‘অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির জন্য অন্তর্ভূক্তিমূলক রাজনীতি'
১৯ জানুয়ারি ২০২৪ডয়চে ভেলে: নতুন সরকারের সামনে সবচেয়ে বড় অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জগুলো কী কী?
ড. মোস্তাফিজুর রহমান: প্রথম চ্যালেঞ্জ হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, যদিও নভেম্বরের পর থেকে মূল্যস্ফীতি সামান্য কমতে শুরু করেছে। কিন্তু এটা কমার হার খুবই শ্লথ। মূল্যস্ফীতি অনেক উপরের স্তরে আছে। সেখান থেকে যদি কিছুটা কমেও মূল্যস্তর কিন্তু উপরেই থাকছে। সুতরাং সেটা একটা চ্যালেঞ্জ। যেহেতু স্থির আয়, নিম্ন আয়ের মানুষের ওপর এটার অভিঘাত বেশি হচ্ছে। তাই এটা নিয়ন্ত্রণ বড় চ্যালেঞ্জ।
নতুন মুদ্রানীতি মূল্যস্ফীতি কমাতে কতটা ভূমিকা রাখবে?
বাংলাদেশ ব্যাংক আগামী ছয় মাসের মুদ্রানীতি দিয়েছে। সেখানে তারা বলেছে, সংকোচন নীতি গ্রহণ করে তারা মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করবে। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু সেটা করতে গিয়ে সুদের হার বাড়াবে। কিন্তু সেটা করতে গেলে আবার বিনিয়োগের ওপর প্রভাব পড়বে। সেগুলো মাথায় রেখে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এবং রাজস্বনীতি, মুদ্রানীতির সমন্বয় করে মূল্যস্ফীতি কমাতে হবে। সংকোচন নীতি বাস্তবায়ন করতে হবে, আবার বিনিয়োগও চাঙ্গা রাখতে হবে যাতে কর্মসংস্থান ও আয় বাড়ে। এটা একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ কোনটা?
আমাদের ব্যালেন্স অব পেমেন্ট। আমাদের রিজার্ভ, যেটার কারণে অনেক নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। এলসি খোলায় সমস্যা হচ্ছে। আমদানি কম করার কারণে সরবরাহ চেইনের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ব্যত্যয় ঘটছে। তাই বাইরের দেশের সঙ্গে লেনদেনের যে ভারসাম্য, এটাকে স্থিতিবস্থায় নিয়ে আসতে হবে। সেটা করতে হলে মুদ্রানীতিতে বলা হয়েছে টাকার অবনমন অব্যাহত রাখবে। এটা তাদের একটা করনীয়, বাইরের খাতের ভারসাম্য যাতে ভালো থাকে, রেমিট্যান্স যাতে আরো বেশি আনা যায়, রিজার্ভ যাতে আরো ভালো থাকে।
এরপরের চ্যালেঞ্জ কী?
তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো, বিনিয়োগ। এখন বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, তারা ক্রেডিট গ্রোথ কমাবে, যাতে মূল্যস্ফীতির চাপ কমে। এটা তারা ১০ শতাংশে নিয়ে আসবে। এক সময় ১৪ শতাংশের টার্গেট ছিল। কিন্তু এই ক্রেডিট গ্রোথ কমালে সেটা আবার বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সেখানে অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা নিয়ে কীভাবে প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তিমত্তা বাড়বে, কস্ট অব গ্রিন বিজনেস কমানো, ইতিবাচক ব্যবসা পরিস্থিতি, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা- এগুলো দিয়ে বিনিয়োগকে চাঙ্গা করতে হবে।
আর কোনো চ্যালেঞ্জ দেখছেন?
আমার বিবেচনায় চার নাম্বার চ্যালেঞ্জ হলো আমাদের যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি এগুলোকে শক্তিশালী করা, যার ফলে কম আয়ের মানুষের ওপর নেতিবাচক প্রভাব কম পড়ে। আর সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার গুণগত মান নিয়ে বিগত সময়ে অনেক সমস্যা হয়েছে। এটা আমাদের মুদ্রানীতি বলি, রাজস্ব কম আহরণ বলি, ব্যাংকের ঋণ খেলাপের অবস্থা বলি- এইসব সুশাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনার গুণগত মান বাড়াতে হবে।
বিদেশি ঋণের চাপ বেড়ে যাচ্ছে। রাজস্ব আহরণে অদক্ষতা। এই দুইটি ক্ষেত্রে কি আমরা সঠিক পথে এগোচ্ছি?
