‘জবাবদিহিতা চাইলে কেউ আওয়ামী দোসর ট্যাগ দিলে দেবে'
৩০ নভেম্বর ২০২৪নানাভাবে ট্যাগ দিয়ে বিরুদ্ধমতকে চাপা দেয়ার রাজনীতি নিয়ে তার সঙ্গে কথা বলেছে ডয়চে ভেলে...
ডয়চে ভেলে: হাসিনা সরকারের সময় দেখা যেতো তাদের কোনো সমালোচনা করলে বিএনপি, জামায়াত, রাজাকার ইত্যাদি ট্যাগ দেয়া হতো। হাসিনা সরকারের পতনের পর সেই পরিস্থিতি থেকে আমরা কতটা বেরিয়ে আসতে পেরেছি?
ড. সামিনা লুৎফা: সেই পরিস্থিতি থেকে পুরোপুরি বের হয়ে আসতে পেরেছি সেটা আমি মনে করি না। তবে চেষ্টা তো নিশ্চয়ই আছে। একটা লম্বা সময় ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থা, তার শাসক চলে গেলেই যে ফ্যাসিবাদী মনন বা সংস্কৃতি চলে যায় তা তো নয়। এটা যেতে একটু সময় লাগে। আমি বলছি না যে তিন মাস বেশি বা কম সময়। এখন যে ধরনের অরাজকতা বা হিংসা দেখা যাচ্ছে, সেই জিনিসগুলো নিয়ে সরকারের খুব স্পষ্ট অবস্থান থাকা দরকার এবং পরিস্থিতি ঘোলাটে হওয়ার আগে অবস্থান স্পষ্ট করলে বরং পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। না করলে যেটা হয়, তা তো আমরা দেখতে পাচ্ছি।
এখন দেখছি কারো কথা বিরুদ্ধে গেলে ‘ফ্যাসিবাদের দালাল' বলা হয়। আরো নানা ট্যাগ দেয়া হয়। এই ট্যাগের কালচার আপনি দেখতে পাচ্ছেন কিনা, বা এটা কেন হচ্ছে?
হ্যাঁ এটা হচ্ছে। আগে তো কেউই কথা বলতে পারতো না। এখন সবাই কথা বলছে। এই সবার মধ্যে যে ফ্যাসিবাদের দালালরাও যে বলছে না তা তো নয়। এবং তাদের সাথে সাথে এই যে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক নেটওয়ার্ক, সরকারের সমালোচনা আমরাও একদম প্রথম দিন থেকেই করছি, সরকারকে নানাভাবে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখার চেষ্টা করছি। তার মানে, আমাদেরকে যে ট্যাগ দেয়া হচ্ছে না, তা তো না। আমাদের অনেক সদস্যকেই আলাদাভাবে টার্গেট করে নানাভাবে অন্য নতুন ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। ধর্মবিদ্বেষী বা শাহবাগী এসব বলে আমাদের ট্যাগ দেয়া হচ্ছে। কিন্তু যারা ন্যায় বিচারের জন্য , বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়বেন, তাদের তো এগুলোর মধ্য দিয়েই যেতে হবে। সরকারকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখাই তো আমাদের কাজ। কিন্তু সেটা করতে গেলে কেউ যদি আওয়ামী লীগের দোসর বলে ট্যাগ দেয়, দেবে।
এইসব বিষয়ে সরকারের দিক থেকে মেসেজটা কি ক্লিয়ার? এই যেমন আপনি পাঠ্যপুস্তক সংস্কার কমিটির সদস্য ছিলেন। তখন আপনার বিরুদ্ধে একটি গ্রুপ লেগে গেল। আপনাকে নাস্তিক আখ্যা দিলো, সমকামীর সমর্থক বললো। তো সরকারের দিক থেকে যে মেসেজ থাকার কথা ছিলো সেটা কি দেয়া হয়েছিল? বরং কমিটি থেকে তো আপনাকে বাদ দেয়া হলো।
না , সরকারের দিক থেকে কোনো মেসেজ ছিল না। আর কমিটি থেকে আমাকে বাদ দেয়া হয়নি। পুরো কমিটিই বাতিল করা হয়েছে। আমার বা আমাদের দুইজনের বিরুদ্ধে যে প্রচারণা তৈরি হয়েছিল, তখন আমাদের আলাদাভাবে বাদ না দিয়ে পুরো কমিটিই বাতিল করে দেয়া হয়েছিল। এখানে সরকারের স্পষ্ট করা দরকার ছিল। এবং সরকারের অবস্থানটা আমাদের জানা দরকার ছিল। তবে কমিটি বাতিল করার আগেই আমরা সংস্কারের কাজ প্রায় শেষ করেছিলাম। ফলে কমিটি বাতিল করায় তেন কিছু হয়নি। তবে এতে দেশের মানুষের কাছে একটা ভুল বার্তা চলে যায় যে সরকার যে কোনো ধমকে কোন দিকে চলে যায়।
আওয়ামী লীগের দোসর, ফ্যাসিবাদের দোসর তো আছে। কিন্তু তাদের চিহ্নিত না করে কেউ যদি সরকারের সমালোচনা বা বিরোধিতা করে, তাহলে ঢালাওভাবে ফ্যাসিবাদের দোসর , আওয়ামী লীগের দোসর বার বার বলা ভুল মেসেজ দেয় কিনা? এই যে তথ্য উপদেষ্টা বললেন সাংবাদিকদের মধ্যে এখনো ফ্যাসিবাদের দোসর আছে, চিহ্নিত না করে এভাবে বলা ভুল মেসেজ দেয় কিনা?
