1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

১৪ বছর পরও শিক্ষকের আঘাতে চোখ হারায় আয়াতুল

হারুন উর রশীদ স্বপন ঢাকা
২৭ জুন ২০২৪

চট্টগ্রামের বোয়ালিয়া উপজেলার এক মাদ্রাসা শিক্ষার্থী শিক্ষকের নির্যাতনে এক চোখের দৃষ্টি হারিয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে।

https://p.dw.com/p/4hXyt
একটি খালি ক্লাসরুম
বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয ২০১০ সালে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনার পরের বছর এই নিয়ে নীতিমালা জারি করা হয়ছবি: Mohammad Ponir Hossain/REUTERS

অথচ বাংলাদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীদের শরীরে আঘাত করা আইনত দণ্ডনীয়৷

বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হয ২০১০ সালে৷ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই নির্দেশনার পরের বছর এই নিয়ে নীতিমালা জারি করা হয়। এর আগে বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট (ব্ল্যাস্ট)-এর এক রিটের ফলে উচ্চ আদালত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন বন্ধের আদেশ দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সেই আদেশ এবং নীতিমালা সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রযোজ্য।

নীতি মালায় বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের বেত্রাঘাতসহ কোনো ধরনের আঘাত করা যাবে না। হাত-পা দিয়েও আঘাত করা যাবে না। তাদের কান ধরে উঠবস করানো, চিমটি, আচড়, কামড় দেয়া যাবে না। চুল ধরে টানা, চুল কেটে দেয়া, কান মলা, হাঁটু গেড়ে বসানো, চক ডাস্টার ছুড়ে মারা, ঘাড় ধাক্কা দেয়া, সূর্যের দিকে মুখ করে দাঁড় করানোসহ কোনো ধরনের শারীরিক নির্যাতন করা যাবে না।

এই আদেশে কোনো ধরনের মানসিক নির্যাতনও নিষিদ্ধ করা হয়। এর মধ্যে আছে কটুক্তি, অশালীন মন্তব্য, আপত্তিকর অঙ্গভঙ্গি, ধর্ম, বর্ণ, গোত্র,পেশা , বংশ পচিয় নিয়ে আপত্তিকর মন্তব্য।

ভারতে নিয়ে শেষ চেষ্টা করতে চাই: সাজ্জাদ

এই দুই ধরনের নির্যাতনই অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এর জন্য বিভাগীয় শাস্তি ও ফৌদজারী মামলার বিধান রাখা হয়েছে। আর এই ধরনের কাজকে পেশাগত অসদাচরণ হিসেবে বিবেচনায় নেয়া হয়েছে।

ব্ল্যাস্টের পরিচালক  মাহবুবা আখতার ডয়চে ভেলেকে বলেন, "আমরা আদালতের নির্দেশের পর লিগ্যাল এইড সহায়তা সেল খুলেছি। সেগুলো এখনো কার্যকর আছে। অভিযোগ এলে আমরা আইনি সহায়তা দিই। জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সঙ্গেও আমরা এটা নিয়ে কাজ করছি। শিক্ষা মন্ত্রণালয় বা সরকারের কোনো সংস্থা এটা নিয়মিত মনিটরিং করে কিনা তা আমার জানা নেই।  তবে উচ্চ আদালতের নির্দেশে জেলা প্রশাসক ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও শিক্ষা কর্মকর্তাদের এটা মনিটরিং করতে বলা হয়েছিল।”

বোয়ালিয়ায় যা পরিস্থিতি

এক চোখের দৃষ্টিশক্তি হারানো সাত বছর বযসি শিক্ষার্থীর বাবা প্রতিকারের জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে ইতিমধ্যে অভিযোগ করেছেন। বোয়ালিয়া উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা এমরান হোসেন সজীব  শিক্ষার্থীর বাম চোখ নষ্ট হওয়ার কথা  ডয়চে ভেলের কাছে স্বীকার করেছেন।

তিনি বলেন, " আজ (বুধবার) আমি তদন্ত শুরু করেছি। তদন্ত শেষে দায়ীদের কিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। আর ওই শিশুটিকে আমরা প্রশাসনের পক্ষ থেকে সাধ্যমতো সহায়তার চেষ্টা করছি।

