আওয়ামী শব্দের বিকৃতির জন্য ১০ বছরের দণ্ড নিয়ে প্রশ্ন
২৬ জানুয়ারি ২০২২একজন আওয়ামী লীগ নেতার করা তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারার এই মামলার রায়ে একই সঙ্গে ওই যুবককে ১০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে৷ অনাদায়ে আরও এক বছরের কারাদণ্ডের আদেশ দেওয়া হয়েছে৷ এই গুরুদণ্ড এবং রাজনৈতিক বিতর্কসহ সবকিছু আদালতে নিয়ে যাওয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন সিনিয়র আইনজীবীরা৷
আইনজীবী মনজিল মোরশেদ বলছেন, ব্যক্তির মানহানি হলে আইন অনুযায়ী মানহানি মামলা হয় কিংবা রাষ্ট্রবিরোধী কাজ করলে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা হতে পারে৷ কিন্তু আওয়ামী লীগ তো প্রতিষ্ঠান৷ এ মামলায় আওয়ামী লীগের মানহানি হলে দলটির কেন্দ্রীয় কমিটি সিদ্ধান্ত নিতে পারতো৷ কিন্তু তা হয়নি৷ তিনি বলেন কিছু বিষয় আছে যেগুলো রাজনীতি ও সংবিধানের সাথে জড়িত৷ সেগুলো অনেক সময় আদালতে আসে জাতীয় স্বার্থে৷ কিন্তু ব্যক্তিগত বা দলীয় প্রচার-পাল্টা প্রচার, কুৎসা-পাল্টা কুৎসা এগুলো তো আদালতে বয়ে আনার যুক্তি নেই৷ এসব বিষয়ে চেক অ্যান্ড ব্যালেন্স যারা করবেন তাদের শক্তভাবে এগুলো দেখা উচিত৷
দণ্ডপ্রাপ্ত তরুণের নাম আবদুল মুকিত ওরফে রাজু (২২)৷ তিনি রাজশাহীর পবা উপজেলার হরিপুর গ্রামের রিয়াজুল ইসলামের ছেলে৷ ২০১৭ সালে মামলাটি করেছিলেন হরিপুর ইউনিয়নের আওয়ামী লীগের সভাপতি সাইদুর রহমান বাদল৷ মুকিত হরিপুর ইউনিয়ন ছাত্রশিবিরের সভাপতি বলে দাবি সাইদুর রহমানের৷ মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ২০১৭ সালের ২৭ মে আবদুল মুকিত তার ফেসবুক আইডিতে আওয়ামী লীগকে ব্যঙ্গ করে বাবা ও ছেলের কথোপকথনের ঢঙে একটি কৌতুক পোস্ট করেন৷ সেখানে তিনি উল্লেখ করেন, আওয়ামী শব্দটি আইয়াম শব্দ থেকে এসেছে৷ যার অর্থ অন্ধকার, কুসংস্কার আর লীগ অর্থ দল৷ অর্থাৎ আওয়ামী লীগ মানে অন্ধকারের দল৷ সেখানে ইসলাম ও আওয়ামী শব্দটি নিয়ে সাংঘর্ষিক অবস্থানে এনে উসকানি দেওয়া হয়েছে বলে দাবি বাদির৷ গত সোমবার সোমবার রাজশাহী সাইবার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. জিয়াউর রহমান একমাত্র অভিযুক্তের দণ্ড ঘোষণা করেন৷
সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) ইসমত আরা বেগম ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আদালত যেহেতু বিষয়টি আমলে নিয়েছেন এবং আমরা ছেলেটির অপরাধ প্রমাণ করতে পেরেছি তাই তার শাস্তি হয়েছে৷ আইসিটি এ্যাক্টে পরিস্কার উল্লেখ রয়েছে, কী করলে অপরাধ হবে৷ এখানে অপরাধ প্রমাণিত৷ আওয়ামী লীগের যে কোন কর্মী সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলাটি করতে পারেন৷ এলাকায় শান্তি শৃঙ্খলার স্বার্থে বাদি এই মামলাটি করেছেন৷ এটি না হলে তখন বড় ধরনের বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা ছিল৷ কারণ আওয়ামী লীগকে এভাবে বিকৃত করে বর্ণনা করায় সবাই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন৷''
