1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

অমীমাংসিত নদীপ্রশ্ন এবং নদী-অঙ্গীকার

পাভেল পার্থ
২ জুন ২০২৩

উজান থেকে ভাটিতে জলের স্মৃতি ভাঁজ করে করে বিকশিত হয় নদী৷ এক নদীর রেখা ধরে যাত্রাকালে সাক্ষাত হয় আরেক প্রবাহের সাথে৷ মেঘনা থেকে আগালে দেখা মেলে সুরমার৷ সুরমা থেকে কুশিয়ারা৷

https://p.dw.com/p/4S6QE
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে বংশী নদীর তীরে গড়ে ওঠা কাঠের বাজার৷
টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে বংশী নদীর তীরে গড়ে ওঠা কাঠের বাজার৷ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

কুশিয়ারা ডিঙিয়ে উত্তর-পূর্ব ভারতের বরাক৷ নাগাল্যান্ডের পাটকাই পাহাড়ের গভীর অরণ্যে ফোঁটা ফোঁটা জলবিন্দু নিয়ে বরাকের জন্ম৷ মণিপুরের লোগতাক হ্রদ থেকেও জল পেয়েছে বরাক৷ মণিপুরের লাইলাই গ্রাম থেকে তামেলং হয়ে চুরাচাঁদপুর জেলার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে আসামের বরাক ও কাছাড় উপত্যকায় প্রবেশ করে৷ তারপর আসামের করিমগঞ্জ জেলার ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে বাংলাদেশের সিলেট জেলার জকিগঞ্জ উপজেলার অমলসীদ এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে৷ এখানে বরাক নতুন নাম পায়৷ বাংলাদেশে এ নদী সুরমা ও কুশিয়ারা নামে প্রবাহিত হয়েছে৷ সুরমা পরে মেঘনার সাথে মিলিত হয়েছে এবং কুশিয়ারা-সুরমা-মেঘনার এই মিলিত প্রবাহই বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদীপ্রণালী৷ উজানের জল যতই ভাটিতে গড়ায় জনপদের স্তরে স্তরে থরে থরে গড়ে ওঠে পরিচয় ও কীর্তির স্মৃতি৷ নদী যেন জল ও পলির অনন্তলোক৷ নানান জলধারার জরায়ু থেকে বাংলাদেশের জন্ম৷ এই ভূগোলের গতি ও বিস্তার নদীময়৷ আর তাই ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ নিজের ‘নদীমাতৃক’ পরিচয় বিকশিত করেছে৷ নদীকে অস্বীকার করে কোনোভাবেই বাংলাদেশকে চিন্তা করা যায় না৷ কিন্তু তাই ঘটে চলেছে৷ ১৯৬০ সন থেকে৷ বিদ্যুৎ প্রকল্পের নামে কর্ণফুলী নদীর কলিজা থেঁতলে দেয়া হয়েছে৷ কখনো ফারাক্কা কখনো টিপাইমুখ বাঁধের বাহাদুরি নদীর উপর উন্নয়নের ছুরি চলেছে সবকালেই৷ উজান থেকে ভাটিতে বয়ে চলা নদীর জটিল গণিতকে ফালি ফালি করে কেটে ফেলা হয়েছে৷ দেশের একটি নদীও আর শরীর মনে সুস্থ নেই৷ অনেক নদীই হারিয়েছে আত্মীয় পরিজনদের৷ মেয়ের সামনে মা, পিতার সামনে পুত্র এভাবেই দিনেদুপুরে নদীগুলো খুন হয়েছে৷ বাংলাদেশের নদীপ্রণালী এক জটিল জলসার্কিট তৈরি করেছে যা দুনিয়ার অন্য কোনো নদীপ্রণালী দিয়ে বোঝা সম্ভব নয়৷ নীহার রঞ্জন রায় তাঁর ‘বাঙালির ইতিহাস : আদিপর্বে’ লিখেছেন, উৎসবের স্বরূপ অনুসন্ধানে পরিবেশ ও প্রকৃতি থকে যাত্রা শুরু করলে দেখা যায় বাংলাদেশ ভূখন্ডের মৌল প্রকৃতি নির্ধারণ করেছে নদনদী৷ কিন্তু আমরা কখনোই আমাদের নদীনির্ভর ভূগোলের মৌলপ্রকৃতি নদীর চোখে দেখতে চাইনি বা শিখিনি বা কোনো গুরুত্বই দেইনি৷ রাষ্ট্রের উন্নয়ন দর্শনে নদী নেই৷ নদীবিমুখ দশাসই সব উন্নয়ন বাহাদুরিই নদীময় এক দেশ থেকে আজ প্রতিদিন নদীদের নিখোঁজ করছে৷ রাষ্ট্রীয় নদীব্যবস্থাপনায় এখনো জবাবদিহি ও সুশাসন নিশ্চিত হয়নি৷ নদীগুলো আজ মূলত দখল ও দূষণে আক্রান্ত৷ উজান থেকে ভাটিতে গড়িয়ে পড়ার নদী-ব্যাকরণ ভেঙেচুরে খানখান৷ চলতি আলাপখানি নদীর রক্তাক্ত আহাজারিকে আগলে নদীকে ঘিরে নিশ্চুপ ব্যবস্থাপনাকে প্রশ্ন করছে৷ দেশের নানাপ্রান্তের কতক নদীবৃত্তান্তকে টেনে নদীকে ঘিরে জারি হওয়া কিছু অমীমাংসিত বাহাসকে হাজির করছে৷