যেভাবে চোখ হারালো আয়াতুল

শিক্ষার্থীর বাবা সাজ্জাদ হেসেন জানান, তার ছেলে মোহাম্মদ আয়াতুল ইসলামকে তিনি ছয় মাস আগে উপজেলার সরোয়াতলি ইউনিয়নের বাগে সিরিকোট তাহফিজুল কোরআন আইডিয়াল মাদ্রাসায় ভর্তি করেন। আয়াতুল ওই মাদ্রাসায় থেকেই হেফজ পড়ছিল। গত ২৪ মে পড়া না পারায় শিক্ষিকা শাহীন আক্তার তাকে বেত দিয়ে পিটায়। তখন বাম চোখে আঘাত পায় আয়াতুল। তার বাবার অভিযোগ," আমার ছেলের চোখের অবস্থা খারাপ হলে চার দিন পর তাকে একজন শিক্ষক বাসায় নিয়ে আসে।  জানানো হয় তার চোখ উঠেছে। কিন্তু এর আগে আমাদের জানানো হয়নি।” এরপর স্থানীয় চিকিৎসকদের দেখালে তাদের পরামর্শে ওই শিক্ষার্থীকে চট্টগ্রামের পাহাড়তলী চক্ষু হসাপাতালে নেয়া হয়।  সজ্জাদ হোসেন বলেন," তারা আমরা ছেলের বাম চোখের কর্নিয়া নষ্ট হওয়ার কথা জানায়। তারাপরও দৃষ্টিশক্তি ফিরে পাওয়ার আশায় অপারেশন করা হয়। কিন্তু দৃষ্টিশক্তি ফিরে পায়নি। এখন আমি ভারতে নিয়ে শেষ চেষ্টা করতে চাই। কিন্তু আমার কোনো অর্থ নাই। আমি একটি দোকানে কাজ করে সংসার চালাই।”

তিনি এর মধ্যে ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানের কাছে বিচার দিয়েছিলেন। কিন্তু কোনো প্রতিকার পাননি। শেষ পর্যন্ত মঙ্গলবার তিনি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ দেন।

তিনি আরো অভিযোগ করেন, "ঘটনা আড়াল করতে মাদ্রাসার  ওই সময়ের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ গায়েব করে ফেলা হয়েছে।”

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এমরান হোসেন সজীব বলেন, "আমি আজ সরেজমিন তদন্তে গিয়েছিলাম। সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলেছি। তাতে স্পষ্ট যে, আঘাতের কারণেই ছেলেটির একটি চোখ নষ্ট হয়ে গেছে। এটা নিয়ে দুই পক্ষ দুই ধরনের কথা বলেছে। তবে ঘটনা তো একটা ঘটেছে। কীভাবে ঘটেছে আর দায়ী ব্যক্তিকে চিহ্নিত করতে আরো তদন্ত করতে হবে। ছেলেটির বাবা-মাকে ঘটনার চারদিন পর জানানো সন্দেহজনক।”

শিক্ষার জন্য নির্যাতনের দরকার নেই: মজিবুর

শিক্ষিকা শাহীন আক্তারকে চেষ্টা করেও ফোনে পাওয়া যায়নি। তবে ওই মাদ্রাসার পরিচালক মহিউদ্দিন মাহমুদ মানিক দাবি করেন, " তাকে (আয়াতুল) কোনো ধরনের মারধর করা হয়নি। তার চোখ উঠেছিল। এখন তার পরিবার ভারতে নেয়ার জন্য আমার কাছে দুই লাখ টাকা চায়। সেটা না দেয়ায় তার পরিবার অভিযোগ করছে।”

তিনি বলেন, "এ পর্যন্ত যা চিকিৎসার খরচ তার বেশিরভাগই মাদ্রাসার পক্ষ থেকে দেয়া হয়েছে। দেশে আরো চিকিৎসা করাতে চাইলে আমরা সেই খরচ দেবো।”

তবে এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, "চিকিৎসকরা বলেছেন, ছেলেটির চোখে আঘাত করা হয়েছে বলেই তার চোখের এই ক্ষতি হয়েছে। কিন্তু আমাদের কাছে আঘাতের কোনো প্রমাণ নেই।”

চার দিন পর কেন তার পরিবারকে জানানো হলো তা জানতে চাইলে তিনি বলেল, "আমরা ভেবেছি চোখে ড্রপ দিলে ভালো হয়ে যাবে। তাই জানাইনি।”

মাদ্রাসাটি এক বছর আগে প্রতিষ্ঠা করা হয়। সেখানে শুধু হেফজ পড়ানো হয় বলে জানান তিনি।

১৪ বছরে কতটা কমেছে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নির্যাতন

আইন ও সালিস কেন্দ্র (আসক)-এর হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩ সালে সারা দেশে ২৪০ জন শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছে৷ চলতি বছরের প্রথম পাঁচ মাসে নির্যাতনের শিকার হয়েছে ১৫ জন। আসক আরো জানাচ্ছে, ২০২০ সালে ১২৫ জন, ২০২১ সালে ৬৭ জন এবং ২০২২ সালে ১০৯ জন শিক্ষার্থী শ্রেণিকক্ষে শিক্ষকের  শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিল। কিন্তু এসব ঘটনায় ফৌজদারি মামলার হার খুবই কম। ২০২৩ সালে মামলা হয়েছে মাত্র সাতটি৷ চলতি বছরের প্রথম পাঁচমাসে মামলা হয়েছে পাঁচটি। সব ঘটনা সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয় না। ফলে প্রকৃত নির্যাতনের সংখ্যা আরো বেশি হবে বলে মনে করে আসক।

