1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অসহায় মেয়েদের পাশে বড়মা

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১৭ অক্টোবর ২০১৮

মানবসেবার লক্ষ্যে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন শর্মিলা দেবী দাসী৷ কলকাতার কাছে সোদপুরে বিভিন্ন বয়সের মেয়েদের আশ্রমে লালন করেন তিনি৷ এর খরচের সিংহভাগই আসে ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে৷

https://p.dw.com/p/36gFo
Sharmila Devi
ছবি: DW/P. Samanta

ভারত সরকার ‘বেটি বাঁচাও, বেটি পড়াও' স্লোগান তুলেছে৷ এ নিয়ে দেশজুড়ে প্রচারও চলছে দীর্ঘদিন ধরে৷ কিন্তু, কন্যাসন্তানদের উপর সমাজের নিষ্ঠুরতার খবর পাওয়া যাচ্ছে অহরহ৷ এমনকি কন্যাভ্রূণেরও নিষ্কৃতি নেই৷ তবে এর বড় ব্যতিক্রমও আছে বৈকি৷ কন্যাসন্তানদেরও ভালোভাবে বাঁচার সুযোগ জোটে! সোদপুরের শর্মিলা দাসীর উদ্যোগ প্রমাণ করে মেয়েদেরও ভালোভাবে পড়ানো যায়!

নদিয়ার আরশিগঞ্জের মেয়ে শর্মিলা বহু বছর আগে সোদপুরে গৌড়ীয় মঠের আশ্রমে এসেছিলেন৷ সে সময় ৭ কাঠা জমির ওপর তৈরি করা হয়েছিল এই আশ্রম৷ প্রায় চার দশক আগে থেকে সাগর মহারাজের হাত ধরে এই আশ্রমের পথ চলা শুরু৷ তখন গুটিকয় অনাথ কন্যাশিশুকে নিয়ে এই আশ্রম তৈরি হয়েছিল৷ কয়েকজনের পৃষ্ঠপোষকতায় যখন আশ্রম একটু বড় আকার নিলো, তখন এখানে আসেন লীলা বিশ্বাস ওরফে শর্মিলা৷ স্নাতক হয়ে কলকাতায় নার্সিংয়ের ট্রেনিং নিতে এসেছিলেন৷

‘প্রথম বনগাঁয় একটি ছোট্ট শিশুকে পেয়েছিলাম সেই সংখ্যাটা ৫০-এর কাছাকাছি’

এক পরিচিতের হাত ধরে এই আশ্রমে আসেন তিনি৷ সেই থেকে শুরু৷ সাগর মহারাজের মানবসেবার লক্ষ্য দেখে মন বদলে যায় লীলার৷ থেকে যান এই আশ্রমে৷ তারপর থেকে এই দুই দশক নিরবচ্ছিন্নভাবে মানুষের সেবা করে চলেছেন শর্মিলা৷ এখন তাঁর আশ্রমে রয়েছে প্রায় ৫০ জন মেয়ে৷ তিনতলা বাড়ির একতলায় স্থাপন করেছেন প্রাথমিক বিদ্যালয় ‘সাগর শিক্ষা নিকেতন'৷ সেখানে এখন ছা্ত্রী ২৪২ জন৷ আছেন দশ জনের মতো শিক্ষক-শিক্ষিকা৷  

এত মেয়ে কোথা থেকে পেয়েছেন শর্মিলা? ডয়চে ভেলেকে শর্মিলা জানালেন, ‘‘প্রথম বনগাঁয় একটি ছোট্ট শিশুকে পেয়েছিলাম৷ এখন সেই সংখ্যাটা বেড়ে ৫০-এর কাছাকাছি৷ এদের মধ্যে সবাই যে অনাথ তা নয়, বাবা-মা এদের প্রতিপালনের দায়িত্ব নিতে পারেননি বলে এখানে রেখে গিয়েছেন৷ আবার আসামের হাইলাকান্দি থেকে যে মেয়েদের এনেছি, তাদের গল্পও আলাদা৷ আসামের আদিবাসী গোষ্ঠী রিয়াং৷ ওদের মাতৃতান্ত্রিক সমাজে মায়েরা আবার সংসার পাতে৷ বাবাও যখন একই পথে হাঁটে, তখন মেয়েদের দেখার কেউ থাকে না৷ ১৬ জন রিয়াং মেয়ে নিয়ে আসি৷'' 

‘ভালোই আছি, পড়াশোনা ও খেলাধুলো করতে পারি, পুজোয় ঠাকুর দেখতে যাই''

কীভাবে চলছে আশ্রম? শর্মিলা বলেন, ‘‘ভিক্ষে করতেই হয়৷ বেলঘরিয়া, টালিগঞ্জ, ভবানীপুর, সল্টলেক কত দূর পর্যন্ত ভিক্ষে করতে হয়৷ তবে তাতে সবটা চলে না৷কিছু সহৃদয় মানুষ সাহায্য করেন বলেই সম্ভব হয়৷ দৈনিক ১৪ কিলো চাল লাগে৷ এছাড়া পড়াশুনো থেকে শুরু করে অন্যান্য খরচ তো আছেই৷ স্কুলের শিক্ষকদের সামান্য কিছুও দিতে পারি না৷''

মেয়েরা এখন পড়াশোনা শিখছে৷ এরপর? এই প্রশ্নে চিন্তার ছাপ ফুটে ওঠে বছর বেয়াল্লিশের শর্মিলার মুখে৷ তাঁর মতে, বিয়ে একটা মেয়ের জীবনের সবকিছু হতে পারে না৷ তিনি আশ্রমের মেয়েদের বিয়ে দিয়ে দেখেছেন, সবাই সুখে নেই৷ তাই তাঁর লক্ষ্য মেয়েদের নিজেদের মতো করে প্রতিষ্ঠিত করা৷ তাই নাচ, গান, লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি কম্পিউটারও শেখাচ্ছেন মেয়েদের৷ কিন্তু মুশকিল একটাই– অর্থ আসবে কোথা থেকে? স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা বা ব্যক্তিগত উদ্যোগে কিছু টাকা এলেও সেটা সাময়িক৷ তারপরে?