নয়াউদারবাদী নদী-যন্ত্রণা

দেশ জুড়ে আজ পড়ে আছে মুমূর্ষু সারি সারি রক্তাক্ত নদীর লাশ৷ নয়াউদারবাদী উন্নয়ন মারদাঙ্গার ফলেই দেশের নদীগুলি আজ চুর্ণবিচূর্ণ৷ নদী দখল ও দূষণের প্রতিটি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত হওয়া জরুরি৷ শিল্প কারখানা, রাসায়নিক কৃষি, বিদ্যুৎ উৎপাদন, বৃহৎবাঁধ, অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্প, খনিজসম্পদ সন্ধান ও উত্তোলন, তেল-বিপর্যয় সরাসরি নদীকে বিষাক্ত করে এবং দূষণের অন্যায় আঘাতে মরণের দিকে ঠেলে দেয়৷ পণ্য বিশ্বায়িত দুনিয়ার নয়াউদারবাদী মনস্তত্ত্ব নদীকে দেখে পণ্যবোঝাই যান চলাচলের রাস্তা আর কারখানার বর্জ্য-ভাগাড় হিসেবে৷ এক বোতল কোক-পেপসি বা এক প্যাকেট ম্যাগী নুডলস তৈরিতে নদীর বুকে কতটুকু যন্ত্রণা আর আঘাত জমা হয় তার হিসাব আমরা কখনোই করিনি৷ প্লাস্টিক ভোগবাদিতায় অভ্যস্থ সভ্যতার বর্জ্যও প্লাস্টিক, আর তা নিদারুণভাবে ঢেকে ফেলছে নদীর জীবন৷ প্রমাণিত হয়েছে কোক-পেপসি বা নেসলের মতো বহুজাতিক কোম্পানির বাণিজ্যই মূলত প্লাস্টিক দূষণের জন্য দায়ী৷

