সীমান্তে হত্যার শিকার স্বজনদের লাশ না পেয়ে হতাশা, ক্ষোভ
৭ নভেম্বর ২০২২‘‘আমি আমার বাবার লাশের জন্য এখনো অপেক্ষা করছি৷ বাবা মারা যাওয়ার পর বিজিবি ও অন্যান্য কর্তৃপক্ষের কাছে তার জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে আবেদন করেছি৷ কিন্তু লাশ আনার কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি,'' অভিযোগ করে বলছিলেন আসাদুজ্জামান ভাসানির ছেলে৷
তিনি বলেন, ‘‘আমার বাবা সকালে ধানখেত দেখতে গেলে বিএসএফ ধরে নিয়ে মেরে ফেলে৷ এরপর আমরা বিজিবির কাছে যাই, ভোটার আইডি কার্ড দেখাই৷ কিন্তু বিজিবি বলেছে সে বাংলাদেশের নাগরিক না৷ আমার আম্মুও লিখিতভাবে আবেদন করে, তারপরেও লাশ ফেরত পাইনি৷’’
একই অভিযোগ করেন ইদ্রিস আলির ভাই৷ ‘‘আমার ভাই বিএফএফের গুলিতে মারা যায়৷ ভাই হিসাবে আমি লাশের জন্য বিজিবি ও জেলা প্রশাসকের কাছে আবেদন করেছিলাম৷ কিন্তু এখনো লাশ পেলাম না,’’ ডয়েচে ভেলেকে জানান তিনি৷
তার অভিযোগ, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী (বিএসএফ) লাশ ফেরত দিতে চেয়েছিল, কিন্তু বিজিবি নেয়নি৷ বিজিবি বলেছে লাশ বাংলাদেশির না৷
ভাইয়ের লাশের জন্য আকুল আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘‘যদি লাশ পাই তাহলে আমাদের পরিবার কিছুটা হলেও সান্তনা পাবে৷''
২০২১ সালের জুন থেকে আরও চার বাংলাদেশিকে লালমনিরহাট সীমান্তে হত্যা করে ভারতীয় বিএসএফ সদস্যরা৷ তাদের পরিবারগুলোও লাশ ফেরত পায়নি৷
এই চার জনের মধ্যে ইউনুস আলী, জগন্নাথ চন্দ্র ও রিফাত হোসেনকে গুলি করে হত্যা করা হয় পাটগ্রাম সীমান্তে এবং সুবল চন্দ্রকে হত্যা করা হয় আদিতমারি সীমান্তে৷
লাশ না পাওয়ায় তাদের পরিবারের সদস্যরাও ক্ষোভ ও হাতাশা ব্যক্ত করেছে৷ পরিবারগুলোর অভিযোগ, বিজিবি সহায়তা না করায় তারা লাশ ফিরে পায়নি এবং শেষবারের মতো দেখার সুযোগ থেকে স্বজনদের বঞ্চিত করা হয়েছে৷
সুবলের বাবা পেলকুরাম বর্মন বলেন, এক বছর পার হয়ে গেল এখনো লাশ পেলাম না৷ তার অভিযোগে বিএসএফের গুলি সুবল মারা গেলে ক্যাম্পে গিয়ে বিজিবিকে জানালে বিজিবি আশ্বস্ত করে৷ কিন্তু লাশ আনা হয়নি৷ ‘‘এটা আমাদের জন্য অনেক কষ্টের,’’ বলেন তিনি৷
‘‘আমার ব্যাটার (ছেলের) জন্য আত্মা কাঁনদে, কিন্তু লাশ তো পাইনি৷ লাশ পাইলে নেড়েচেড়ে দেখতাম,’’ বলছিলেন সুবলের মা৷
হত্যাকাণ্ডের শিকার পরিবারগুলো মনে করে, বিজিবি চাইলে তারা স্বজনদের লাশ ফেরত পেত৷ কিন্তু বিজিবি তাদের স্বজনদের বাংলাদেশি নাগরিক বলে স্বীকার করেনি৷ তাই লাশ ফেরত আনেনি৷
যোগাযোগ করা হলে লালমনিরহাট ১৫ বিজিবি ব্যাটালিয়নের কোম্পানি কমান্ডার লেফটেন্যান্ট কর্নেল তৌহিদুল ইসলাম এ বিষয়ে ডয়েচে ভেলের সাথে কথা বলতে অস্বীকৃতি জানান৷
এসব লাশ কী করা হয়েছে তা স্বজনরা বলতে পারেন না৷
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক)-এর সাধারণ সম্পাদক নূর খান বলেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিএসএফ-এর গুলিতে অথবা নির্যাতনে কেউ মৃত্যুবরণ করলে দুই দেশের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর মধ্যে যোগাযোগের (পতাকা বৈঠক) পর লাশ ফিরিয়ে আনা হয়৷ ‘‘কিন্তু সাম্প্রতিককালে আমরা জেনেছি যে দীর্ঘদিন ধরে লাশ ভারতে পড়ে থাকলেও সেগুলো আনার ব্যাপারে আমাদের দিক থেকে যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করা হচ্ছে না,’’ বলে জানান তিনি৷
