স্কুলশিক্ষকদের টিউশনে আপত্তি, পড়ুয়ারা সহমত?
২৭ আগস্ট ২০২২স্কুলে যাঁরা শিক্ষকতা করেন, তাঁদের একাংশ ছাত্রছাত্রীদের স্কুলের বাইরেও পড়ান৷ যাঁরা স্কুলে শিক্ষকতা করেন না, তাঁরাও গৃহশিক্ষকতার কাজে যুক্ত৷উভয়ের বিরোধ নতুন নয়৷স্কুল শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা আইনবিরুদ্ধে হলেও তা রুখতে তেমন কঠোর পদক্ষেপ নিতে দেখা যায়নি রাজ্য সরকারকে৷মাস দুয়েক সেই ছবিতে বদল এসেছে৷
- মৌচাকে রাজ্যের ঢিল
শিক্ষা দপ্তর গত ২৭ জুন একটি নির্দেশিকা জারি করে৷তাতে বলা হয়, সরকারি বা সরকার পোষিত বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষক-শিক্ষিকারা টিউশন পড়াতে পারবেন না৷ বাড়িতে না হলেও তাঁরা কোনো কোচিং সেন্টারের সঙ্গেও যুক্ত থাকতে পারবেন না৷ কোনো সাম্মানিক ছাড়াও টিউশন পড়ানোয় নিষেধাজ্ঞার কথা বলা হয় নির্দেশিকায়৷২০০৯-এর কেন্দ্রীয় শিক্ষার অধিকার আইনের ২৮ নম্বর ধারা অনুসারে এই নির্দেশ দিয়েছে শিক্ষা দপ্তর৷সব স্কুলে এই বিজ্ঞপ্তি পৌঁছে গেলেও পরিস্থিতি বদলায়নি বলে দাবি শুধু গৃহশিক্ষকতার সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকদের সংগঠনের৷ এই নির্দেশিকা প্রকাশের পর অভিযোগের ভিত্তিতে স্কুল শিক্ষকদের তলব করেছে জেলা শিক্ষা দপ্তর৷তাঁদের কাছ থেকে মুচলেকা নেওয়া হয়েছে৷ কিন্তু সার্বিকভাবে স্কুল শিক্ষকদের টিউশনি তাতেও বন্ধ করা যায়নি বলে অভিযোগ উঠেছে৷
- সামাজিক ব্যাধির তকমা
শুধু টিউশনের সঙ্গে যুক্ত শিক্ষকরা বহুদিন দাবি তুলেছেন, স্কুল শিক্ষকদের গৃহশিক্ষকতা বন্ধ করতে হবে৷আইন থাকলেও তা প্রয়োগে সরকার কঠোর না হওয়ায় গৃহশিক্ষকরা আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন৷ ওয়েস্ট বেঙ্গল প্রাইভেট টিউটর ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন-এর সম্পাদক বিবেকানন্দ সাহা ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘আমরা চাইছি সরকারের আইন ১০০ শতাংশ কার্যকর হোক৷এক শ্রেণির স্বার্থান্বেষী শিক্ষক টিউশন চালিয়ে যাচ্ছেন আইন অগ্রাহ্য করে৷তাঁদের বিরুদ্ধে সরকার ব্যবস্থা নিক৷'' গৃহশিক্ষক কল্যাণ সমিতির শাখাগুলি জেলায় জেলায় প্রতিবাদ মিছিল, সভা করেছে৷ জেলা বিদ্যালয় পরিদর্শক দফতরে অভিযোগ জানাচ্ছে টিউশনে যুক্ত স্কুল শিক্ষকদের বিরুদ্ধে৷তাদের বক্তব্য, স্কুল শিক্ষকদের প্রাইভেট টিউশন শুধু বেআইনি কাজ বা দুর্নীতি নয়, একটা সামাজিক ব্যাধিও৷
- রাজ্যের নজরে শিক্ষকরা