নদ-নদীর ভিন্ন ভিন্ন স্রোতোধারায় এককালে সংসার পেতেছিল নানা নামের নানা বর্ণের মাছ৷ আজ দেশজুড়ে মাছেরা নেই৷ মাছের দেশে মাছেরা আজ ‘প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদানে’ পরিণত হয়েছে৷ দেশ জুড়ে মাটির তলায় কি জলের শরীরে জমা হয়েছে বহুজাতিক কোম্পানির শূণ্য বিষের বোতল৷ প্রাতিষ্ঠানিক বিশেষজ্ঞদের সূত্র থেকে জানা যায়, বাংলাদেশে থেকে প্রায় ১২০ প্রজাতির দেশি মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং আরো ৪৫ প্রজাতির মাছ হুমকীর সম্মুখীন৷ কৈ, শিং, মাগুর, চেলা, পাবদা, টেংরা, খলসে, বোয়াল, চিতল, টাটকিনি, গাঙচান্দা, আইড়, ফলসা, সিলুং, গুতুম, বাইম, উকল, শোল, মেনি, পুঁটি, কাংলা, ফলি, টাকি, দারকিনা, পিপড়াশইল, পুঁটিতর, রানী এরকম দেশি মাছের জগত আজ নদীর সীমানা থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে মগজের স্মৃতিতেই টিকে থাকছে৷

কর্পোরেট বাণিজ্যের কারণে মৃত্যুযন্ত্রণা পাড়ি দেয় বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ সুন্দরবন ও উপকূলের নদীগুলো৷ লাগাতার বিচারহীনভাবে নানা জলযান থেকে দেশের নানাপ্রান্তে জলের বুকে ছড়িয়ে পড়ছে তেল ও দমবন্ধ বর্জ্য৷ ১৯৮৮ সনের ১ জুলাই তেল কার্গো ফুটো হয়ে সুন্দরবনে ডিজেল ছড়িয়ে পড়ে এবং একই সনের ১০ আগস্ট সুন্দবনের মাজহার পয়েন্টে ট্যাংক সংঘর্ষে উচ্চ মাত্রার সালফারযুক্ত তেল ছড়িয়ে যায় সুন্দরবনে৷ ১৯৯৪ সনের আগস্টে মংলা বন্দরগামী একটি বিদেশি জাহাজ সুন্দরবনের পাশে বানীশান্তায় ডুবে যায় এবং ভাটিতে ২০ কি.মি. এলাকায় তেল ছড়িয়ে পড়ে ৷ ২০১৪ সনের ৯ ডিসেম্বর সুন্দরবন বনবিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের মৃগমারী এলাকায় ‘এমটি সাউদার্ন স্টার-৭' নামের এক কার্গোবোট ডুবে তিন লাখ ৫৭ হাজার ৬৬৪ লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে শ্যালা নদীসহ চাঁদপাই রেঞ্জের প্রায় বিশটি খাল, দুটি ভাড়ানি ও বনস্তরে৷ ১৯ জুন ২০১৫ চট্টগ্রামের বোয়ালখালী উপজেলার বেঙ্গুরা রেলস্টেশনের কাছে সায়েরাপুল এলাকায় দুটি ওয়াগন থেকে প্রায় ৮০ হাজার লিটার ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়েছে বোয়ালখালী খালে৷ জোয়ার-ভাটায় এ তেল ছড়িয়ে পড়ে দেশের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নদী কর্ণফুলীর পানির স্রোতে৷ ২০১৩ সনের ৩১ জুলাই চট্টগ্রামের দোহাজারীর কালুরঘাটে তেলবাহী ওয়াগন লাইনচ্যুত হয়ে কর্ণফুলীসহ আশেপাশে ছড়িয়ে পড়ে ফার্নেস তেল৷ ২০১২ সনে চট্টগ্রামের হাটহাজারী বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফার্নেস তেল ছড়িয়ে পড়ে হালদা নদীতে৷ ২০১২ সনে পতেঙ্গায় কর্ণফুলী নদীতে ‘ওটি মুন' নামের একটি তেলযান ডুবে ছড়িয়ে পড়ে তেল৷ ২০০৪ সনে বিদেশি এক জাহাজ কুতুবদিয়া উপকূলে বর্জ্য হিসেবে তেল ফেলে যায়৷

