অভিযুক্ত ব্যক্তির জাতীয়তা প্রকাশ করা উচিত?
৩০ জুলাই ২০১৯এই ঘটনা জার্মান সমাজে আগে থেকেই চালু থাকা বিতর্কের উপর বিশাল প্রভাব ফেলবে, বলে মনে করছেন ডয়চে ভেলের প্রধান সম্পাদক ইনেস পোল৷ এ কারণে গণমাধ্যমে সত্য ঘটনাটি পুরোপুরি প্রকাশ করা গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন তিনি৷
সোমবার ফ্রাঙ্কফুর্টের প্রধান রেলস্টেশনের প্ল্যাটফর্মে মায়ের সঙ্গে দাঁড়িয়ে ছিল আট বছর বয়সি এক শিশু৷ তাদের দুজনকেই স্টেশনে ঢুকতে থাকা একটি দ্রুতগামী ট্রেনের সামনে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়া হয়েছিল৷ এই ঘটনায় মা কোনোরকমে রেললাইন থেকে নিজেকে সরিয়ে নিতে পারলেও শিশুটি বাঁচতে পারেনি৷
এরপর অভিযুক্ত ব্যক্তি পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন৷ কিন্তু স্টেশনে থাকা অন্য যাত্রীরা তাকে ধরে ফেলেন৷ এর কয়েক ঘণ্টা পর পুলিশের এক মুখপাত্র জানান, অভিযুক্তের বয়স ৪০ এবং তিনি ঐ মা ও তার সন্তানের পরিচিত ছিলেন না৷ অভিযুক্ত ব্যক্তি ইরিত্রিয়া থেকে এসেছেন বলেও জানা যায়৷
সত্য প্রকাশ করা নিরপেক্ষ সাংবাদিকদের একটি নৈতিক দায়িত্ব৷ গণমাধ্যমে প্রকাশিত - কিংবা অপ্রকাশিত - তথ্য সমাজে বিতর্কের দিক নির্ধারণ করে দেয়৷ সেজন্য জার্মান গণমাধ্যমকে একটি নৈতিক নীতিমালা অনুসরণ করতে হয় এবং তারা স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে সর্বজনস্বীকৃত একটি প্রেস কোড মেনে চলে৷
ঐ প্রেস কোডে বলা হয়েছে, একটি সহিংস অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তির ‘অরিজিন' অর্থাৎ তাঁর পরিচয়, গণমাধ্যমে প্রকাশ করা যাবে, যদি এই তথ্য ‘কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট হয় কিংবা এর সঙ্গে সাধারণ নাগরিকের আইনসঙ্গত স্বার্থ জড়িত থাকে'৷
সুতরাং অভিযুক্ত যখন ইরিত্রিয়ার নাগরিক তখন কীভাবে এই প্রেস কোড মানা হবে? ডিডাব্লিউর কি এ নিয়ে প্রতিবেদন করা উচিত?
২০১৫ সালে জার্মান চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেল শরণার্থীদের জন্য জার্মানির দরজা খুলে দেয়ার পর থেকে জার্মানি পরিবর্তিত হয়ে গেছে৷ কিছু জার্মান আছেন, যাঁরা নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করছেন৷ ‘বিদেশিদের' কারণে জার্মানি হুমকির মুখে রয়েছে বলে মনে করেন তাঁরা৷ ফলে একজন শরণার্থী যখন কোনো অপরাধ করেন সেটিকে তাঁরা তাঁদের সেই দাবির পক্ষে প্রমাণ হিসেবে উপস্থাপন করেন৷
তবে এমন জার্মানও আছেন যাঁরা যুদ্ধবিদ্ধস্ত দেশ থেকে আসা শরণার্থীদের আরও ভালো সেবা দেয়া দরকার বলেও মনে করেন৷
জার্মানির রাজনীতিবিদদের একটি অংশও ম্যার্কেলের শরণার্থী নীতির বিরুদ্ধে জনমতকে কাজে লাগানোর চেষ্টা করেছেন৷
এমন পরিস্থিতিতে একটি প্রশ্ন সামনে চলে আসে৷ সেটি হচ্ছে, কখন গণমাধ্যমের অভিযুক্ত ব্যক্তির জাতীয়তা প্রকাশ করা উচিত? এবং কখন এই তথ্য ‘সাধারণ নাগরিকের আইনসঙ্গত স্বার্থ সংশ্লিষ্ট' বিষয় হয়ে ওঠে৷
জার্মানি একটি সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে৷ একদিকে জনগণের নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে সরকারকে ভাবতে হচ্ছে, অন্যদিক একটি উন্নত দেশের পরিচয় ধরে রাখার বিষয়ও রয়েছে৷ এছাড়া গত কয়েক দশকের সামাজিক উন্নয়ন (যেমন লিঙ্গ সমতা) রক্ষায় কোথায় এবং কীভাবে একটি স্পষ্ট রেখা টানতে হবে, তা বুঝে উঠতে পারছেনা জার্মানি৷
এই অবস্থায় সত্য ও নিরপেক্ষভাবে সংবাদ প্রকাশ করে গণমাধ্যমকে জার্মানির এমন সমস্যা তুলে ধরতে হবে৷ ফলে বিতর্কিত ব্যক্তিদের মন্তব্যও আমাদের প্রকাশ করতে হবে৷ তাঁদের ভয়, আশঙ্কা এবং তাঁরা কার বিরুদ্ধে লড়তে চায়, তা বুঝতে হবে ও প্রচার করতে হবে৷
ফ্রাঙ্কফুর্টে শিশু হত্যার ঘটনা জার্মানিতে শরণার্থী সংক্রান্ত বিতর্ককে আরও উসকে দেবে৷ কিছু গণমাধ্যম শিরোনামের খাতিরে বর্ণবাদী মতবাদকে ইন্ধন জোগানোর মতো খবর প্রকাশ করবে, যা নিন্দনীয় এবং এর সঙ্গে প্রেস কোডে উল্লেখ থাকা ‘জনস্বার্থ' বিষয়টির সম্পর্ক নেই৷
অবশ্য ফ্রাঙ্কফুর্টের ঘটনায় অভিযুক্ত ব্যক্তির ইরিত্রিয়া থেকে আসার বিষয়টি যদি সত্যি হয় তাহলে দায়িত্বের কারণেই আমাদের তা প্রকাশ করতে হবে৷
তবে বাস্তবতা হচ্ছে, এমন তথ্য নিয়ে আলোচনার কারণে একজন শিশুর দুর্ভাগ্য ও তার পরিবারের প্রতি সবার সহানুভূতিশীল হওয়ার যে বিষয়, তা আড়াল হয়ে যায়৷
ইনেস পোল/জেডএইচ