সাঁওতাল পল্লিতে এখন আখ চাষ হচ্ছে
৬ নভেম্বর ২০১৭গত বছরের ৬ নভেম্বর গাইবান্ধার রংপুর চিনিকলের জমিতে আখ রোপণকে কেন্দ্র করে পুলিশ ও শ্রমিক-কর্মচারীদের সঙ্গে সাঁওতাল ও বাঙালিদের ত্রিমুখী সংঘর্ষ হয়৷ সংঘর্ষের সময় গুলিতে তিন সাঁওতাল নিহত ও অন্তত ৩০ জন আহত হন৷ শুধু তাই নয়, সংঘর্ষে ন'জন পুলিশ সদস্যও আহত হন৷ এ ঘটনায় সাঁওতালদের দুই শতাধিক ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়৷ উচ্ছেদ হয় প্রায় আড়াই হাজার পরিবার৷
সংঘর্ষ এবং আগুনে উচ্ছেদ হয়ে জীবন বাঁচাতে পাশের মাদারপুর-জয়পুরপাড়ায় আশ্রয় নেন সাঁতালরা৷ দুঃখের বিষয়, এখনও তাঁরা সেখানেই আছেন৷ হয় তাঁবুর নীচে অথবা খোলা আকাশের নীচে দিন কাটাচ্ছেন তাঁরা গত এক বছর ধরে৷ তার ওপর তাঁদের কোনো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা নাই৷ তাই অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটছে তাঁদের৷
উচ্ছেদের শিকার সাঁওতাল সিলমন বাসকি ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘আমি একজন কম্পাউন্ডার৷ উচ্ছেদের পর আমি ন'মাস কাজ করতে পারিনি৷ গত কয়েকমাস ধরে পাশের ইউনিয়নে একটি ওষুধের দোকান খুলে কোনোভাবে পরিবার পরিজন নিয়ে বেঁচে আছি৷ অনেকেরই কোনো কাজ নাই৷ সকলেই অনাহারে, অর্ধাহারে দিন কাটাচ্ছেন৷ কেউ কেউ তো বনের আলু ও লতা পাতা সংগ্রহ করেও খাচ্ছেন৷''
তিনি জানান, ‘‘নিহতদের পরিবার কোনো ক্ষতিপূরণ পায়নি৷ আহতদের মধ্যে অনেকেই এখনো সুস্থ হয়ে ওঠেননি৷ তাঁদের চিকিৎসাও চলছে না৷''
সাঁওতালদের দাবি, তাঁদের প্রায় দু'হাজার একর জমি জবর দখল করা হয়েছে৷ সেই জমির চারপাশে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে আখ চাষ শুরু করেছে চিনি কলের লোকজন৷ সেখানে পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে৷ তাই উচ্ছেদ হওয়া সাঁতালরা সেখানে যেতে পারছেন না৷
বাংলাদেশে আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্র নাথ সরেন ডয়চে ভেলেকে জানান, ‘‘সাঁওতালরা এখনো মাদারপুর-জয়পুরপাড়ায় তাঁবু খাটিয়ে বসবাস করছেন৷ কারুর আবার মাথার ওপর তাঁবুখানিও নাই৷'' সরকার বলছে, এঁদের করতোয়া নদীর পারে আশ্রয়ণ প্রকল্পে পুনর্বাস করবে৷ কিন্তু সাঁওতালরা সেখানে যেতে চান না৷ তাঁরা তাঁদের নিজেদের আবাস স্থলেই ফিরতে চান৷ ওই জমির মালিক তাঁরা৷ তাঁরা কয়েক পুরুষ ধরে ঐ জমিতে বসবাস করে আসছিলেন৷ শুনেছি সরকার নাকি ঐ জমিতে শিল্প স্থাপন করবে৷ আমরা তা হতে দেবো না৷''
সাঁওতাল পল্লিতে হামলায় আহতদের মধ্যে একজন চরেন সরেন৷ তিনি সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘‘পুলিশের গুলি আমার হাত ও পায়ে লাগে৷ আজও সেই ক্ষত বয়ে বেড়াচ্ছি৷ ঠিকমতো চিকিৎসা করাতে পারি না৷ টাকার অভাবে ওষুধ কেনা হয় না৷ প্রকৃত হামলাকারীরা গ্রেপ্তার হয়নি৷ তারা এখনও প্রকাশ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছে৷''
হামলার পর মিল কর্তৃপক্ষ সাঁওতালদের বিরুদ্ধে ১০টি মামলা দায়ের করে৷ সাঁওতালদের দু'টি মামলার এজাহারে ৩৩ জনের নাম-ঠিকানা উল্লেখসহ অজ্ঞাত এক হাজারের বেশি আসামি করা হয়৷ তাঁদের মধ্যে মাত্র একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল বলে জানান রবীন্দ্র নাথ সরেন৷
গাইবান্ধা জেলা প্রশাসক গৌতম চন্দ্র পাল ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘সাঁওতালদের পুনর্বাসনে গুচ্ছ গ্রাম আশ্রয়ণ প্রকল্পের কাজ চলছে৷ সেখানে তাঁরা বসবাস করতে পারবেন, জমিতে চাষাবাদ করে জীবিকা নির্বাহ করতে পারবেন৷ তাছাড়া সরকারি বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে সাঁওতালদের অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে তাঁদের স্বাবলম্বী করে তোলা হবে৷''
তিনি আরেক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘‘ওই জমি এখন আর সাঁওতালদের নয়৷ অনেক আগেই সরকার ওই জমি অধিগ্রহণ করে মালিকদের ক্ষতিপূরণ দিয়েছে৷ এখন ঐ জমি আইন অনুযায়ী শিল্প মন্ত্রণালয়ের৷''
কিন্তু সাঁওতালদের পুনর্বাসন আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত স্বপন শেখ ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘ঐ জমি সাঁওতালদের৷ আমরা চাই সাঁওতালদের তাঁদের ভিটেতেই পুনর্বাসন করা হোক৷ তাঁদের জমি ফিরয়ে দেওয়া হোক৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘সাঁওতালদের উচ্ছেদ করে এখন সেই জমিতে নানা সরকারি প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হচ্ছে৷ এটা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়৷''
রবীন্দ্র নাথ সরেন বলেন, ‘‘আমরা তিন দফা দাবিতে আন্দোলন করছি৷ সাঁওতালদের নিজ জমিতে পুনর্বাসন ও ক্ষতিপূরণ, আহতদের চিকিৎসা এবং অপরাধীদের বিচার৷ এই দাবি পূরণ না হওয়া পর্যন্ত আমাদের আন্দোলন চলবে৷''