সামাজিক শিষ্টাচার কমছে, রোধের উপায় কী?
বাংলাদেশে মানুষের মধ্যে যেন ভালো ব্যবহার করার অভ্যাস দিন দিন কমছে৷ কথায় কথায় অন্যকে ছোট করতে পারার মনোভাব দেখা যাচ্ছে৷ কেন এমন হচ্ছে, পরিবর্তন আনার উপায় কী?
নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে
একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জাকির হোসেন বলেন, ‘‘সাম্প্রতিক সময়ে সরকারের একজন দায়িত্বশীল প্রতিমন্ত্রী নারীদের জড়িয়ে যেসব কথা বলেছেন, ওনার পদ-পদবি থেকে এ ধরণের কথা কখনোই গ্রহণযোগ্য না৷ আসলে আমাদের যে নৈতিক অবক্ষয় হয়েছে, সেটার প্রতিফলন আমরা এখন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে দেখতে পাচ্ছি৷’’
অনেকেই এমন, শুধু প্রমাণের অভাব
বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত হুমায়রা রেজওয়ানা বলেন, ‘‘মেয়েরা একা চলতে ভয় পায়৷ কিছুক্ষেত্রে মেয়েরা এমনভাবে উত্যক্তের শিকার হয়, যা সাধারণত প্রকাশ্যে আসে না৷ গণপরিবহণে শারীরিক নিগ্রহ, মানুষের বাজে চাহনি, হঠাৎ করে ইচ্ছাকৃত ধাক্কা- এসব হরহামেশা ঘটে৷ কেউ কেউ প্রতিবাদ করেন, তবে অনেকেই চেপে যান৷ এসবের প্রতিবাদ করতে গেলে প্রমাণ চান সবাই৷ ব্যাপারগুলো এত দ্রুত ঘটে যে কিছু বুঝার আগেই অপরাধী ভিড়ে হারিয়ে যায়৷’’
‘আগের ধর্মীয় সম্প্রীতি এখন কি আছে?’
ঢাকার মিরপুরের এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘‘বাপ-দাদাদের আমলে আমরা সব ধর্মের মানুষ ভাইয়ের মতন এক সাথে থাকসি, পড়সি, চলাফেরা করসি৷ এখন মাঝেমাঝেই শুনি জঙ্গি হামলা, মন্দির ভাঙসে, মূর্তি ভাঙসে, মানুষ মারা গেসে- এইসব৷ এত এত মিডিয়ার কারণেই হোক আর যা-ই হোক, আমার মনে হয় ধর্ম নিয়া এখন অনেক কিছু চলে যা আমরা সাধারণ মানুষ বুঝি না৷’’
‘আমরা গরিব, আমাগো কি সম্মানের দাম আছে?’
ঢাকার মিরপুর ১২র এক পোশাক কারখানার কর্মী সালেহা আক্তারকে দৈনন্দিন জীবনে চলাফেরায় একজন নারী হিসেবে কী ধরনের প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয় জানতে চাইলে ক্ষোভ প্রকাশ করে তিনি বলেন, ‘‘আমরা স্যার গরিব মানুষ৷ সবারই আমাগো উপর অধিকার আছে৷ মার্কেটে, ফুটপাথে, বাসে সব জায়গাতেই আমরা অসম্মানের শিকার হই৷ আমার মনে হয় বাংলাদেশের সব মাইয়ারাই কম-বেশি এই জিনিস সহ্য কইরাই পথেঘাটে চলাফেরা করে৷’’
প্রতিবন্ধী হয়ে জন্মানোই এ দেশে পাপ
ঢাকার মোহাম্মদপুরে থাকেন ঠিকাদার মো. আব্দুস সালাম৷ তিনি বলেন, ‘‘আমাদের সমাজের একটা বড় অংশ কিন্তু শারীরিক অথবা মানসিক প্রতিবন্ধী৷ এই দেশে যার পরিবারে একজন প্রতিবন্ধী আছে, সে-ই শুধু বুঝে এর জ্বালা কী৷ অনেকে লোকলজ্জার ভয়ে এমন সন্তানের তো পরিচয়ই দেন না৷ আত্মীয়-স্বজন-পাড়া প্রতিবেশী কেউই বাঁকা কথা শোনাতে ছাড়ে না৷ এই দেশে অসুস্থ তো দূর, সুস্থ, স্বাভাবিক মানুষ হয়ে জন্মানোও পাপ৷’’
‘মেয়েদের সন্ধ্যার পর বাইরে পাঠাতে ভয় পাই’
ঢাকার নাখালপাড়ায় পরিবার নিয়ে বাস করেন ফারহানা ইয়াসমিন৷ তিনি বলেন, ‘‘অবস্থা এখন এমন হয়েছে যে আমরা মেয়েদের সন্ধ্যার পর বাইরে পাঠাতে ভয় পাই৷ দেখা যায়, টিউশনি বা এ রকম জরুরি কিছু থাকলেও আমরা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগি কী করবো সেটা নিয়ে৷ ছেলেমেয়েরা যখন এ রকম হেনস্থার শিকার হয়, তখন তাদের সৃজনশীলতাসহ যাবতীয় কাজকর্মে এসবের বাজে প্রভাব পড়ে, যা কখনোই কাম্য না৷’’
‘আমার নিজের হেল্পারই বেয়াদবি করসে’
ঢাকার আব্দুল্লাহপুর-মতিঝিল রুটে চলাচলকারী বিআরটিসি বাসের চালক সোহেল রানা বলেন, ‘‘রাস্তাঘাটে চলাফেরা করি, অনেক ন্যায়-অন্যায়ই চোখে পড়ে৷ আমগো সামর্থ্য কম, তাই ইচ্ছা থাকলেও কিছু করতে পারি না৷ বাইরের কথা কী কমু, আমারই এক হেল্পার মেয়ের লগে অসম্মানি আচরণ করতো৷ কী আর কমু কন?’’
