হিরো আলমের বিচার করে কে?
৫ আগস্ট ২০২২তখন তার উত্থান পর্ব চলছে৷ সারাদেশে হিরো আলমকে নিয়ে আলোচনা৷ নানা সমালোচনা৷ কিন্তু আমার চোখে ধরা পড়েছে তার অদম্য ইচ্ছা এবং অমিত সাহস৷ কীভাবে গ্রামের এক তরুণ পোশাকি সমাজকে চ্যালেঞ্জ করে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন নিজস্ব ভঙ্গিতে৷ কোনো সমালোচনা তাকে দমাতে পারছে না৷
তাকে নিয়ে আমি এরপর লাইভ শো করেছি৷ ওই সময়ে একটি কলামও লিখেছি৷ "একজন হিরো আলম” শিরোনামের ওই কলামের শেষ কথা ছিলো,"যারা আলমকে নিয়ে মজা করছেন, হাসছেন, নিজেদের হিরো ভাবছেন তাদের উদ্দেশে আরেকটি কথা বলতে চাই৷ ধরে নিলাম হিরো আলম কাক৷ মনে রাখবেন আপনি কিন্তু ময়ূর নন৷”
এরপর তার সাথে টেলিফোনে দুই-একবার কথা হয়েছে পেশাগত কারণে৷ আর তাকে নিয়ে সংবাদ মাধ্যমে সব সময়ই নানা আলোচনা সমালোচনা দেখেছি৷ তবে সর্বশেষ তাকে ডিবি অফিসে নিয়ে মুচলেকা আদায়ের ঘটনাটি শুনে প্রথমে বিস্মিত এবং পরে ক্ষুব্ধ হয়েছি৷ একটি মাত্র বাক্যে আমি আমার প্রতিক্রিয়া জানিয়েছি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে৷ আর তা হলো,"সবাই বিচারক হলে তো সমস্যা, যার কাজ তার করা উচিত৷''
হিরো আলমের বিরুদ্ধে যে অভিযোগগুলো পুলিশ তুলেছে তার মধ্যে প্রধান হলো "বিকৃত সুরে রবীন্দ্রসংগীত গাওয়া''৷ এই অভিযোগ আরো অনেকেই তুলেছেন৷ অভিযোগ করার অধিকার তো সবার আছে৷ কিন্তু বিচার করার অধিকার কার, পুলিশের? পুলিশ কি বিচারক? পুলিশও অভিযোগ করতে পারত আদালতে অথবা অন্য কোনো বিচারালয়ে৷ তারাই বিষয়টি দেখতে পারতেন৷ কিন্তু পুলিশ নিজেই নিজেকে রবীন্দ্রসংগীত বোদ্ধা হিসেবে জাহির করে নিজেই বিচারক সেজে গেল৷ এখানেই শেষ নয় তার নামের আগে হিরো শব্দটিও মুছে ফেলতে বলেছে৷ নিজের চেহারা নিজেকে দেখতে বলেছে৷ আপাতত নিরীহ মনে হলেও শেষের কথাগুলো প্রকারন্তরে এক ধরনের বর্ণবাদ৷
আমাদের সাংবাদিক বন্ধুরা এখন সেটা কিছুটা উপলব্ধি করতে পারলেও মুচলেকার শুরুতে নানা ধরনের আপত্তিকর শব্দ ব্যবহার করে খবর পরিবেশন করেছেন৷ মুখরোচক হেডিং করেছেন৷ তবে এখন তারাও মনে করছেন হিরো আলমের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে৷ তাই তারা সরব হয়েছেন৷
আমার বিবেচনায় হিরো আলমকে তার মৌলিক মানবাধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে৷ তার প্রতি পুলিশি রাষ্ট্রের আচরণ করা হয়েছে৷ এর দায় তো পুলিশকেই নিতে হবে৷
হিরো আলমের প্রতি যেসব অন্যায় করা হয়েছে তা আমার বিবেচনায়-