হ্যাঁ, সেটা তো অবশ্যই। যাদের বিরুদ্ধে পরিস্কার অভিযোগ আছে , প্রমাণ আছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া উচিত। যেহেতু গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। গণহত্যার সঙ্গে প্রত্যক্ষ, পরোক্ষভাবে জড়িত যারা, যারা সাফাই গায়, যারা সহযোগিতা করেছে, যারা উসকানি দিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেয়া প্রয়োজন। এখানে একটা জিনিস খুব গুরুত্বপূর্ণ। যারা গণহত্যার মূল চরিত্র ছিলেন, তারা কিন্তু দেশের বাইরে চলে গেছেন। এটা একধরনের ভ্যাকুয়াম তৈরি করেছে। মানুষের মনে আস্থার সংকট তৈরি করেছে। যে কয়দিন সরকার ছিল না, তারপর অন্তর্বতী সরকার... তখন কিন্তু মানুষের মনে বিশ্বাস জন্মেছিল যে, তারা বিচারের ব্যবস্থা করবেন। কিন্তু সেই বিশ্বাসে ফাটল ধরেছে, যেহেতু তারা দেশের বাইরে চলে গেছেন। দেশের বাইরে বসে ফোনালাপ করছেন।
আন্দোলনে নানা চিন্তার ও আদর্শের মানুষ একসঙ্গে অংশ নিয়েছে। কিন্তু এখন তাদের মধ্যে বিভেদ দেখা যাচ্ছে। যে যার অবস্থান থেকে দখল নেয়ার চেষ্টা করছে। আবার সরকারে যারা আছেন, তারাও একেকজন একেক কথা বলছেন। সরকারের বাইরে কিন্তু সরকারকে যারা বসিয়েছেন, তাদের মধ্যেই নানা ভাগ। আপনার পর্যবেক্ষণ কী? করণীয় কী?
করণীয় হলো, তাদের মধ্যে ঐক্যের বার্তা ছড়িয়ে দিতে হবে। সরকারকে দায়িত্ব নিতে হবে। দায়িত্ব নেবেন বলেই তারা সরকারে গিয়েছেন। তাদের দায়িত্ব ও জবাবদিহিতা থাকতে হবে। তারা ফেল করলে আমরা তাদেরকেই বলবো- সেটা যেমন সত্যি, তেমনি তাদের দায়িত্বের কিছু অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে। তার মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হলো আহতদের পুনর্বাসন, নিহতদের পরিবারগুলোকে পুনর্বাসন করা, গণহত্যার সাথে জড়িতদের বিচার। তবে সবার আগে জনগণের নিরাপত্তা দিতে হবে, জিনিসপত্রের দাম কমাতে হবে৷ এগুলো করার পর সংস্কার তো করাই যাবে। শিক্ষক-ছাত্রের মধ্যে তো এক ধরনের আস্থার সংকট তৈরি হয়েছে।
আমরা এখন শুনতে পাচ্ছি ষড়যন্ত্র... তারা আওয়ামী লীগ হয়ে ফিরে আসছে। আসলেই কি ষড়যন্ত্র, নাকি এটা দায় এড়ানোর জন্য বলা?
ভয় আছে। দায় এড়ানোর জন্য কী না তার চেয়ে বড় কথা- বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে ভয় আছে। এবং সেই ভয়টা এখনো দূর হয়নি। হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের তো বাইরে পালিয়ে যেতে সহায়তা করা হয়েছে। তারা বাইরে বসে হুঙ্কার ছাড়ছে। হুমকি দিচ্ছে, এই চলে আসলাম, এই চলে আসলাম। এবং তাদের দেশের বিভিন্ন এলাকায় সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে। এর ফলে ভয়টা রিয়েল ভয়ে পরিণত হয়েছে। মানুষ এই ভয় থেকেই কথাগুলো বলছে। কিন্তু সেটা সরকারের উচিত যদি সত্যিই ষড়যন্ত্রও হয়, তাহলে গোয়েন্দা সংস্থার মাধ্যমে সঠিক তথ্য সংগ্রহ করা। একজন মানুষের নিরাপত্তাও যেন বিঘ্নিত না হয়। নিরাপত্তা বিঘ্নিত হলে সেটার দায়িত্ব তো সরকারকেই নিতে হবে। এভাবে দায় চাপিয়ে তো লাভ নাই। অ্যাটর্নি জেনারেল যদি আদালত চত্বরে হামলার শিকার হন, আইনজীবীরা আহত হন- সেটার দায় তো সরকারকে নিতে হবে।