কথায় কথায় তিনি বললেন, ‘‘এই যে মনিকা রিয়াং, ভালো গান গায়৷ কিন্তু গানের শিক্ষক দেওয়ার মতো সামর্থ্য কোথায়?''  

শর্মিলার কথায়, মেয়েদের মধ্যে অনেকেই লেখাপড়ায় ভালো৷ চব্বিশটা মেয়ে বাইরে অন্য স্কুলে পড়তে যায়৷     

বিয়ের আগেই আশ্রমে আসা, বিয়ের পরে স্বামী হয় নিরুদ্দেশ , বাচ্চা কোলে আবার আশ্রমে ফিরি’

প্রতিভা রিয়াং নবম শ্রেনির ছাত্রী৷ ডয়চে ভেলেকে প্রতিভা বলল, ‘‘এখানে ভালোই আছি৷ পড়াশোনা করতে পারি৷ খেলাধুলো করতে পারি৷ পুজোর সময় ঠাকুর দেখতে যাই৷'' আসামের কথা মনে পড়ে না? তার উত্তর, ‘‘প্রথম প্রথম মনে পড়ত৷ এখন আর মনে পড়ে না৷'' 

আশ্রমের সুচন্দ্রা গোস্বামীর জীবনের কাহিনী শোনা গেল তাঁর মুখ থেকেই৷ শর্মিলার আগেই এই আশ্রমে তাঁর আসা৷ তারপর দেখাশুনো করে বিয়েও হয়ে যায় একটা সময়৷ কিন্তু বিয়ের দু'বছর পরেই স্বামী নিরুদ্দেশ৷ বাচ্চা কোলে তিনি আবার আশ্রমে ফিরে আসেন৷

শর্মিলা জানান, খাদ্য আর বস্ত্রের জোগাড় হয়ত হয়ে যাবে, কিন্তু অসুখ হলেই চিন্তা৷ বললেন, ‘‘এ বছরই একসঙ্গে কতগুলো মেয়ে হামে ভুগল৷ আইডি হাসপাতালে কতগুলো দিন কাটালাম ওদের নিয়ে৷

এভাবেই আশ্রম সকলের আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে৷ সাংসদ সৌগত রায়ের সহায়তায় স্কুলের ঢালাইয়ের জন্য ৪ লক্ষ টাকা জুটেছে৷ ওই প্রথম এবং শেষ। সরকারি অনুদানের সৌভাগ্য আর হয়নি৷''

শর্মিলা সেই সৌভাগ্যের লক্ষ্যে ‘তপস্যা' না করে নিজেই ভিক্ষের ঝুলি কাঁধে বেরিয়ে পড়েন৷ এ জীবনটাও ভারী কষ্টের৷ প্রতিনিয়ত অপমানের কাঁটা পেরোতে হয় তাঁকে৷ তাই মেয়েদের জন্য কারিগরি প্রশিক্ষণ বা স্বনির্ভর যোজনার কথা ভেবেছেন তিনি৷ মেয়েরা আরেকটু বড় হোক, ততদিন তো অপেক্ষা করতে হবেই৷

সোদপুর ক্লাবের পক্ষ থেকে শর্মিলা আন্তর্জাতিক নারী দিবসে স্বীকৃতি পেয়েছেন৷ সোদপুর ক্লাবের তরফে পরিমল সরকার বলেন, ‘‘শর্মিলার অসাধারণ কাজের জন্য তাঁকে এই সম্মান জানিয়েছি আমরা৷ তাঁর এই উদ্যোগকে সাধুবাদ৷'' 

‘এই উদ্যোগকে সবারই স্বাগত জানানো উচিত'

এর বেশি পুরস্কার তিনি পাননি৷ দুর্গাষষ্ঠীর সন্ধেবেলা বিরাটির একটি পুজোকমিটির থেকে অর্থসাহায্য পেলেন শর্মিলা৷ সেখানে বহু সাধুবাদ পাওয়ার পরে ডয়চে ভেলেকে বললেন, ‘‘পুরস্কার নয়, তিরস্কারই পাওয়া উচিত৷ তবেই চলার পথে হাঁটার আনন্দ আসে৷'' এই পুজোকমিটির সঙ্গে যুক্ত আশ্রমের অন্যতম পৃষ্ঠপোষক সুজিত সাহা বলেন, ‘‘এই উদ্যোগকে সবারই স্বাগত জানানো উচিত৷''  

সুমিত্রা, শিপ্রা, সুমিতা, সোমা, শ্রেয়া, চৈতালিরা পুজোতে ঠাকুর দেখতে বেরোয়৷ ওদের নতুন জামাও হয়৷ সবটাই দাতাদের পৃষ্ঠপোষকতায়৷ তবে একদিন ওদের নিজেদের পায়ে দাঁড়াতেই হবে! শর্মিলার এটাই লক্ষ্য৷