সর্বোচ্চ সম্মান নিয়ে পুরোনো সেই বিতর্ক
৩০ জানুয়ারি ২০১৯কারো দাবি সাধু, সন্ত৷ কারো দাবি দলিত, মুসলিম৷ কেউ আবার প্রয়াত সাভারকারের মতো মানুষদের মরণোত্তর ভারতরত্ন দেওয়ার দাবি তুলছেন৷ ভারত জুড়ে শোরগোল৷ প্রজাতন্ত্র দিবসের প্রাক্কালে দেশের সর্বোচ্চ সম্মান প্রাপকদের নিয়ে আরো একবার রাজনীতির ময়দান সরগরম৷ তবে এ নিয়ে বিতর্ক নতুন নয়৷ বিগত কয়েক দশক ধরে ‘ভারতরত্ন' ও ‘পদ্ম' পুরস্কার ঘোষণা হলেই শুরু হয় দড়ি টানাটানি৷
১৯৯২ সালে রাষ্ট্রপতি ভবন থেকে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুকে ‘মরণোত্তর' ভারতরত্ন দেওয়ার কথা ঘোষণায় ব্যাপক বিতর্ক দানা বেঁধেছিল৷ ভারতের ইতিহাসে নেতাজিই একমাত্র স্বাধীনতা যোদ্ধা, যাঁর মৃত্যুদিন নেই৷ আরো স্পষ্ট করে বলতে গেলে নেতাজির মৃত্যুর কোনো প্রমাণ নেই৷ এই মহান নেতাকে ‘মরণোত্তর' সম্মান প্রদানের বিরোধিতা শুরু হয়েছিল দেশজুড়ে৷ মামলা গড়িয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত৷ নেতাজিপ্রেমীদের দাবি ছিল, যাঁর মৃত্যুর প্রমাণ নেই, তাঁকে কীভাবে মরণোত্তর ভারতরত্ন দেওয়া হয়? সে যাত্রায় রাষ্ট্রপতি ভবনের নির্দেশ স্থগিত রেখেছিল সর্বোচ্চ আদালত৷ সেবছরই মরণোত্তর সর্বোচ্চ সম্মান প্রদান করা হয়েছিল দেশের প্রথম শিক্ষামন্ত্রী মৌলানা আবুল কালাম আজাদকে৷ এই সম্মান নিয়ে বিতর্ক আরো আছে৷ অতীতে ১৯৫৫ সালে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রীকে ভারতরত্ন দিয়েছিল৷
ইন্দিরা গান্ধীও নিজেকে ভারতরত্ন দেওয়ার সুপারিশে মঞ্জুরি দিয়েছিলেন৷ পরে মরণোত্তর ভারতরত্ন দেওয়া হয়েছে প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীকে৷ মোদী রাজত্বে কয়েকবছর আগে ক্রিকেটার শচীন তেন্ডুলকরকে ভারতরত্ন দেওয়ায় বিপুল সমালোচনা হয়েছে৷ আবার লতা মঙ্গেশকর এই সম্মান পেলে কেন কিশোর কুমার বা মোহাম্মদ রফি পেলেন না, সেই প্রশ্নও ঘুরেফিরে এসেছে বহুবার৷ মোদী জমানায় অটলবিহারী বাজপেয়ীকে ভারতরত্ন দেওয়া হয়েছে৷ সঙ্গে সঙ্গে আরো একগুচ্ছ রাজনীতিকের নাম ভেসে উঠেছে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে৷
এ পর্যন্ত বাঙালি ভারতরত্নরা ছিলেন সত্যজিৎ রায়, রবিশঙ্কর ও অমর্ত সেন৷ তালিকার শেষ সংযোজন প্রণব মুখোপাধ্যায়৷ এছাড়া পশ্চিমবঙ্গে থেকে কাজ করেছিলেন মাদার টেরেজা৷ তিনিও ভারতরত্ন৷
অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন, ভারতীয় জনতা পার্টির প্রতিষ্ঠাতা সদস্যদের মধ্যে শ্যামাপ্রসাদ মুখোপাধ্যায়, দীনদয়াল উপাধ্যায়, বিনায়ক দামোদর সাভারকার, ভৈরোঁ সিং শেখাওয়াত থেকে লালকৃষ্ণ আদবানিকে বাদ দিয়ে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে কেন বেছে নিল নরেন্দ্র মোদীর সরকার? একটা মহল মনে করছে, এবার প্রণব মুখোপাধ্যায়কে ভারতরত্ন দিয়ে বাংলার মন জয়ের চেষ্টা করেছে মোদী সরকার৷ কারণ, কয়েকমাস পর দেশে সাধারণ নির্বাচন৷তাঁরা মনে করেন, নির্বাচনে বাংলায় বিশেষ নজর শাসক দলের৷ তবে অনেকে এ-ও বলছেন, ভারতে জীবিত রাজনীতিবিদদের মধ্যে প্রণবের মতো রাজনৈতিক ‘ট্র্যাক রেকর্ড' আর কারো নেই৷ তিনি দু-বার দেশের অর্থ মন্ত্রক, দু-বার বাণিজ্য মন্ত্রক, দু-বার বিদেশ মন্ত্রকের দায়িত্ব সামলেছেন৷ রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হয়েছেন৷ ২০০৮ সালে তাঁকে পদ্মবিভূষণ দিয়েছে সরকার৷ এরপর তাঁকে ভারতরত্ন সম্মান দিয়ে কোথাও অন্যায় করেনি মোদী সরকার৷ তাছাড়া যাঁরা তাঁর সম্মানের পেছনে রাজনীতি খুঁজছেন, তাঁদের জানা উচিত, মোদী সরকার প্রণববাবুকে দ্বিতীয়বার রাষ্ট্রপতি করার কথা বিবেচনা করেনি৷
নানা মহলে প্রশ্ন উঠেছে নরেন্দ্র মোদী কেন প্রণব মুখোপাধ্যায়কে বেছে নিলেন? ভারতের রাজধানীতে প্রায় তিন দশক ধরে কাজ করার অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সাংবাদিক জয়ন্ত ঘোষাল ডয়চে ভেলেকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই দিকে আলোকপাত করলেন৷ তিনি বললেন, ‘‘২০১৯-র লোকসভাকে সামনে রেখে এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারতে চাইছেন৷ কংগ্রেস জমানায় তাঁকে এই সম্মান দেওয়া হয়নি৷ বিজেপি করে দেখিয়েছে৷ একদিকে নরেন্দ্র মোদীর বিরুদ্ধে বিরোধীদের তোলা সংকীর্ণতা, অসহিষ্ণুতার অভিযোগ খন্ডিত হতে পারে, অন্যদিকে সঙ্ঘ পরিবার, বামপন্থি ও দক্ষিণপন্থিসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে তাঁর ওতপ্রোত যোগাযোগ কারো অজানা নয়৷ ভবিষ্যতে তিনি প্রধানমন্ত্রী পদের দাবিদার হিসেবে উঠে আসতে পারেন কিনা তা নিয়ে যখন জল্পনা শুরু হয়েছে, তখন এই ধরনের সর্বোচ্চ সম্মান দিয়ে তাঁকে সেই ইঁদুর দৌড় থেকে বাইরে রাখার একটি প্রয়াস হতে পারে৷'' তিনি মনে করেন, এই সিদ্ধান্তে কংগ্রেসকে অস্বস্তিতে ফেলার পাশাপাশি বাংলা ও বাঙালির মন জয়ের চেষ্টা আছে৷ তবে, যে যা-ই বলুন না কেন, পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যন্ত কীর্ণাহার গ্রাম থেকে উঠে এসে দেশের প্রথম নাগরিক হয়েছেন তিনি৷ বরাবর সওয়াল করেছেন বহুত্ববাদ ও ঐক্যমতের রাজনীতির পক্ষে৷