প্রাইভেট টিউটরদের দাবিপূরণ বা আইন রূপায়ণে রাজ্য সরকারকে বেশ তৎপর দেখাচ্ছে৷ সূত্রের খবর, ৪৫টি বিদ্যালয়ের ২০০ জন শিক্ষক নজরে রয়েছেন শিক্ষা দপ্তরের৷সংশ্লিষ্ট স্কুলে ওই শিক্ষকদের নামের তালিকা পৌঁছে গিয়েছে৷ কলকাতার উত্তর শহরতলির দমদম, বেলঘরিয়া, বরানগরের একাধিক স্কুলের প্রধান শিক্ষকের কাছে তাঁদের সহশিক্ষকদের সম্পর্কে কৈফিয়ৎ চাওয়া হয়েছে৷ প্রয়োজনে আইনভঙ্গকারী শিক্ষকদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে৷ এই তৎপরতা সম্পর্কে স্কুল শিক্ষকদের একাংশের মধ্যে যথেষ্ট উষ্মা রয়েছে৷নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শিক্ষকের বক্তব্য, ‘‘স্কুলে পড়ানোর যোগ্যতা অর্জন করা কি অপরাধ? ক্লাসের ভিড়ে সবার প্রতি সমান মনোযোগ দেওয়া সম্ভব হয় না৷পড়ুয়ারা যদি শিক্ষকের সহযোগিতা চায়, তা হলে তিনি কী করবেন?''
- পড়ুয়ারা প্রতিবাদে পথে
এই বিতর্কে পড়ুয়া ও অভিভাবক মহল বরাবরই দ্বিধাবিভক্ত৷ একাংশের অভিযোগ, শিক্ষকরা স্কুলে না পড়িয়ে ছাত্রছাত্রীদের টেনে আনেন নিজের কোচিং ক্লাসে৷ সরকারের কাছ থেকে বেতন নেন, আবার টিউশনের জন্য সাম্মানিকও৷যদিও এটা ঠিক, পড়ুয়াদের বড় অংশ স্বেচ্ছায় স্কুল শিক্ষকের কাছে পড়তে যায়৷এমনই একদল পড়ুয়ারা গত মাসে কোচবিহারের দিনহাটায় পথে নেমে মিছিল, অবরোধও করে৷
ছাত্রছাত্রীদের প্রশ্ন, ‘‘কাদের কাছে তারা শিক্ষালাভ করবে, সেটা সরকার কেন ঠিক করবে? কেন পছন্দের শিক্ষকের কাছে না গিয়ে তারা কোনো অপছন্দের গৃহশিক্ষকের কাছে যাবে?''
কলকাতার ২৫টি স্কুলের অভিভাবকদের সংগঠন ইউনাইটেড গার্ডিয়ানস অ্যাসোসিয়েশন-এর আহ্বায়ক সুপ্রিয় ভট্টাচার্য ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘একজন শিক্ষক শিক্ষকতাকরতে পারবেন না, এটা কোনো নীতি হতে পারে না৷ কিন্তু এটাও সত্যি, অল্প সংখ্যক স্কুল শিক্ষক টিউশনকে ব্যবসার চেহারা দিয়েছে যা একেবারে সমর্থনযোগ্য নয়৷''
- প্রাইভেট টিউশনে লাগাম?
শিক্ষা মহলের একাংশ প্রশ্ন তুলছে গৃহশিক্ষকদের যোগ্যতা নিয়ে৷এঁদের অনেকেই চাকরিপ্রার্থী৷ স্কুলে নিয়োগ নিয়ে টালবাহানা চলতে থাকায়যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও অনেকে এখনো চাকরি পাননি৷ কিন্তু সকলেই যে যোগ্যতাসম্পন্ন, ছাত্রদরদী, তা বলা যায় না৷ তেমনই ক্লাস ফাঁকি দেওয়া বা পরীক্ষায় নম্বরের টোপে টিউশনের রমরমার যে অভিযোগ স্কুল শিক্ষকদের একাংশের বিরুদ্ধে উঠেছে, তাতে সরকারের সাম্প্রতিক উদ্যোগে লাগাম পড়বে বলে মনে করা হচ্ছে।