নদীকে দূষণের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি দিতে বহু নীতি ও নথি আছে৷ বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ এর ১৭ নং ধারায় বলা হয়েছে, সরকার নির্বাহী কমিটির সুপারিশের ভিত্তিতে জলাধার বা পানিধারক স্তরের সুরক্ষার জন্য যথাযথ অনুসন্ধান, পরীক্ষা নিরীক্ষা বা জরিপের ফলাফলের ভিত্তিতে, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, যেকোনো এলাকা বা উহার অংশবিশেষ বা পানিসম্পদ সংশ্লিষ্ট যেকোনো ভূমিকে নির্দিষ্ট সময়ের জন্য পানি সংকটাপন্ন এলাকা হিসাবে ঘোষণা করিতে পারিবে৷ পানি দূষণের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ এর ধারা সমূহ কার্যকর হবার কথা৷ বাংলাদেশ পানি আইন ২০১৩ অনুযায়ী আইন লংঘনের শাস্তি অনধিক পাঁচ বছর কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয়দণ্ড৷ পাশাপাশি জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ অনুযায়ী শিল্প কারখানা কর্তৃক কোনো নদী দূষণ ও নদীর অবৈধ দখল আইনত দণ্ডনীয়৷ কিন্তু নদীর উপর অন্যায়সমূহকে একেবারে গুরুত্বহীনভাবে বিবেচনা করা হয়৷ তাই এই অন্যায় দখল ও দূষণ থামছে না৷ দেখা যায় দেশীয় শিল্প কারখানাগুলি যাদের অবস্থান তুলনামূলকভাবে নদ-নদীর কাছাকাছি সেসব প্রতিষ্ঠানকেই অধিকাংশ সময় জরিমানা করে পরিবেশ অধিদপ্তর৷ কিন্তু বহুজাতিক কোম্পানির নদীদূষণকে প্রশ্ন করবার কোনো রাষ্ট্রীয় তৎপরতা শুরু হয়নি এখনো৷ অথচ এসব বহুজাতিক কোম্পানিরাই দেশের নদী দূষণ ও দখলের অন্যায় গণিতকে উসকে দিচ্ছে৷

উজানে বাঁধ, ভাটিতে মরণ

আন্তঃসীমান্ত নদীর উজানে বৃহৎ বাঁধ প্রকল্পের বিরুদ্ধে ভাটির বাংলাদেশ মূলত প্রথম প্রতিবাদী হয় ফারাক্কার বিরুদ্ধে৷ গঙ্গা ও পদ্মার অভিন্ন প্রবহমানতার দাবিতে৷ পরবর্তীতে তিস্তার পানিবন্টন নিয়ে দু'দেশের রাজনৈতিক দরবার নানাভাবে উচ্চকিত হয়েছে৷ বাংলাদেশের দীর্ঘতম নদীপ্রণালীর উজানেও বৃহৎ বাঁধ প্রকল্প৷ মেঘনা-সুরমা-কুশিয়ারার উজানে টিপাইমুখ বাঁধ নিয়েও এক নাগরিক প্রতিক্রিয়া সরব হয়েছিল৷ কিংবা ব্রহ্মপুত্রের উজানে চীনের পরিকল্পিত বৃহৎ প্রকল্প নিয়ে কিছু আলাপ জারি আছে৷ কিন্তু এর বাইরে দেশের অপরাপর আন্তঃসীমান্ত অভিন্ন নদীর উজানে কী ঘটছে তা আমাদের জানাবোঝা ও আলাপচারিতা কিংবা নাগরিক প্রতিক্রিয়ার বাইরেই থাকছে৷