এখনও মামলাটিই মানতে পারছেন না মুকিতের পরিবার৷ তার বোন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিবা খাতুন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমার ভাই তখন কেবল এসএসসি পাশ করে এইচএসসিতে ভর্তি হয়েছে৷ তখন তার কোন এন্ড্রোয়েড ফোন ছিল না৷ এই পোস্টটিও সে দেয়নি৷ এই মামলাটি যিনি করেছেন সেই সাইদুর রহমান বাদলের সঙ্গে আমার দাদা মরহুম আমজাদ আলীর ২০০০ সালে গরুর ঘাটের জমি নিয়ে বিরোধ ছিল৷ তখন তিনজন খুনও হন৷ পরে আমরা ওই এলাকা ছেড়েই চলে আসি৷ এখনও তিনি আমাদের পেছনে পড়ে আছেন৷ আমরা ভাই-বোনেরা শিক্ষিত হচ্ছি এটা তিনি কোনভাবেই মানতে পারছেন না৷ পুরোপুরি ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকেই তিনি মামলাটি করেছেন৷''
সাইদুর রহমান বাদল এই অভিযোগ অস্বীকার করে ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘শাস্তি হওয়ার পর তারা এখন উল্টোপাল্টা বলছে৷ তাদের সঙ্গে আমার কোন বিরোধ ছিল না, এখনও নেই৷ ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে আমি সংক্ষুব্ধ হয়ে মামলা করেছি৷ বিচারক তো সবকিছু শুনেছেন, এরপরই তো তিনি আদেশ দিয়েছেন৷''
আসামী পক্ষের আইনজীবী ছিলেন মিজামুল ইসলাম৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, আমরা দু'টি বিষয় আদালতের নজরে এনেছিলাম৷ এক. যে ডিভাইস দিয়ে এই পোস্ট দেওয়া হয়েছে সেটার কোন পরীক্ষা করা হয়নি৷ সে ডিভাইসও পাওয়া যায়নি৷ দুই. কৌতুকের কারণে একটি দলের মানহানির সুযোগ নেই৷ এটা ব্যক্তির স্বাধীনতা৷ প্রতিদিনই রাজনৈতিক নেতারা একে অপরের বিরুদ্ধে নানা ধরনের কথা বলছেন৷ সেটা যদি অপরাধ না হয়, তাহলে এটা কেন অপরাধ হবে? কিন্তু বিচারক আমাদের যুক্তি আমলে নেননি৷ ফলে আমরা উচ্চ আদালতে সুবিচার পাব বলে আশা করি৷
এই মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে একটি জায়গায় বিচারক বলেছেন, কৌতুকের নামে যে পোস্ট করা হয়েছে, সেই পোস্টের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে মিথ্যাচার করা হয়েছে৷ ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়ানো হয়েছে, ইতিহাস বিকৃত করা হয়েছে, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টে উসকানি দেওয়া হয়েছে৷ পোস্টে বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগের নাম নেওয়া পাপ, এটা গজবের নাম৷ ইসলামের নামে গল্প ফেঁদে পোস্টদাতা ঘৃণার বিষবাষ্প ছড়িয়েছেন৷ তারপর বলছেন, আওয়ামী শব্দটি এসেছে আইয়াম শব্দ থেকে৷ যার অর্থ বলা হয়েছে অন্ধকার, কুসংস্কার৷ বলা হয়েছে, আওয়ামী লীগ মানে অন্ধকারের দল৷ কিন্তু তথ্যমতে, উর্দু আওয়াম শব্দ থেকে আওয়ামী লীগ শব্দটি এসেছে৷ আর উর্দু আওয়াম শব্দের অর্থ জনতা৷ পোস্টদাতা এখানে মিথ্যাচারের আশ্রয় নিয়েছেন৷
সিনিয়র আইনজীবী শাহদীন মালিক ডয়চে ভেলেকে বলছেন, ‘‘ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করা কিংবা বিরূপ সমালোচনাকে ফৌজদারি আইনে অপরাধ হিসেবে দেখাটা সভ্য দেশগুলোতে ২০০ বছর আগেই উঠে গেছে৷ বাংলাদেশে এগুলো আদালতে আনা হচ্ছে কারণ এতে করে অন্যরা সমালোচনা করতে ভয় পাবে৷ বহু আলোচিত ৫৭ ধারার পর এগুলো বেশি করে আসছে আর এটি করা হচ্ছে কারণ এখন যে কোন ব্যক্তি যে কোন ব্যাপারে মন্তব্য করতে ভয় পাবে৷ গত ১৫-২০ বছর ধরে বিচার বিভাগের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন হচ্ছে৷ আগে তারা যতটা স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারতেন, আমার মনে হয় এখন তারা ততটা স্বাধীনভাবে বিচার করতে পারেন না৷ আমরাও তো আগে যেভাবে স্বাধীনভাবে কথা বলতাম, এখন তো রাখঢাক করেই কথা বলি৷ এটা শুধু বাক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে না, সব ক্ষেত্রেই এর প্রভাব পড়ছে৷ বিচার বিভাগও এর বাইরে নয়৷''