এটা ঠিক যে, আমরা অবকাঠামোর জন্য অনেক ঋণ নিয়েছি। অবকাঠামো আমাদের প্রয়োজন। কিন্তু অনেক সময় দেখা গেছে যে, আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে ধীর গতি, এর ফলে প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি। তার ফলে আমরা ঋণ করে যেগুলো করেছি সেই ঋণের দায়ভার বৃদ্ধি। এটা ঋণের চাপ বৃদ্ধির কারণ। অবকাঠামো আমাদের করতে হবে। কিন্তু সাশ্রয়ীভাবে করা, সুশাসনের সঙ্গে করা, সময়মতো শেষ করা- এইসব ক্ষেত্রে আমাদের দুর্বলতা ছিল। এটা আমাদের অলরেডি ঝুঁকির মধ্যে ঠেলে দিচ্ছে। কারণ, রিজার্ভও আমাদের কম। এখান থেকে যদি চার-পাঁচ বিলিয়ন ডলার আমাদের দায় পরিশোধে চলে যায়, তাহলে আমদানি করার জন্য আমার অর্থ তো কমে যাবে, সেটা আমাদের জন্য ঝুঁকি। সুতরাং বাস্তবায়নের জন্য দক্ষতা, জবাবদিহিতা, সুশাসন এগুলোর দিকে নজর দিতে হবে।
আর রাজস্ব আহরণের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ কর আমাদের অনেক কম। সে ব্যাাপারে পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছু যে পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে না, তা নয়। কিন্তু এটা যতটা গুরুত্বের সঙ্গে নেয়া প্রয়োজন, সেটা নেয়া হচ্ছে না। আর ঋণখেলাপি, করখেলাপি, টাকা পাচারকারী- এদের ব্যাপারে আমাদের দুর্নীতি দমন কমিশন আছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ইন্টেলিজেন্স ইউনিট আছে, এনবিআরের ট্র্যান্সফার প্রাইসিং সেল আছে, আরো অনেক প্রতিষ্ঠান আছে। তাদের স্বাধীনভাবে দক্ষতার সঙ্গে, স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করার অনেক জায়গা আছে।
দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে কি সরকার এখন সঠিক পলিসিতে আছে?
পলিসির দুর্বলতার কারণে পদক্ষেপের দুর্বলতার কারণেই তো এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। এখন কিছু কিছু পদক্ষেপ নিচ্ছে। সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি নেয়া হচ্ছে। তবে এগুলো পর্যাপ্ত নয়। এই যে চালের দাম বাড়ছে, এক্ষেত্রে চাহিদা কত, উৎপাদন কত, সরবরাহ কত, আমদানি কত, মজুত কত- এইসব তথ্য-উপাত্তের ঘাটতি আছে। সেটা জানা না থাকলে তো বাজারের ব্যাপারে সঠিক পদক্ষেপ নেয়া যায় না।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটা বিভেদ তৈরি হয়ে আছে। অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য এই বিভেদ দূর করা কতটা জরুরি?
একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক রাজনীতি একটা অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন। তা না হলে আমাদের দ্বন্দ্ব-সংঘাত যদি থাকে, তখন অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড ব্যাহত হয়। সুতরাং একটা সমঝোতামূলক রাজনৈতিক পরিস্থিতি অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে।
নির্বাচনকে নিয়ে আমরা যা-ই বলি না কেন, ইউরোপ-অ্যামেরিকার সঙ্গে তো একটা দূরত্ব তৈরি হচ্ছে- সেটা দূর করা বা সম্পর্ক আরো ভালো করা কতটা জরুরি?
আমাদের সবার সঙ্গে সদ্ভাব রাখতে হবে। আমাদের যারা পার্টনার আছে, তাদের সঙ্গে একটা ইতিবাচক সম্পর্ক আমাদেরই অনুকুলে যাবে। তাদের যে শঙ্কাগুলো আছে, সেগুলো নিরসন করাও আমাদের প্রয়োজন। লেবার রাইটস নিয়ে তারা দুশ্চিন্তার কথা বলেছে। ট্রেড ইউনিয়ন রাইট, কর্ম পরিবেশ- যে জায়গাগুলোতে তারা তাদের দুশ্চিন্তার কথা বলেছেন আমাদের চেষ্টা করতে হবে সেগুলো আমরা কীভাবে দূর করতে পারি। তারা আমাদের উন্নয়ন সহযোগী। তাদের দেশগুলোতে আমরা রপ্তানি বেশি করি। এইসব কারণে আমার মনে হয় যে, তাদের সঙ্গে সম্পর্কটা ইতিবাচকভাবে রাখা। এটা চীন হোক, ভারত হোক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হোক, রাশিয়া হোক এখানে সম্পর্কের একটা ভারসাম্য রাখা আমাদের জন্যই ইতিবাচক।