২০১২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি ‘মন্তডু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের’ প্রথম ইউনিটের বাণিজ্যিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয়৷ উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পাহাড়ি জেলা জৈন্তিয়ার জোয়াই শহর থেকে ৪০ কি.মি. দূরে লেসকার ১০০ মিটার ভাটিতে মন্তডু, লামু ও উমসরিয়াং নদীর ত্রিমুখী সঙ্গমে পেডেকাংসাপ গ্রামের কাছে শুরু হয় ‘মন্তডু-লেসকা জলবিদ্যুৎ প্রকল্প'৷ এই নদীর ভাটিতে বাংলাদেশের সিলেটের সারী নদী৷ সারী নদীর উজানে এই বিদ্যুৎ প্রকল্পের কারণে বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ রাতারগুল জলাবনের বাস্তুতন্ত্রে বিরূপ প্রভাব পড়ছে৷ বিশেষ করে উজান থেকে ভাটিতে নেমে আসা স্রোেত ও প্রবাহ বাঁধাগ্রস্থ হওয়ায় সংবেদনশীল এ জলাবনের প্রাণ-প্রকৃতির বিকাশে সংকট তৈরি হয়েছে৷ ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২ এ মেঘালয় রাজ্যের পূর্ব খাসি পাহাড়ের উমইয়্যু নদীতে উদ্বোধন করা হয় ‘মাওফু জলবিদ্যুৎ প্রকল্প' ৷ উমইয়্যু নদীতে বাঁধ দিয়ে উক্ত বিদ্যুৎ প্রকল্প কারণে বাংলাদেশের সিলেটের ধলা নদীর প্রতিবেশীয় বৈশিষ্ট্য সংকটাপন্ন হয়ে পড়ছে৷ মেঘালয় পাহাড়ের উমইয়্যু পাহাড়ি নদীই হচ্ছে ভাটির বাংলাদেশের কোম্পানীগঞ্জের ধলা নদীর জলধারার মূল উৎস৷ কেবল বৃহৎবাঁধ বা বিদ্যুৎপ্রকল্প বা কারখানা নয়, অপরিকল্পিত চুনাপাথর ও কয়লা খননের দূষণেও বিপন্ন হয়ে ওঠছে অভিন্ন নদীগুলি৷ দেখা গেছে উত্তর-পূর্ব ভারতের মেঘালয়ে বাণিজ্যিক খনন, বাঁধ এবং বৃহৎ প্রকল্পের কারণে আন্তঃসীমান্ত নদীগুলি দূষিত হচ্ছে এবং এখানকার প্রাণ-প্রকৃতি নিশ্চিহ্ন হয়ে পড়ছে৷ এই প্রবল উন্নয়ন বাহাদুরির কারণে এখানকার আন্ত:সীমান্ত নদী থেকে বিলুপ্ত হয়েছে লোচ মাছ৷ উত্তর-পূর্ব ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের ধলাই জেলার চুলুবাড়ির হঠাৎবাজার থেকে মানিকবন্দর হয়ে এড়ারপার বাজার পর্যন্ত সড়কপথ উন্নয়নের কাজ হচ্ছে৷ নদীতে বাঁধ দিয়ে এই সেতু তৈরির ফলে ধলাই নদীর ভাটিতে বাংলাদেশ অংশ এর প্রবাহ কমে গেছে৷ কিন্তু আন্তঃসীমান্ত নদীসমূহকে নিয়ে এখনো ‘ভারত-বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশন’ সক্রিয় নয়৷ সকল আন্তঃসীমান্ত নদী এবং অভিন্ন জলধারাসমূহ এবং এর সাথে জড়িয়ে থাকা বহুমুখী প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য এখনো সামগ্রিকভাবে যৌথ নদী কমিশনের আলাপচারিতায় ওঠে আসেনি৷ উজান থেকে ভাটি, রাষ্ট্র এবং নাগরিক সকলকেই অভিন্ন নদীপ্রবাহের জন্য নদীমুখী চিন্তাকে প্রসারিত করতে হবে৷