এবার প্রয়াত সংগীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা ও প্রয়াত সমাজকর্মী নানাজি দেশমুখকে মরনোত্তর ‘ভারতরত্ন' সম্মানে ভূষিত করা হয়েছে৷ তাঁদের নিয়েও জলঘোলা হয়েছে৷ বলা হচ্ছে, উত্তর-পূর্বে নাগরিকত্ব বিল নিয়ে অসন্তোষের আগুন জ্বলছে, সেই আগুনে জল ঢালার চেষ্টায় হাজারিকা এবং সঙ্ঘ পরিবারের মন রাখতে নানাজি দেশমুখকে বেছে নিয়েছে সরকার৷ নানাজি আর এস এসের নেতা ছিলেন৷ সঙ্ঘের সভাপতিও ছিলেন৷ প্রকাশ্যে ১৯৮৪'র শিখ দাঙ্গাকে সমর্থন করার অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে৷
ওদিকে, এই ইস্যুতে বিতর্ক উস্কে দিয়েছেন যোগগুরু রামদেব, এমআইএম প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়েসি, আম আদমি পার্টির সাংসদ সঞ্জয় সিং এবং কর্ণাটকের জনতা দল(সেকুলার) নেতা দানিশ শেখ৷ ওয়েসির প্রশ্ন, এ পর্যন্ত যাঁদের ভারতরত্ন সম্মান দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে কতজন দলিত, আদিবাসী, মুসলমান বা উচ্চবর্ণের? মৃত্যুর ৩৪ বছর পর চাপে পড়ে সংবিধান প্রণেতা বি আর আম্বেদকরকে এই সম্মান দেওয়া হয়েছিল৷
আপ নেতা সঞ্জয় সিংয়ের কথায়, ‘‘সঙ্ঘের শাখায় একবার যাও, আর রত্ন হয়ে যাও৷'' দানিশ শেখের কথায়, ‘‘আরএসএসের সদর দপ্তরে গিয়ে সঙ্ঘ প্রতিষ্ঠাতা কে বি হেগড়েওয়ারকে ‘ভূমিপুত্র' বলার পুরস্কার হিসেবে প্রণববাবুকে ভারতরত্ন দেওয়া হলো৷'' এলাহাবাদের কুম্ভমেলায় গিয়ে রামদেব বলেছেন, ‘‘দেশের কোনো সাধু বা সন্ন্যাসী এই সম্মান পেলেন না৷ একজন সাধু বা সন্ন্যাসী আজ অবধি ভারতরত্ন পাননি৷ মহর্ষি দয়ানন্দ বা স্বামী বিবেকানন্দের অবদান কোনো রাজনৈতিক নেতা বা খেলোয়াড়ের থেকে কম নয়৷''
প্রসঙ্গত, ভারতরত্ন ও পদ্মভূষণ পুরস্কার কাদের দেওয়া উচিত, এ ব্যাপারে নানা মহলের পরামর্শ চায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক৷ বিভিন্ন মহল থেকে পরামর্শ (কারণসহ) আসার পর তা থেকে একটি তালিকা তৈরি হয়৷ সেই তালিকা পাঠানো হয় কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায়৷ মন্ত্রিসভার মঞ্জুরি পাওয়ার পর চূড়ান্ত তালিকা পাঠানো হয় রাষ্ট্রপতির কাছে৷ তারপর হয় ঘোষণা৷
তবে, পদ্ধতি যা-ই হোক না কেন, সরকার প্রদত্ত সম্মান প্রাপকদের নিয়ে বিতর্ক থামার কোনো লক্ষণ নেই৷ ভারতরত্ন এবং পদ্মভূষণ প্রাপকদের নাম ঘোষণার পরেই অসমের সংগীত শিল্পী জুবিন গর্গ একটি গান গেয়েছেন, তাতে ‘পলিটিক্স না করিবো বন্ধু' বলে এসব পুরস্কারকে কটাক্ষই করেছেন তিনি৷ পরে মামলাও হয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে৷