১. বিচারকাজের দায়িত্বপ্রাপ্ত নয় এমন প্রতিষ্ঠান তার বিচার করেছে৷ এটা আসলে অবিচার৷
২. আদালতে অপরাধ প্রমাণের আগেই তাকে শাস্তি দেয়া হয়েছে৷ এটা আইনবিরুদ্ধ কাজ৷
৩. তার প্রতি সবলের অত্যাচার হয়েছে৷
৪. তার প্রতি বর্ণবাদী আচরণ করা হয়েছে৷
৫. তার ব্যক্তি স্বাধীনতা ও সাংবিধানিক অধিকার লঙ্ঘন করা হয়েছে৷
রবীন্দ্রসংগীত কীভাবে গাইতে হবে তা নিয়ে কথা তো হতেই পারে৷ সেটা নিয়ে সংগীত বিশেষজ্ঞরা মতামত দেরেন৷ কী করণীয় তাও তারা বলতে পারেন৷ আর সেটা বাস্তবায়নের পদ্ধতি কী হবে তারা তাও বলে দিতে পারেন৷ আমরা সেটা অনুসরণ করব নিশ্চয়ই৷ কিন্তু ডিবি পুলিশ হঠাৎ করে হিরো আলমের গানকে তো "গণ-উৎপাত” বলে দিলে হবে না৷ দেখা গেলো পুলিশ নিজেই এখন আইন লঙ্ঘন করেছে৷ এটাও তো একটা উৎপাত৷ এর বিচার করবে কে?
কারো নামের আগে হিরো লাগাতেও কি পুলিশের অনুমতি লাগবে? তাই যদি লাগে তাহলে ভবিষ্যতে দেখা যাবে শিশু সন্তানের নাম রাখার আগেও পুলিশের অনুমতি লাগবে৷ নিজের চেহারা দেখার প্রশ্ন যদি ওঠে তাহলে ডিবির যে কর্মকর্তা এই কাজ করেছেন তার চেহারা নিয়েও তো প্রশ্ন উঠতে পারে৷ আর এই চেহারার তো নানা দিক আছে৷ আর যাই হোক হিরো আলমের বিরুদ্ধে তো ঘুস, দুর্নীতি বা অর্থ পাচারের অভিযোগ নেই৷ যাদের বিরুদ্ধে এই অভিযোগ আছে তাদের চেহারা কি তারা দেখতে পান?
রাষ্ট্রে তো অনেক বিকৃতি আছে৷ গণতন্ত্রে বিকৃতি আছে৷ নির্বাচনে বিকৃতি আছে৷ বিকৃতি আছে নানা সামাজিক ব্যবস্থায়৷ যদি বলি গানে বিকৃতি, তা তো আরো অনেক মহারথীও করছেন৷ তাহলে ওই পুলিশ কর্মকর্তা হাত-পা গুটিয়ে বসে আছেন কেন? বিচারে নেমে পড়ুন৷ নামছেন না কেন? ওই মহারথীদের ধরুন৷
আমি জানি ওই সব জায়গায় হাত দেয়ার ক্ষমতা বা দৌড় কোনোটাই তার নেই৷ উল্টো তিনি তাদের তোষণ করবেন৷ হিরো আলমের কিরুদ্ধে তার এই অনধিকার নাক গলানো ক্ষমতাবানদের তোষণেরই একটি অংশ৷ আর দেশের অনেককে নিয়েই তো বিতর্ক-সমালোচনা আছে৷ তাহলে তাদের কাছ থেকেও মুচলেকা আদায় করা হোক৷ তাদের গণ-উৎপাতও বন্ধ করা হোক৷ পারবেন কি আপনি, জনাব পুলিশ কর্মকর্তা?
হিরো আলম দুর্বল, তার আর্থিক ক্ষমতা নেই৷ সে তেমন লেখাপড়া করে নাই৷ ছোট এক ডিশ ব্যবসায়ী থেকে দেশের মানুষ বেভাবেই হোক তাকে চেনে৷ তার যেমন অনেক সমালোচক আছেন, ভক্তও আছে৷ এটাই তার আসল অপরাধ৷ এখানেই আমাদের শ্রেণি মানসিকতার বর্ণবাদ৷ পুলিশ কর্মকর্তা আসলে তার সেই চরিত্রেরই প্রকাশ ঘটিয়েছেন হিরো আলমকে আটক করে মুচলেকা নিয়ে৷