তিস্তা নিয়ে তোলপাড়

ভারত থেকে বাংলাদেশ জুড়ে তিস্তা কেবল জলপ্রবাহ নয়, জড়িয়ে আছে মানবসহ আরও প্রাণের স্মৃতিপ্রবাহে৷ তিস্তা অববাহিকার আদি বসতিস্থাপনকারীদের ভেতর তিস্তা নামটি হরহামেশাই দেখা যায়৷ রাজবংশীদের ভেতর তিস্তামণি বর্মণ৷ এমনকি তা আরো জলপ্রবাহ ডিঙিয়ে হাজংদের নামের সাথেও একাত্ম হয়েছে৷ নেত্রকোণার সীমান্তে সংগঠিত ঐতিহাসিক টংক আন্দোলনের এক লড়াকু দ্রোহীর নাম তিস্তামণি হাজং৷ তিস্তা নদীর উজানে ১৯৮৫ সনে ভারতের গাজলডোবাতে ব্যারেজ এবং ভাটিতে বাংলাদেশের ডালিয়া-দোআনি ১৯৯০ সনে তিস্তা ব্যারেজ নির্মিত হয়৷ তিস্তার উপর উজান ও ভাটিতে নির্মিত এ দুটি ব্যারেজই হলো তিস্তার পানি মাপামাপির উজান-ভাটির রেখাবিন্দু৷ তিস্তার উজান কী ভাটিতে ব্যারেজের বাঁধা তৈরি করে তিস্তাকে আজ ‘পানিবন্টনের' জায়গা থেকে রাজনৈতিকভাবে বিচার করা হচ্ছে৷ কিউসেক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এক অভিন্ন নদীকে নিয়ে চলছে দ্বি-রাষ্ট্রিক বাহাস৷ কিন্তু কেউ তিস্তার অভিন্ন প্রাণপ্রবাহ সমুন্নত রাখতে নদীমুখী রাজনৈতিক অঙ্গীকারকে জোরালো করছে না৷

বন্দি ব্রহ্মপুত্রের মুক্তির আর্তি

১৯৬৯ সনের ২১ জুলাই৷ মানুষ প্রথম পা রাখে চাঁদের মাটিতে, চাঁদ থেকে নভোচারীরা পৃথিবীর যে জলপ্রবাহকে দেখতে পেয়েছিলেন তার নাম ব্রহ্মপুত্র৷ চাঁদ থেকে দেখা গেলেও ‘চন্দ্র বিজয়ের' ৫৪ বছর পর আজ এই জলপ্রবাহের বুকে দাঁড়িয়েও একে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না৷ দিনেদিনে বাংলাদেশ থেকে নিদারুণ নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে পৃথিবীর এক অবিস্মরণীয় নদী৷ বহু নাম ও পরিচয় থাকলেও মূলত ‘ব্রহ্মপুত্র’ নামে এবং ‘পুরুষ চরিত্রের’ এক জলপ্রবাহ হিসেবে এখনো আমাদের স্মৃতি ও জলজমানায় প্রতিষ্ঠিত হয়ে আছে এই ব্রহ্মপুত্র৷ দৈর্ঘ্য বিবেচনায় পৃথিবীতে ১৫ বা ২৩ তম এই নদ স্পর্শ করেছে তিব্বত, চীন, ভারত ও বাংলাদেশ৷ ৩৮৪৮ কি.মি দীর্ঘ এই নদ গড়ে তুলেছে সাত লাখ ১২ হাজার ৩৫ বর্গ কি.মি. পানি নিষ্কাশন অববাহিকা৷ বাংলাদেশ, ভারত ও চীন এই তিনটি দেশের ভেতর দিয়ে প্রবাহিত হলেও ব্রহ্মপুত্র ভারত, চীন, বাংলাদেশ ও ভূটান এই চারটি দেশে রয়েছে তার পাঁচ লাখ ৮৯ হাজার বর্গ কি.মি. পানিনিষ্কাশন এলাকা৷ ব্রহ্মপুত্র পৃথিবীর সর্বাধক বৃষ্টিপ্রবণ ও ভূমিকম্পপ্রবণ অঞ্চলে প্রবাহিত হওয়া এক পৌরাণিক জলধারা৷ যার পানি ও পলিতে গড়ে ওঠেছে বৌদ্ধ, হিন্দু, মুসলিম, সাংসারেক, জেন্টিলসহ বহু সর্বপ্রাণবাদী ধর্মদর্শনের বৈচিত্র্যময় নমুনা ও আখ্যান৷ ব্রহ্মপুত্র অণুজীব থেকে শুরু করে বহু বন্যপ্রাণের অবিস্মরণীয় আঁতুরঘর৷ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকাতেই মানুষ প্রথম খুঁজে পেয়েছে ধান, এখনো ব্রহ্মপুত্রের জীবন্ত-মৃত প্রবাহের ধারে টগবগ হয়ে আছে অজস্র হার না মানা ধানবীজ৷

