অ্যাম্বাসাডরের আক্ষেপ টেসলায় পূরণ?
২০ জানুয়ারি ২০২২টেসলা গাড়ির কর্ণধার ইলন মাস্কের একটি টুইট ঘিরে নতুন জল্পনা তৈরি হয়েছে৷ সম্প্রতি মার্কিন ধনকুবের শিল্পপতি মাস্ক একটি টুইট করেন৷ সেখানে তিনি লিখেছেন, ভারত সরকারের সঙ্গে কাজ করতে তাকে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে৷ ভুবনখ্যাত টেসলা গাড়ি ভারতের বাজারে কবে আসবে, এই সংক্রান্ত প্রশ্নের জবাবে মাস্কের এই টুইট৷ এর জবাবে টেসলা কর্ণধারকে বাংলায় বিনিয়োগের আহ্বান জানিয়েছে রাজ্য সরকার৷
পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু বিষয়ক মন্ত্রী মহম্মদ গোলাম রব্বানী মাস্ককে রিটুইট করে লিখেছেন, পশ্চিমবঙ্গের শিল্প বিনিয়োগের অনুকূল পরিবেশ রয়েছে৷ মাস্ক এই রাজ্যে বিনিয়োগ করতে এলে স্বাগত৷ বাংলার পাশাপাশি আরো দুই অ-বিজেপি দল শাসিত রাজ্য তেলেঙ্গানা ও মহারাষ্ট্র একই ধরনের আমন্ত্রণ জানিয়েছে৷ ইতিমধ্যে রাজনৈতিক চাপানউতোর শুরু হয়েছে এ নিয়ে৷ যখন আলোচনা তুঙ্গে, সেই সময় একবার ফিরে দেখা বাংলার অ্যাম্বাসাডর গাড়ি শিল্পের সোনালি অতীতকে৷
অটোমোবাইল শিল্পে ভারত যে গতি পেয়েছিল, তার অনেকটাই হিন্দমোটরের হাত ধরে৷ হুগলির উত্তরপাড়ায় ১৯৫৪ সালে গড়ে উঠেছিল এশিয়ার বৃহত্তম গাড়ি কারখানা৷ সেই কারখানা আজ খণ্ডহরের মতো পড়ে আছে৷ ২০১৪ সালের মে মাসে সাসপেনশন অফ ওয়ার্কের নোটিস পড়ে সি কে বিড়লা গোষ্ঠীর মালিকানাধীন হিন্দমোটরে৷ ৭৪৪ একরে গড়ে ওঠা কারখানা চত্বরের বড় অংশ জঙ্গলে ভরে গিয়েছে৷ একের পর এক শেডের নীচে মেশিন শপ, ইঞ্জিন শপ থেকে ক্যান্টিন, অডিটোরিয়ামের ভগ্নাবশেষ দাঁড়িয়ে আছে হিন্দমোটর রেল স্টেশনের পাশে৷
রামশঙ্কর যাদব, সঞ্জয় সিংরা কাজ করতেন এই কারখানায়৷ এখনো পে রোলে তাদের নাম আছে৷ এখানকার ভগ্নপ্রায় জল, বিদ্যুৎহীন আবাসনে এঁরা থাকেন৷ দিনে এক ঘণ্টা জল-বিদ্যুৎ মেলে৷ এখনো কেন এই মাটি আঁকড়ে পড়ে আছেন? রামশঙ্কর বলেন, "চাকরি ছেড়ে দিলে এই আবাসন ছাড়তে হবে৷ সে ক্ষেত্রে অবশ্য প্রভিডেন্ট ফান্ড, গ্রাচুয়িটির টাকা পাব৷ অবসরের বয়স হলে চলে যাব৷ কারখানা আবার চালু হবে এমন কোনো আশা আমাদের নেই৷”
