বছর সাতেক আগের ঘটনা৷ ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে ক্যাপ্টেন আনন্দ বোড়াস দাবি করেছিলেন, পুরাকালে এক ঋষি বিমান আবিষ্কার করেছিলেন৷ সেই বিমান এক গ্রহ থেকে অন্য গ্রহে যেতো৷ আকাশে থেমে থাকতে পারতো৷ দিক পরিবর্তন করতো৷ এই দাবির পিছনে অনেক প্রমাণ আছে বললেও, একটি প্রমাণও তিনি দেখাতে পারেননি৷ খোদ বিজ্ঞান কংগ্রেসের মঞ্চে যদি কেউ এই দাবি করেন, তাহলে বিজ্ঞানচর্চা ও বিজ্ঞানমনস্কতার অবস্থা কী হবে?
শুধু আনন্দ বোড়সেকে দোষ দিয়ে কী হবে, ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর কথাই ধরা যাক৷ তিনি মহাভারতের যুগে ইন্টারনেট খুঁজে পেয়েছেন৷ ধৃতরাষ্ট্রকে সঞ্জয় যে যুদ্ধের তাৎক্ষণিক বার্তা দিয়ে যেতেন, তা ইন্টারনেটের মাধ্যমে বলে দাবি করে বসেন মুখ্যমন্ত্রী মশাই৷ উত্তরপ্রদেশের সাবেক উপমুখ্যমন্ত্রী দীনেশ শর্মা তো আরো একধাপ এগিয়ে গিয়ে বলেছিলেন, সীতার জন্ম প্রমাণ করে দেয়, রামায়ণের যুগে টেস্ট টিউব বেবির প্রযুক্তি জানা ছিল৷ পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতা দীলিপ ঘোষ গরুর দুধে সোনা খুঁজে পেয়েছিলেন৷
২০১৪ সালে ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত খবরে ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস জানাচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র দামোদরদাস মোদী দাবি করেছেন, মহাভারতের সময় জেনেটিক্স বিজ্ঞান ছিল৷ তাই তো কর্ণের জন্ম মায়ের গর্ভের বাইরে হতে পেরেছিল৷ গণেশ নিয়ে মোদীর বক্তব্য ছিল, ওই জামানায় কোনো প্লাস্টিক সার্জেন ছিলেন, যিনি মানুষের শরীরে হাতির মাথা রেখে প্লাস্টিক সার্জারি করেছিলেন৷
পোখরানে দ্বিতীয় পরমাণু বোমার পরীক্ষা করার পর প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী অটলবিহারী বাজপেয়ী আরেক প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রীর স্লোগানকে একটু বদলে নিয়ে বলেছিলেন, জয় জওয়ান, জয় কিষাণ, জয় বিজ্ঞান৷ না, এখন আর ওই স্লোগান কেউ দেন না৷ অবশ্য জয় বিজ্ঞানের স্লোগান দেয়া এক, আর জীবনের পথচলার ক্ষেত্রে বিজ্ঞানকে আঁকড়ে ধরা আরেক ঘটনা৷ ভারত মহাকাশে রকেট পাঠালে, মঙ্গল বা সূর্য অভিযানের কথা জানালে কয়েকদিন খুব আলোচনা হয়৷ অথবা নতুন কোনো যুদ্ধাস্ত্র আবিষ্কার করলেও হয়৷ না হলে, বিজ্ঞানের জয়গান করার থেকে বরং যাবতীয় অবৈজ্ঞানিক তত্ত্ব আবিষ্কারের হিড়িকে গা ভাসানো অনেক সহজ৷ তাতে সকলের উৎসাহও বেশি৷ কেউ বলছেন, কুরুক্ষেত্র যুদ্ধে নাকি পারমাণবিক বোমা ব্যবহার করা হয়েছিল৷ কারও দাবি, মহাভারতে যে সব বানের কথা আছে, সেগুলি নাকি একেকটা ক্ষেপণাস্ত্র৷ এই সব চরম অবৈজ্ঞানিক কথা যত বলা হয়, ততই অনেক মানুষের মনে তা গেঁথে যায়, আর ততই তারা বিজ্ঞান থেকে দূরে সরে যান৷