পরিবর্তন কবে আসবে জানা নেই
ঢাকার একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মেডিকেল টেকনোলজিস্ট উম্মে কুলসুম বলেন, ‘‘নারীর প্রতি হেনস্থা বা কটু মন্তব্য ছুঁড়ে দেওয়া খুবই নীচু মন-মানসিকতার লক্ষণ৷ অধিকাংশ পুরুষ মানুষ নারীদের ভোগ্য পণ্যই মনে করে৷ শিক্ষা-অশিক্ষা এ ক্ষেত্রে কোনো ভেদাভেদ তৈরি করতে পারে না৷ বডি শেমিং বলেন আর ইভটিজিং বলেন, সব সূত্র একই সুতোয় গাঁথা৷ এ ধরনের চিন্তা-ভাবনা থেকে আমরা কবে বের হয়ে আসতে পারবো কেউ জানে না৷’’
পারিবারিক শিক্ষা
সরকারি বিজ্ঞান কলেজের শিক্ষার্থী মো. সাকিবুল হাসান বলেন, ‘‘আমাদের যে আচরণগত বৈশিষ্ট্য, এগুলো মূলত তৈরি হয় পরিবার এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে৷ নারীদের প্রতি মনোভাব, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ, ভদ্রতাবোধ আপনি যা-ই বলেন না কেন, পারিবারিক শিক্ষাই মুখ্য ভূমিকা পালন করে৷ তাই আমার মনে হয়, আমাদের অভিভাবকদের এই ক্ষেত্রে আরো বেশি সচেতন হতে হবে৷’’
নৈতিক মূল্যবোধ শিক্ষায় নম্বর থাকা উচিত
রাজনৈতিক কর্মী আফজাল হোসেন খান বলেন, ‘‘আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো কেবল অর্থনৈতিক উপার্জন করার দিকে ধাবিত হচ্ছে, কিন্তু নৈতিকতা বা মূল্যবোধের মূল্যায়ন এখানে তেমনভাবে করা হয় না৷ আমার মনে হয়, অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি নৈতিকতা শিক্ষাও আমাদের পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত৷’’
তরুণ প্রজন্মের কথা ভাবতে হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. সানজীদা আখতার বলেন, ‘‘নারীর প্রতি যৌন হয়রানি সমাজের হতাশাজনক চিত্র তুলে ধরে৷ বিষয়টি আরো হতাশাজনক হয় যখন দেখি নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা এমন মন্তব্য করেন৷ নীতিনির্ধারক পর্যায়ে এ বিষয়গুলো নিয়ে ভাবার এখনই সময়৷ তা না হলে নারীর প্রতি কেমন আচরণ করতে হবে, সেক্ষেত্রে তরুণ প্রজন্ম তার রোল মডেল নির্বাচনে দিশেহারা হয়ে পড়তে পারে৷’’
পারিবারিক বন্ধন বাড়াতে হবে
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহফুজা খানম বলেন, বর্তমানে বাবা-মা দুজনই কর্মব্যস্ত হয়ে পড়ছে৷ ফলে পারিবারিক বন্ধন কমে যাচ্ছে৷ ছেলে-মেয়েরা পরিবারের বদলে নিজেদের মতো করে যে-কোনো উৎস থেকে শিখছে, যা অনেক ক্ষেত্রে তাদের ভুল পথে পরিচালিত করে৷ এ থেকে পরিত্রাণের জন্য পারিবারিক বন্ধন সুদৃঢ় করার পাশাপাশি বাচ্চারা যেন মোবাইল, ইন্টারনেটে অবাধে প্রবেশাধিকার না পায়, সে দিকে খেয়াল রাখতে হবে৷