অপুর গ্রামে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ
৮ নভেম্বর ২০১৯কলকাতা, তথা ভারতের সঙ্গে জার্মান পরিচালক ফলকার শ্ল্যোনডর্ফের পরিচয়ের বয়স ঠিক চার দশক৷ সেই বছর নোবেলজয়ী জার্মান সাহিত্যিক গ্যুন্টার গ্রাস–এর বিখ্যাত সৃষ্টি ‘ডি ব্লেশট্রমেল’, বা ‘টিন ড্রাম’ অবলম্বনে সিনেমা বানিয়েছিলেন ফলকার শ্ল্যোনডর্ফ৷ সেই ছবি নিয়ে তিনি এসেছিলেন ভারতের সিনেমা রাজধানী মুম্বইয়ে৷ অস্কার পুরস্কার বিজয়ী সেই ছবির যে মূল সম্পাদিত সংস্করণ, যা আগে ভারতে কখনও দেখানো হয়নি, সেই পূর্ণাঙ্গ ছবিটি দেখা যাবে এবার কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে৷
সত্যজিৎ রায়, ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেনেদের চলচ্চিত্র আন্দোলন ১৯৯৫ সালে পূর্ণতা পেয়েছিল এক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে৷ সেই উৎসব এবার ২৫ বছরে পা দিল৷ গুরুত্বপূর্ণ এই উদযাপনে কেন্দ্রীয় দেশ জার্মানি৷ যে সুবাদে নতুন পুরনো মিলিয়ে এক গুচ্ছ জার্মান ছবি দেখার সুযোগ পাওয়া যাবে৷ বাছাই তালিকায় থাকবে ধ্রুপদী ও আধুনিক জার্মান সিনেমা, নব্য ধারার জার্মান সিনেমা, ভারত-জার্মানি যৌথ প্রযোজনায় তৈরি ছবি, সঙ্গে জার্মান তথ্যচিত্র এবং অ্যানিমেশন ছবি৷ বিশ্ববিখ্যাত জার্মান পরিচালক আলেক্সান্ডার ক্লুগের রেট্রোসপেক্টিভ থাকবে এবং ‘ডিরেক্টর্স চয়েস’ নামে একটি বিশেষ বিভাগে ফলকার শ্ল্যোনডর্ফ-এর বাছাই সাতটি ছবি৷
কলকাতার গ্যোটে ইনস্টিটিউটের প্রোগ্রাম অফিসার শর্মিষ্ঠা সরকার ডয়চে ভেলে–কে জানালেন, ‘টিন ড্রাম’ ছাড়াও থাকছে আর্থার মিলার-এর নাটক ‘ডেথ অফ এ সেল্সম্যান’ অবলম্বনে শ্ল্যোনডর্ফের ছবি, মার্গারেট অ্যাটউডের উপন্যাস অবলম্বনে ‘হ্যান্ডমেইডস টেল’, লেবাননের রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের সময় বেইরুটে শুটিং করা ‘সার্কেল অফ ডিসিট’, তাঁর নির্দেশিত ফরাসি ছবি ‘ডিপ্লোমেসি’ এবং শ্ল্যোনডর্ফের ব্যক্তিগত পছন্দের ছবি ‘হোমোফাবে’৷
চলচ্চিত্র উৎসব উপলক্ষে এলেও শ্ল্যোনডর্ফ তাঁর নতুন তথ্যচিত্রের কাজও করে যাচ্ছেন এই যাত্রায়৷ গিয়েছিলেন ঝাড়খণ্ডে, সেই ছবির শুটিংয়ে৷ যদিও এখনই ছবিটি নিয়ে তিনি কোনও প্রচার চাইছেন না, কিন্তু ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন ছবিটির বিষয় সম্পর্কে৷ সে এক অভিনব বিষয়৷ কৃষিজমির পুনরুজ্জীবন৷ ২০১৮ সালে বিকল্প নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অর্থনীতিবিদ টোনি রিনাল্ডোর সঙ্গে আলাপের সুবাদে যে বিষয়টি তিনি জানতে পারেন৷ যে নতুন গাছ রোপন করে নয়, মাটির তলায় থেকে যাওয়া পুরনো গাছের শিকড় থেকেই সবুজায়ন সম্ভব৷ চোখের আড়ালে, মাটির নিচে এরকম শিকড়ের রাজত্ব সজীব থাকে, যার নাম ওঁরা দিয়েছেন ‘আন্ডারগ্রাউন্ড ফরেস্ট’৷ এর আগে এই ধরনের বনসৃজনের কর্মকাণ্ড শ্ল্যোনডর্ফ ছবিতে ধরেছেন আফ্রিকার মালি, ঘানা, বুর্কিনা ফাসোতে৷ এবার গন্তব্য ছিল ঝাড়খণ্ড৷ শুটিং করলেন সেখানে৷
কথা বলতে গিয়ে শ্ল্যোনডর্ফ বার বার বলছিলেন গ্রামজীবনের গুরুত্বের কথা৷ এমন এক প্রাকৃতিক পরিবেশে ছোট বাচ্চাদের বেড়ে ওঠার প্রয়োজনীয়তার কথা, যেখানে সব গাছ, সব পশুপাখির নাম বাচ্চারা জানবে৷ প্রতিবেশীদের নাম জানবে৷ মানবিক সম্পর্কগুলো বুঝবে৷ পরিচালক মৃণাল সেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন শ্ল্যোনডর্ফ, সত্যজিৎ রায়ের একান্ত ভক্ত৷ সত্যজিতের ‘অপু ত্রয়ী' তাঁর প্রিয় ছবি৷ বলছিলেন, বড় শহরে নয়, ওই অপুর গ্রামে ফিরে যেতে হবে৷ আজকের এই ডিজিটাল যুগের যে হাজার সমস্যা, তার একমাত্র প্রতিষেধক ওই গ্রামজীবন৷ সেখানেই শান্তি৷