উনিশ শতকেও এমন হয়েছিল৷ টিকি রাখলে শরীরে বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয় থেকে শুরু করে রাজ্যের মনগড়া বিষয় সামনে আসছিল৷ তার মধ্যে না ছিল বিজ্ঞান, না ছিল কোনো যৌক্তিক ভিত্তি, ছিল শুধু অন্ধ বিশ্বাস৷ আবার যেন সেই দুইশ বছর আগের সময় ফিরে এসেছে৷ না হলে মহাকাব্যের কিছু রূপক নিয়ে এই ধরনের অবাস্তব কথা কেনই বা বলা হবে, কেনই বা বিশ্বাস করবে মানুষ৷ কেনই বা ধর্মীয় কিছু বিশ্বাসকে বিজ্ঞানের মোড়কে পেশ করা হবে৷ তাতে কি ধর্মীয় বিশ্বাস পোক্ত হয়? বিজ্ঞান বিশ্বাসের উপর চলে না, চলে প্রমাণের উপর, তার ভিত্তি থাকে যুক্তি৷ পুষ্পক রথকে তখনই আমরা বিমান বলব, যখন কোনো প্রমাণ থাকবে৷ জুল ভার্ন, আর্থার সি ক্লার্করা লিখেছিলেন বলে কি ধরে নিতে হবে, সেইসময় ওই জিনিসগুলোর অস্তিত্ব ছিল? কেউ যদি এটা বিশ্বাস করেন, তাহলে বলতে হবে, তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছেন৷ ওটা ছিল লেখকদের কল্পনা৷
শিক্ষা তো শুধু স্কুলে-কলেজে হয় না, শিক্ষা বাড়িতে, পাড়ায়, সঙ্গীদের কাছ থেকেও হয়৷ স্কুলে একরকম শিখে এসে বাড়িতে বা পাড়ায় বা নেতাদের কাছ থেকে যখন এই ধরনের অবৈজ্ঞানিক কথা একটি বাচ্চা শিখবে বা তাকে শেখানো হবে, তখন সে কী করবে? বাবা, মা, দাদা, নেতার কথাতেই বিশ্বাস করবে৷ সে প্রশ্ন করতে ভুলে যাবে৷ সে যুক্তি দিয়ে বিচার করবে না৷ তার শিক্ষা পূর্ণ হবে না৷ সে আস্থা ও বিশ্বাসের ঘেরাটোপে বন্দি হয়ে পড়বে৷
তাই দয়া করে কল্পনার সঙ্গে বিজ্ঞানকে, রূপকের সঙ্গে বিজ্ঞানকে মেলাবেন না৷ যে রাজনীতিকরা এই ধরনের কথা বলছেন, তারাই তো দেশের শিক্ষানীতি বানাচ্ছেন৷ তাই চিন্তা হওয়া স্বাভাবিক৷ বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা বাচ্চাদের মধ্যে রোপন করতে না পারলে তারা শুধু পিছিয়ে পড়বে তা-ই নয়, সারা জীবন ধরে যাবতীয় অবৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা, ধ্যানধারণার বোঝা নিয়ে তারা বেঁচে থাকবে৷
আসলে মুশকিল অন্য জায়গায়৷ বিজ্ঞান মানে যুক্তি৷ যুক্তি মানে প্রশ্ন করতে শেখা৷ প্রমাণের কষ্ঠিপাথরে সব যাচাই করে নেয়া৷ কিন্তু প্রশ্ন করলেই তো মুশকিল! তাহলে তো অনেক বিশ্বাসের ভিত টলে যাবে! অনেক কিছু আর ধ্রুব সত্য বলে চালানো যাবে না৷ আসল সত্য বাইরে এসে যাবে৷ একবার ভারতজুড়ে সে কী হিড়িক! পাথরের গণেশ দুধ খাচ্ছে৷ প্রায় সব দুধ গণেশকে খাওয়াতে শেষ হয়ে গেল৷ মন্দিরে মন্দিরে সে কী লাইন! তারপর দিনের শেষে একদা বিজ্ঞানের অধ্যাপক ও সাবেক মন্ত্রী মুরলী মনোহর জোশী বললেন, এটা হলো ক্যাপিলারি অ্যাকশন৷ নিছক বিজ্ঞান৷ এতে কোনো অলৌকিকতা নেই৷ প্রচুর মানুষ চরম হতাশ হলেন৷
আপনি মানতে পারেন, না-ও মানতে পারেন, বিজ্ঞান তার মতো চলবে৷ যুক্তি দিয়ে, প্রমাণ দিয়ে৷ বিশ্বাস বা আস্থা দিয়ে নয়৷ আর বাচ্চাদের যদি বিজ্ঞান না শেখানো হয়, প্রকৃত যুক্তিনির্ভর শিক্ষা না দেয়া হয়, তাহলে তারা পরীক্ষার পড়া তৈরি করার মতো বিজ্ঞান পড়বে, কিন্তু বিজ্ঞানমনষ্ক হবে না৷ তখন ওই রূপককে বিজ্ঞান বলে চালাবার চেষ্টা হবে৷ নিজেদের বিশ্বাস ও আস্থার বিষয় নিয়ে বৈজ্ঞানিক কুযুক্তি দেয়া হবে৷ তাতে শুধু পিছিয়ে পড়া ছাড়া আর কোনো লাভ হবে না৷
এক সময় তার বৈজ্ঞানিক চিন্তাভাবনা প্রচার করার জন্য জিওদার্নো ব্রুনোকে পুড়িয়ে মারা হয়েছিল৷ এখন দয়া করে বৈজ্ঞানিক ভাবনার জন্য কাউকে পুড়িয়ে মারবেন না, বরং নিজের অন্ধবিশ্বাসকে বিজ্ঞানের আগুনে পুড়িয়ে শুদ্ধ হোন৷ নিজের সন্তানদেরও সেই শিক্ষা দিন৷ মধুসূদন অনেক আগে বলেছিলেন, অলীক কুনাট্য রঙ্গে মজে লোক রাঢ় বঙ্গে৷ এই একুশ শতকে এসে অলীক কুনাট্যে, কুশিক্ষায় না মজে চিন্তা-চেতনাকে একটু বিজ্ঞানভিত্তিক করলে অনেক সমস্যা আপনেই মিটে যাবে৷