শিশু অধিকার অ্যাডভোকেসি কোয়ালিশন নেটওয়ার্কের সমন্বয়কারী এবং আসকের সমন্বয়কারী তামান্না  রীতি বলেন, "এই যে নির্যাতনের হিসাব, এটা যৌন হয়রানী ও যৌন সহিংসতার বাইরের হিসাব। সেটা আলাদা করে আমরা রাখি না। ওটা শিশুদের  প্রতি যৌন সহিংসতার মধ্যে এক সঙ্গে হিসাব করা হয়।”

তিনি বলেন, "আসলে হাইকোর্ট যে নির্দেশনা দিয়েছিল, সেভাবে সরকারের পক্ষ থেকে এটা মনিটরিং করা হচ্ছে না। এসব ঘটনায় মামলা তেমন হয় না এবং দৃষ্টান্তমূলক শান্তির কোনো নজির নেই। আর শাস্তির জন্য আলাদা কোনো আইন নেই। দেশের প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ আছে।”

তার মতে, "এখানে সবচেয়ে অভাব হচ্ছে সচেতনতার। এখনো মনে করা হয়, শিশুদের একটু আধটু শারীরিক শাস্তি না দিলে আসলে তারা ঠিকভাবে পড়াশুনা করে না।”

আসকের পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে, এখনো আগের মতোই শারীরিক শাস্তি দেয়া হয়। বেত দিয়ে পেটানো, ডাস্টার ছুড়ে মারা, কান ধরে উঠবস এগুলো এখনো চলছে।

সচেজনতা ও প্রশিক্ষণের অভাব

শিক্ষার্থী অভিভাবক ফোরামের সভাপতি জিয়াউল কবির দুলু বলেন, " আসলে নীতিমালা থাকলেও এর প্রয়োগ তেমন নেই। আর এজন্য শিক্ষকদের যে প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তা-ও তাদের দেয়া হয় না।  ফলে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনো শারীরিক শাস্তি রয়ে গেছে।” তার কথা, "শিক্ষকদের অদক্ষতার কারণেই তারা শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালান। তারা দক্ষ হলে এরকম ঘটতো বলে মনে হয় না।”

সরকারের নীতিমালা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য: হাবিবুর

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক মোহাম্মদ মজিবুর রহমান বলেন," শিক্ষার্থীদের ওপর শারীরিক ও মানমিক নির্যাতন তাদের মানসিক বিকাশকে যেমন বাধাগ্রস্ত করে, তেমনি এই নির্যাতনের কারণে আমরা বড় ধরনের শারীরিক ক্ষতি হতেও দেখেছি। শিক্ষার জন্য এই ধরনের কোনো নির্যাতনের দরকার নেই। শিক্ষক দক্ষ হলে এটা করতে হয় না। তাদের অদক্ষতা ও শিখন পদ্ধতি নিয়ে যথাযথ জ্ঞানের অভাবেই এটা হচ্ছে।”

"শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নিষিদ্ধ করা হলেও এর প্রয়োগ ঠিকভাবে হচ্ছে না। শিক্ষকদের যথাযথ প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে না। সার্বিকভাবে সব মহলে সচেতনতার অভাব রয়েছে। সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চাইল্ড সাইকোলজিস্ট নিয়োগ সম্ভব না হলেও শিক্ষকদের এ ব্যাপারে প্রশিক্ষণ দেয়া জরুরি,” বলেন তিনি।

তার মতে. "সাধারণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেয়ে মাদ্রাসাগুলোর প্রতি নজর আরো কম। আমরা সেখান থেকে শেকল বাঁধা ছাত্রও উদ্ধার হতে দেখেছি।”

এসব মাদ্রাসা শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক হাবিবুর রহামান জানান," সরকারের যে নীতিমালা, সেটা সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের জন্য। আইনে  শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক  শাস্তি নিষিদ্ধ। জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে শিক্ষা কর্মকর্তারা বিষয়টি মনিটরিংয়ের দায়িত্বে আছেন।”

তার কথা, "কওমী মাদ্রাসাগুলো অধিদপ্তরের আওতায় নয়। তাই সেখানে এরকম কিছু ঘটলে স্থানীয় প্রশাসন দেখে। আলীয়া মাদ্রাসায় এরকম অভিযোগ আমরা পাাই না। তবে কওমী মাদ্রাসার ঘটনা পত্রিকায় মাঝে মাঝে দেখি।”

"আর চট্টগ্রামের ওই মাদ্রাসাটি একটি আনরেজিষ্টার্ড মাদ্রাসা.” বলেও দাবি করেন তিনি।

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য

এই বিষয়ে আরো তথ্য