এই হুগলি জেলারই সিঙ্গুরে টাটার গাড়ি কারখানা তৈরির কাজ অনেকটা এগোলেও শেষমেষ তা বাতিল হয়ে যায়৷ মোটর গাড়ি তৈরিতে দক্ষ শ্রমিকরা আশা করেছিলেন, তাঁদের অভিজ্ঞতা সেখানে যদি কোনো ভাবে কাজে লাগে৷ সেই স্বপ্নের আগেই অবশ্য মুছে গেছে হিন্দমোটরের পুনরুজ্জীবনের আশা৷ এলাকার প্রাক্তন সাংসদ ও বাম শ্রমিক সংগঠনের নেতা শান্তশ্রী চট্টোপাধ্যায় বলেন, "হাইকোর্টে মামলা করেছি৷ মুখ্যমন্ত্রী বা শ্রমমন্ত্রী এ ব্যাপারে কর্ণপাত করেননি৷ কারখানার অধিকাংশ যন্ত্রপাতি নিয়ে চলে গেছে বা চুরি হয়েছে৷ ফলে নতুনভাবে এই কারখানা গড়ে তুলতে হবে৷ বড় কোনো বিনিয়োগ না এলে সেটা সম্ভব নয়৷” সুতরাং এই কারখানার অনেক শ্রমিকের কাছে সম্বল শুধু স্মৃতি৷
২০০৬ সালে অবসর নিয়েছেন দেবীপ্রসাদ বসু রায়৷ তিনি বলেন, "ওই সময় দিনে ১০০টি গাড়ি কারখানা থেকে বেরোত৷ ১৯৯৩ সাল অবধি আমরা এইভাবে কাজ করেছি৷ ১৪ হাজার শ্রমিক কাজ করত৷ অ্যাম্বাসাডর গাড়ির তখন বিপুল সুনাম ছিল৷ উদারীকরণে বাইরের গাড়ি ব্যবসা করতে ঢুকলে আমাদের গাড়ি মার খেতে শুরু করল৷ তারপর মালবাহী ট্রেকার গাড়ি, লাক্সারি কন্টেসাও তৈরি করা শুরু হয়েছিল৷”
বাম সরকারের পতনের পর পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূল শাসনের এক দশক পার হয়ে গিয়েছে৷ এখন হিন্দুস্তান মোটরসের একাংশে অন্য সংস্থা টিটাগড় ওয়াগন মেট্রোর কোচ তৈরির অর্ডারও পেয়েছে৷ কিন্তু তার সঙ্গে হিন্দমোটরের সম্পর্ক নেই৷ বরং হিন্দুস্তান মোটরস রয়ে গিয়েছে সেই তিমিরেই৷ সিঙ্গুরের প্রসঙ্গে দেবীপ্রসাদ বলেন, "সিঙ্গুরের ন্যানো গাড়ির বডি তৈরির অর্ডার পেয়ে গিয়েছিলাম৷ আমরা তৈরি শুরু করে দিয়েছিলাম৷ এতে আমাদের কারখানা আরও কাজ পেত৷ কিন্তু সিঙ্গুরের সম্ভাবনার সঙ্গে সঙ্গে সেটাও নষ্ট হয়ে গেল৷”
এলাকার প্রাক্তন বিধায়ক ও বিশিষ্ট সাংবাদিক প্রবীর ঘোষাল বলেন, "অপদার্থ ম্যানেজমেন্টের জন্যই কারখানার এই হাল৷ যে সময় অ্যাম্বাস্যাডর গাড়ির আধুনিকীকরণ দরকার ছিল তা করা হয়নি৷ কারখানা চালু রাখতে কোনো সরকারই যে খুব সদর্থক পদক্ষেপ নিয়েছে একথা বলা যায় না৷”
তবু বাম সরকারের আমলে চালু হওয়া হাজার দেড়েক টাকার মাসিক ভাতাই রামশঙ্কর যাদবদের কিছুটা রসদ যোগায়৷ নতুন গাড়ি শিল্পের কথা শুনে তিনি বলেন, "নতুন গাড়ির কারখানা হলে তাতে যদি আমাদের অভিজ্ঞতা কিছু কাজে লাগে৷ কিন্তু এখন বয়স হয়ে গেছে, কতটা পারব জানি না৷”
টেসলা নিয়ে এখনই খুব একটা আশা করতে রাজি নন আইআইএম-এর অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ অনুপ সিনহা৷ তিনি বলেন, "ইলন মাস্ক বাংলায় এলে সুবিধা হবে কিনা সেটা দেখে নিতে হবে৷ এখানে কতটা জমি নেবেন, কত কর্মসংস্থান হবে, অনুসারী শিল্পের সম্ভাবনা কী, সবটা বুঝে রাজ্যের এগোনো উচিত৷”