ঘরে অতি ক্ষুদ্র ছিদ্র ছিল, তা দিয়েই সাপ ঢুকে যায়, আর আইনের ফাঁক তো বিশাল৷ তার সঙ্গে থাকেন দুঁদে আইনজীবীরা৷ সবমিলিয়ে বিচার তো একটা আইনি লড়াই৷ সেখানে কী রায় হচ্ছে সেটাই আসল৷ পর্যবেক্ষণের গুরুত্ব খুব কম৷ কিন্তু এখন তো সময়টাই উল্টো৷ পিছনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার এই সময়ে তাই যে কেউ, যে কোনো মামলা দিয়ে শেষ রায় দিয়ে দেন৷ ডাক্তারি না পড়ে যেমন সাধারণ মানুষ নিজের বা পরিজনদের চিকিৎসা শুরু করে দেন, এ তেমনই৷ আর যেখানে দেবতারা যেতে ভয় পান, মূর্খরা তো সেখানে নির্ভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে৷ তার উপর পুরো না জেনে বা অর্ধেক জেনে মন্তব্য করার অধিকার তো আমাদের প্রায় মৌলিক অধিকারের পর্যায়ে পড়ে৷
আমি একথা একবারের জন্যও বলছি না যে, বিচারব্যবস্থা নিখুঁত, বিচারক ও বিচারপতিরা সমালোচনার উপরে৷ একবারের জন্যও নয়৷ বিচারব্যবস্থাতেও দুর্নীতি আছে, ভয়ংকর দীর্ঘসূত্রিতা আছে, বিশাল ফাঁক আছে, এ সবই সত্য৷ সেই সঙ্গে কয়েকজনের বেফাঁস মন্তব্যে সব বিচারপতিকে কাঠগড়ায় তোলার অধিকারও আমাদের নেই৷ যেমন নেই আইন-আদালতের ব্যবস্থা, রায়দানের প্রক্রিয়া সম্পর্কে কিছুই না জেনে বিরূপ মন্তব্যের অধিকার৷