লালমনিরহাট সীমান্তে অন্তত তিনটি এমন ঘটনা সম্পর্কে জানতে পেরেছেন বলে তিনি ডয়েচে ভেলেকে জানান৷ তার মতে, এমন ঘটনা আরও ঘটেছে ঐ এলাকায়৷ ‘‘আমাদের সূত্র বলছে, ছয় বা সাতটি এমন ঘটনা রয়েছে,’’ বলছিলেন তিনি৷
নূর খান মনে করেন, ‘‘সংখ্যা যাই হোক না কেন আমি মনে করি বাংলাদেশের একজন নাগরিক সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হোক বা পৃথিবীর যে-কোনো জায়গায় হত্যা বা মৃত্যুর ঘটনা ঘটুক, তাদের পরিবার সবসময় চায় যে তারা লাশ পাবে৷’’
তার অভিযোগ, মৃতের প্রতিবার জাতীয় পরিচয়পত্রসহ অন্যান্য ডকুমেন্ট জমা দেয়ার পরও লাশ আনার উদ্যোগ বিজিবির পক্ষ থেকে নেয়া হয়নি৷ কোনো কোনো ক্ষেত্রে বিজিবি তাদের নাগরিকত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে৷
নূর খানের মতে, ‘‘জাতীয় পরিচয়পত্র নাগরিকত্ব প্রমাণের সবচেয়ে বড় উপায়৷ তবে নাগরিকত্ব প্রমাণের আরও উপায় আছে৷ কাগজপত্র আমলে না নিয়ে আমাদের নাগরিক না, এটা বলার কোনো সুযোগ বিজিবির দেখি না৷ যদি বলে থাকে, সেটা অনাকাঙ্ক্ষিত এবং তা তাদের দায়িত্বের সাথে যায় না৷’’
এই মানবাধিকার কর্মী বলেন, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তে যারা মারা যায় তাদের পরিবার জানে যে লাশ সেখানে আছে৷ তাই স্বাভাবিকভাবেই তারা তাদের বাবা-ভাই বা সন্তানের লাশ পেতে চায়, চায় ভারতের সাথে দেন-দরবার করে যেন লাশ আনা হয়, যেন ধর্মীয় বিধান মতে পরিবারগুলো লাশ দাফন করে৷
কেন লাশ আনার ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, দেশে সবক্ষেত্রে এখন দায়িত্ব না নিয়ে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার প্রবণতা দেখা যায়৷
মানবিক কারণেই লাশ আনার ব্যবস্থা রাষ্ট্রকে নেয়া উচিত বলে মনে করেন নূর খান৷ ‘‘কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে সীমান্ত হত্যাকাণ্ডের ক্ষেত্রে আমরা একধরনের স্থবিরতা দেখছি,’’ বলেন তিনি৷
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড চলছেই
সীমান্তে হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় আনার জন্য দুই দেশ অনেকবার আলোচনা করেছে৷ ভারতের সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে বারবার সীমান্ত হত্যা বন্ধের প্রতিশ্রুতি দেয়া হলেও তা বন্ধ হচ্ছে না৷ তারা সীমান্ত হত্যা শূন্যে নামিয়ে আনার কথা বলার পরই আবার সীমান্ত হত্যা শুরু হয়৷
আইন ও সালিশ কেন্দ্রের হিসাবে, এ বছরের অক্টোবর পর্যন্ত ১০ মাসে বিএসএফ কর্তৃক নির্যাতন ও গুলিতে ১৭ জন বাংলাদেশি মারা গেছেন৷ ২০২১ সালে সীমান্তে হত্যা করা হয় মোট ১৯ জন বাংলাদেশিকে৷ এর মধ্যে ১৬ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়৷
২০২০ সালে মোট ৪৮ জন নিহত হয়েছেন৷ গুলিতে ৪২ জন এবং নির্যাতন চালিয়ে ছয় জনকে হত্যা করেছে বিএসএফ৷ অপহরণ করা হয়েছে ২২ জনকে৷ এর আগের বছর ২০১৯ সালে বিএসএফ-এর হাতে নিহত হয়েছেন ৪৩ জন৷ এরমধ্যে গুলিতে ৩৭ জন এবং নির্যাতনে ছয়জন৷ অপহরণ করা হয়েছে ৩৪ জনকে৷
পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, প্রায় ৯০ ভাগকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে৷ অথচ বাংলাদেশ-ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ে আলোচনায় সীমান্তে মারণাস্ত্র (লেথাল উইপন) ব্যবহার না করার বিষয়ে আলোচনা হয়েছে বলে গত জানুয়ারিতে জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী৷