ভারতের অর্থনীতি বিপর্যস্ত, মানতে নারাজ মোদী সরকার
২৮ আগস্ট ২০১৯দেশের মন্দামুখী অর্থনীতি বিশেষজ্ঞদের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে৷ কেউ কেউ ব্যঙ্গের সুরে বলছেন, ‘‘অবস্থা অনেকটা রোমের মতো৷ রোম যখন জ্বলছে, তখন নিরো বাঁশি বাজাচ্ছেন!'' কটাক্ষ যাঁকে বা যাঁদের দিকে, তাঁরা অবশ্য আর্থিক মন্দার তত্ত্ব স্বীকার করতে চাইছেন না৷ অন্তত প্রকাশ্যে তো নয়ই৷ এতসবের মধ্যে হাটে হাঁড়ি ভেঙে দিয়েছে যাবতীয় উন্নয়নমূলক প্রকল্পের নিয়ামক সংস্থা ‘নীতি আয়োগ'৷ সংস্থার ভাইস চেয়ারম্যান রাজীব কুমার বলেছেন, ‘‘বর্তমানে দেশের অর্থনৈতিক দুর্দশা বিগত সাত দশকের রেকর্ড ভেঙে দিয়েছে৷'' তাৎপর্যপূর্ণ ভাবে নীতি আয়োগ-কর্তার এই বক্তব্যের পরেও কিন্তু, ‘ভাঙব তবে মচকাবো না' গোছের মনোভাব দেখিয়েছে কেন্দ্রীয় সরকার৷ খোদ অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ সংবাদ সম্মেলনে একগুচ্ছ ঘোষণা করে হাস্যকর ভাবে জানিয়েছেন, দেশের অর্থনীতি তরতরিয়ে বাড়ছে৷ তা নাকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের থেকেও ভালো গতিতে৷
এদিকে, দেশের শিল্প ক্ষেত্রে হাহাকার৷ উৎপাদন আছে, চাহিদা নেই৷ ১৯৯১-এর পর আর্থিক প্রবৃদ্ধির গতি এখন সবচেয়ে ধীর৷ গত ৪৫ বছরে সবচেয়ে বেশি বেকারত্ব৷ মুখ থুবড়ে পড়েছে অটোমোবাইল শিল্প, নির্মাণ শিল্প এবং নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যদ্রব্যের বাজার৷ কিছুদিন আগেই জিডিপি অগ্রগতির হার কৃত্রিমভাবে বাড়ানোর কথা জানিয়েছিলেন প্রাক্তন অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অরবিন্দ সুব্রহ্মণ্যম৷ স্বাধীনতার ৭২ বছর পরে ডলারের বদলে পাওয়া যায় ৭২ রুপি৷ এমনকি, মুকেশ আম্বানির মতো মস্ত শিল্পপতিও বলছেন, বেশকিছু বিনিয়োগ প্রস্তাব স্থগিত রাখতে বাধ্য হচ্ছেন৷ এই অবস্থায় আগামী ৫ বছরে দেশকে পাঁচ ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতিতে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি বিতরণ করছে কেন্দ্রীয় সরকার৷
ডয়চে ভেলেকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে অর্থনীতিবিদ অভিরূপ সরকার জানিয়েছেন, ‘‘মন্দা পরিস্থিতি থেকে বাঁচতে সরকার চেষ্টা করবে, সেটা স্বাভাবিক৷ কিন্তু, যে উপায় অবলম্বন করা হচ্ছে, সেটা ভুল৷ কেন্দ্রীয় ব্যাঙ্ক রিজার্ভ ব্যাঙ্কের কাছ থেকে ১.৭৬ লাখ কোটি টাকা আদায় করেছে সরকার৷ এটা উপযুক্ত ঔষধি নয়৷ এই পদ্ধতি প্রত্যেক বছর নেয়া যাবে না৷ ফলে এটা দীর্ঘকালীন সমাধান নয়৷'' তাঁর মতে, সমাধান হতে পারে গণ-ব্যবহারিক পণ্যের চাহিদা তৈরি করে৷ যা একেবারে তলানিতে ঠেকেছে৷ সেইসঙ্গে ধারাবাহিক রোজগারের উপায় নিশ্চিত করা এবং আয় বন্টন করা৷
যদিও ভিন্ন মতও রয়েছে৷ বলা হচ্ছে, শুধু ভারত নয়, বিশ্বের ১০টি বৃহৎ অর্থনীতির দেশও মন্দায় রয়েছে৷ তালিকায় রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইটালি, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও সিঙ্গাপুর৷
রাজনৈতিক বিশ্লেষক সুগত হাজরা ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘‘সারা পৃথিবীতেই আর্থিক অগ্রগতির হার নিম্নগামী৷ বিশ্বজুড়ে ডামাডোল চলছে৷ এই অবস্থায় ভারতের মতো বৃহৎ অর্থনীতিতে কিছুটা সমস্যা তো হবেই৷ অন্যান্য দেশের তুলনায় অগ্রগতির হার মোটের ওপর এখনও ভালো৷ মূল্যবৃদ্ধির সঙ্গে তলনা করলে ভয়াবহ কিছু নয়৷ আসলে দুর্নীতির পর্বত জমে ছিল, তারফলে আগে আর্থিক অগ্রগতির যে বুদবুদ দেখা যেত, এখন তা নেই৷ এতেই গেল গেল রব ওঠার কিছু নেই৷ এখন সরকার রেভিনিউ তুলছে৷ আরবিআই তো সরকারি ব্যাঙ্ক৷ খেয়াল রাখতে হবে এই টাকার যেন সদ্ব্যবহার হয়৷''
গত তিন বছরে কেন্দ্রীয় সরকার দেশের বিধিবহির্ভূত অর্থ ব্যবস্থাকে জোর জবরদস্তি বিধিসম্মত অর্থ ব্যবস্থায় পর্যবসিত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে৷ মূল লক্ষ্য, সর্বক্ষেত্র থেকে রাজস্ব আদায় করার ক্ষমতা করায়ত্ত করা৷ কেউ কেউ মনে করছেন, আরবিআই থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা সরকারি কোষাগারে নিয়ে বাজার থেকে ঋণ নেওয়ার ঝুঁকি এড়াতে চাইছে সরকার৷ কারণ সুদের হার না বাড়ানো৷ আসলে সরকার মনে করেছে, সুদের হার কম থাকলে মন্দায় গতি আসতে পারে৷ কিন্তু, এটা ভুল ধারণা৷ প্রকৃষ্ট উদাহরণ, ইউরোপ ও জাপানে সুদের হার প্রায় শূন্য৷ কিন্তু, মন্দায় ডুবছে যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইটালি, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, মেক্সিকো, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা ও সিঙ্গাপুর৷ সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা বাড়ানোই একমাত্র উপায়৷ সে জন্য সরকারকে নিজের খরচ বাড়াতে হবে৷ সবার আগে মেনে নিতে হবে, দেশ আর্থিক সংকটে পড়েছে৷