আবার শিক্ষার্থীর আত্মহত্যা: কারণ এবং প্রতিকার কী?
১৫ জানুয়ারি ২০১৯প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে পড়া, অপমানবোধ আর মধ্যে হতাশা থেকেই এমন করছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা৷
সোমবার সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তাইফুর রহমানের ঝুলন্ত লাশ উদ্ধার করা হয়৷ তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং অ্যান্ড বায়োটেকনোলজি (জিইবি) বিভাগে স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় প্রথম হয়েছিলেন৷ উচ্চশিক্ষার জন্য যুক্তরাজ্যে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন৷ পরিবারের অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্যায়ের শিকার হয়ে তাইফুর আত্মহত্যার পথ বেছে নিয়েছেন৷
তাইফুরের মৃত্যুর ঘটনায় তাঁর বোন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক শান্তা তাওহিদা ফেসবুকে সোমবার লিখেছেন, ‘‘অনার্সে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হওয়া ছেলেটাকে বিভিন্ন ইস্যু বানিয়ে মাস্টার্সে সুপারভাইজার দেয় নাই৷ বিভিন্ন কোর্সে নম্বর কম দিয়েছে! আমার ভাইটা টিচার হওয়ার স্বপ্ন দেখেছিল, এটাই তার অপরাধ৷'' তবে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন এই অভিযোগ অস্বীকার করে সংবাদমাধ্যমকে বলেছে, পুলিশ তদন্ত করছে, তদন্ত শেষ হলে আত্মহত্যার কারণ জানা যাবে৷
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘কোনো ঘটনার পর পুলিশ তদন্ত শুরু করে৷ সেখানে আত্মহত্যা হলেও কেন এই আত্মহত্যার ঘটনা, সেটা খুঁজে বের করার চেষ্টা হয়৷ সেখানে যদি দেখা যায় কেউ তাকে আত্মহত্যার প্ররোচনা দিয়েছেন, তাহলে তার বিরুদ্ধে কিন্তু প্ররোচনার অভিযোগ এনে চার্জশিট দেয় পুলিশ৷'' সাম্প্রতিক সময়ে আরেকটি আত্মহত্যার ঘটনা দেশজুড়ে তোলপাড় তুলেছিল৷ গত ডিসেম্বরে ভিকারুননিসা নূন স্কুলের নবম শ্রেণির ছাত্রী অরিত্রী অধিকারীর আত্মহত্যা করে৷ পর দেশজুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়৷ সেই ঘটনায় তিনজন শিক্ষিকার বিরুদ্ধে মামলা হয়৷ ঘটনার পরদিনই একজন শিক্ষিকাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ৷ অরিত্রীরআত্মহত্যার কারণ জানাতে গিয়ে তার বাবা দিলীপ অধিকারী বলেছিলেন, ‘‘পরীক্ষার হলে মোবাইল নেওয়ায় তার সামনেই আমাকে ডেকে অপমান করেন শিক্ষিকা৷ এই অপমানবোধ থেকেই আত্মহত্যা করে অরিত্রী৷'' তখন শিক্ষকদের ব্যবহার নিয়েও নানা আলোচনা শুরু হয়৷ সব পর্যায়ের শিক্ষার্থীদের মাঝেই আত্মহত্যার প্রবণতা রয়েছে৷ কিন্তু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে এই প্রবণতা দূর করার কোনো পদক্ষেপ লক্ষ্য করা যায় না৷
সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার প্রবণতার বিষয়টিও সবার নজরে এসেছে৷ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শিক্ষার্থীদের মধ্যে হতাশা বেড়ে গেছে৷ এ কারণে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সুযোগ পাওয়াকেও তুচ্ছ মনে করছে৷ চলে যাচ্ছে আত্মহননের দিকে৷ আগে আমরা দেখেছি, প্রেম ভালোবাসা বা এই ধরনের ফালতু বিষয় নিয়েই শিক্ষার্থীরা আত্মহননের পথে যেতো৷ এখন কিন্তু সে কারণে তারা আত্মহত্যা করছে না৷ আর যে হতাশার কথা বললাম, সেটা পুরো সমাজ-ব্যবস্থার মধ্যেই প্রভাব পড়ছে৷ আমাদের দেশে উন্নতি হচ্ছে৷ বিদেশ থেকে টাকা আসছে বা শ্রমিকদের টাকা দিয়ে দেশের উন্নয়ন হচ্ছে, কিন্তু কর্মসংস্থান বাড়ছে না৷ ফলে বেকারত্বের কারণেও হতাশ হয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা৷ তাদের তো আসলে কর্মসংস্থান দরকার৷ সেটা আমরা করতে পারছি না৷'' বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন কি এ ব্যাপারে কোনো ভূমিকা রাখতে পারে? জবাবে জনাব চৌধুরী বলেন, ‘‘চাকরির ব্যবস্থা তো বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন করতে পারবে না৷ তবে হ্যাঁ, গত ২৮ বছর ধরে ডাকসু নেই, যে কারণে এখানে সাংস্কৃতিক চর্চাও বন্ধ হয়ে গেছে৷ এখন শিক্ষার্থী কী করবে? তাকে তো সুস্থভাবে বেড়ে উঠার সুযোগ দিতে হবে৷ আমরা তাদের সেই সুযোগ দিতে পারছি না৷''
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ১৪ বছরে আত্মহত্যা করেছেন ২৩ জন শিক্ষার্থী৷ এর মধ্যে গত তিন বছরেই আত্মহত্যা করেছেন ১১ জন৷ বিষন্নতা, শিক্ষাজীবন নিয়ে হতাশা, সম্পর্কের টানাপোড়েন এবং চাকরি নিয়ে অনিশ্চয়তার কারণে তাঁরা আত্মহননের পথ বেছে নেন৷ অধ্যাপক চৌধুরীও একই কথা বলছিলেন৷ তাঁর মতে, এই শিক্ষার্থীদের চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে৷ আমাদের সরকার কি সে দিকে মনোযোগী? আর সামাজিক অস্থিরতাও এর সঙ্গে যুক্ত৷ শিক্ষার্থীরা খুবই সেনসিটিভ৷
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৫ থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ২৩ জন শিার্থীর আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ গত বছর, অর্থাৎ ২০১৮ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাতজন শিক্ষার্থী আত্মহত্যা করেন৷ ২০১৭ সালে আত্মহত্যা করেন তিন শিক্ষার্থী৷ ২০১৬ সালে আত্মহত্যা করেন একজন৷ ২০১৫ সালে আত্মহত্যা করেছিলেন চার শিক্ষার্থী৷ এই সংখ্যা উদ্বেগজনক মনে করছেন অধ্যাপক চৌধুরী৷
জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনষ্টিটিউটের অধ্যাপক ডা. তাজুল ইসলাম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘মূলত হাতাশা থেকেই শিক্ষার্থীরা আত্মহত্যা করে৷ আমার কাছে এমন উদাহরণও আছে যে মাত্র ৬ নম্বরের জন্য একজন শিক্ষার্থী ফাষ্টক্লাস পায়নি, এ কারণে সে আত্মহত্যা করেছে৷ এমন অনেক উদাহরণ আছে৷ তাদের যেমন চাকরির সুযোগ দিতে হবে, তেমনি অভিবাবকদেরও বোঝাতে হবে, তোমরা পরীক্ষা দিলেই সবাইকে যে প্রথম হতে হবে এমনটি নয়৷ আবার কোনো কারণে একবার না পারলে ভবিষ্যতে চেষ্টা করা যেতে পারে, সেটিও তাদের বোঝাতে হবে৷ আমাদের শিক্ষার্থীরা এমন হয়েছে, কারণ পরিবারের চাপও আছে৷''