বাংলাদেশ নদী রক্ষা কমিশন ব্রহ্মপুত্র দখলদারদের একটি তালিকা প্রকাশ করেছে তাদের ওয়েবসাইটে৷ এছাড়া ব্রহ্মপুত্র দখল করে রাখার বেশকিছু খবরও প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে৷ তাহলে ব্রহ্মপুত্রকে দখলমুক্ত করা যাচ্ছে না কেন? কেবল দখল নয়, শহরের কাছাকাছি ব্রহ্মপুত্র প্লাস্টিক ও রাসায়নিক দূষণেও বিপর্যস্ত৷ এছাড়াও ব্রহ্মপুত্র বিষ দিয়ে এবং নানাসময়ে অবৈধভাবে চলছে অপরিকল্পিত অবৈধ মৎস্য আহরণ৷ ১৯৮৮ সনে প্রথমবার ব্রহ্মপুত্র খননের উদ্যোগ নেয়া হয়৷ ২৭৫ কি.মি. দীর্ঘ পুরাতন ব্রহ্মপুত্র খনন হলে নাব্য ফিরে আসবে৷ ২০০৮ সনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ময়মনসিংহ সার্কিট হাউজ মাঠে এক নির্বাচনী জনসভায় ব্রহ্মপুত্র খননের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন৷ ২০০৯ সনে ময়মনসিংহের নাগরিক সমাজ নৌপরিবহনমন্ত্রীর সাথে ব্রহ্মপুত্র খনন নিয়ে মতবিনিময় করেন৷ ২০১০ সনে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের বিশেষজ্ঞদল ব্রহ্মপুত্র পরিদর্শন করেন৷ পরবর্তীতে ‘পুরাতন ব্রহ্মপুত্র নদ ড্রেজিং প্রকল্প' নামে একটি প্রকল্পও গ্রহণ করা হয়৷ আশা করবো এ ধরণের প্রকল্পগুলি কোনো ধরনের আমলাতান্ত্রিকতা এবং দুনীর্তি ছাড়া ব্রহ্মপুত্রের কাছে আমাদের দায় ও দায়িত্বের জায়গা থেকে দ্রুত ক্রিয়াশীল হবে৷

পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষক
পাভেল পার্থ, লেখক ও গবেষকছবি: Privat

বাঁকখালী দখলমুক্ত হবে?

বাংলাদেশের পূর্ব-পাহাড়ি হাইড্রলজিক্যাল অঞ্চলের এক গুরুত্বপূর্ণ নদী বাঁকখালী৷ দেশের পূর্ব পাহাড়ি অঞ্চলের এই নদী বান্দরবান ও কক্সবাজার জেলায় প্রবাহিত৷ উইকিপিডিয়া লিখেছে, উত্তর-পূর্ব ভারতের মিজোরামের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলীয় পাহাড় থেকে উৎসারিত কিছু স্রোতোধারা বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি পাহাড়ে মিলিত হয়ে বাঁকখালী নদী হিসেবে প্রবাহিত হয়েছে৷ বাঁকখালী নদী রামু ও কক্সবাজারের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরের মহেশখালী চ্যানেলে মিশেছে৷ ঐতিহাসিকভাবেই বাঁকখালী দুর্গতদের সুরক্ষা দিয়েছে৷ অষ্টাদশ শতকের শেষ দিকে বার্মা আরাকান দখল করায় উদ্বাস্তু বহু শরণার্থী বাঁকখালী তীরে আশ্রয় নেয়, ক্যাপ্টেন হিরাম কক্স তাদের পুনর্বাসন করেন৷ বাঁকখালী তীরে কক্সের সমাধিটিও হারিয়ে গেছে৷ পর্তুগীজ, ব্রিটিশ, আরব কী আরাকান বণিকেরা এই নদী দিয়ে বাণিজ্য ও উপনিবেশিকতার বিস্তার করেছে৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এই নদীতীরে ব্রিটিশ-মার্কিন সৈন্যরা নদীতীরে জেটি তৈরি করে৷ মুক্তিযুদ্ধে এই নদী রেখেছে অনন্য ভূমিকা৷ এ নদী তীরেই খুরুশকুলে ২৫৩.৩৫ একর জমি অধিগ্রহণ করে গড়ে তোলা হচ্ছে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য বিশ্বের অন্যতম আশ্রয়কেন্দ্র৷ কক্সবাজারের কৃষি ও খাদ্য উৎপাদনে বাঁকখালী নদীর ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ৷ এ নদীর অবববাহিকায় লবণ তৈরি হয় এবং মাছ চাষ হয়৷ দেশের আর সব নদীর মতোই বাঁকখালী আজ দখলে-দূষণে জীর্ণ, ছিন্নভিন্ন৷ ২০১৬ সনে উচ্চ আদালত বাঁকখালী নদী তীরের অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের নির্দেশ দেন৷ দখলদারদের ক্ষমতা ও বাহাদুরির প্রবল চাপে এতদিন দখলমুক্তকরেণর প্রক্রিয়া শুরু হতে পারেনি৷ দীর্ঘদিন বাদে ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২৩ অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদের কাজ শুরু হয়৷ বাঁকখালীর ঘটনা প্রমাণ করে রাষ্ট্র তৎপর হলে, জবাবদিহি নিশ্চিত হলে সকল নদীই দখলমুক্ত হওয়ার স্বপ্ন দেখতে পারে৷

নদী সত্তার প্রতি অঙ্গীকার

সংবিধানের ১৮(ক) ধারায় উল্লেখ আছে, রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যত নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন'৷  কিন্তু নদীর নিরাপত্তা ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে রাষ্ট্র কী সংবিধানের এই অঙ্গীকার সুরক্ষিত করতে পেরেছে? ২০১৯ সনে তুরাগসহ দেশের সকল নদ-নদীকে হাইকোর্ট ব্যক্তি-আইনি সত্তা বা জীবন্ত সত্তা হিসেবে রায় দিয়েছে৷ কিন্তু নদীর ন্যায়বিচার সুরক্ষায় আমরা এখনো তৎপর নই৷ দখল, দূষণ এবং নানামুখী বাঁধার শেকল থেকে নদীমুক্তির প্রশ্ন আমাদের জাতীয় পরিবেশ ও সাংস্কৃতিক মুক্তির সাথে জড়িত৷ উৎপাদন, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, সংস্কার কিংবা বিনির্মাণ সবকিছুই নদীমুখী হওয়া জরুরি৷ বিদ্যায়তন থেকে নীতিনির্ধারণী, সামাজিক বিকাশ ও জনসংস্কৃতির ময়দান সর্বত্র নদীকে আরো জীবন্ত কায়দায় পাঠ করা জরুরি৷ জাতীয় বাজেট, নির্বাচনী ইশতেহার এবং উন্নয়ন পরিকল্পনা ও রাজনৈতিক অঙ্গীকারে সুস্পষ্ট নদীচিন্তা থাকা জরুরি৷ নদীর জীবন্ত সত্তার প্রতি আমাদের তৎপরতাগুলো ‘নদী-অঙ্গীকার' হিসেবে জেগে ওঠুক৷

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য