শূন্যপদ ম্যাজিক, ৭৮১ হয়ে গেলো ৪৬ হাজার
৭ ডিসেম্বর ২০২৩পশ্চিমবঙ্গের স্কুল শিক্ষার বিভিন্ন স্তরে শিক্ষকের শূন্যপদ রয়েছে। এর ফলে ব্যাহত হচ্ছে পঠনপাঠন। এদিকে শূন্যপদে নিয়োগের দাবি তুলে আন্দোলন চালাচ্ছেন চাকরিপ্রার্থীরা। মামলার নিষ্পত্তি হলে চাকরি মিলবে, আশা এমনই। এই পরিস্থিতিতে শিক্ষামন্ত্রীর শূন্যপদ সংক্রান্ত বক্তব্য ঘিরে তৈরি হয়েছে ধোঁয়াশা।
শিক্ষামন্ত্রীর তথ্য
মঙ্গল ও বুধবার রাজ্য বিধানসভায় স্কুল শিক্ষকের শূন্যপদ নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য দিয়েছেন শিক্ষামন্ত্রী ব্রাত্য বসু। মঙ্গলবার তিনি বলেন, ‘‘স্কুলের বিভিন্ন স্তর অর্থাৎ প্রাথমিক, উচ্চ প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে শিক্ষকের শূন্যপদ রয়েছে ৭৮১টি। এর মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিকে ১৩টি, মাধ্যমিকে ২৮টি, উচ্চ প্রাথমিকে ৪৭৩টি এবং প্রাথমিকে ২৬৭টি শূন্যপদ।’’ শিক্ষামন্ত্রীর এই তথ্য ঘিরে বিস্ময় ও ক্ষোভ তৈরি হয় শিক্ষক ও চাকরিপ্রার্থীদের একাংশের মধ্যে।
বুধবার শিক্ষামন্ত্রী রাজ্য বিধানসভায় নিজের তথ্য শুধরে বলেছেন, শূন্যপদের সংখ্যা অনেকটাই বেশি। তিনি বলেন, ‘‘বিধানসভার প্রশ্নোত্তর পর্বে আমি বলেছিলাম, শিক্ষকের শূন্যপদ কত, আমার পক্ষে এই মুহূর্তে বলা সম্ভব নয়। প্রতিনিয়ত কেউ না কেউ অবসর নিচ্ছেন। আমার এই কথায় বিতর্ক তৈরি হয়েছে। তথ্য দিয়ে বিতর্কের অবসান করতে চাই।’’
স্কুল সার্ভিস কমিশনকে ২০২২ সালে যে তথ্য রাজ্য দিয়েছে, সেই অনুযায়ী প্রাথমিকে এখন শূন্যপদ ১১ হাজার ৭৬৫। এই পদে নিয়োগ শুরু হয়েছে। উচ্চ প্রাথমিকে শূন্যপদের সংখ্যা ১৪ হাজার ৩৩৯। সেখানে আদালতের নির্দেশে কাউন্সেলিং চলছে বলে জানান শিক্ষামন্ত্রী। মাধ্যমিকে ১৩ হাজার ৫০০-র কিছু বেশি পদ খালি আছে। উচ্চ মাধ্যমিকে শূন্যপদের সংখ্যা সাড়ে পাঁচ হাজারের বেশি। আদালতের নির্দেশ পেলে এই পদে যাতে নিয়োগ শুরু করা যায়, তার চেষ্টা রাজ্য করছে বলে দাবি ব্রাত্যর।
এর ভিত্তিতে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, ‘‘এই হিসেবের পরেও সামান্য যা পদ খালি পড়ে আছে, তা নিয়ে বিধানসভায় আমি তাৎক্ষণিক ভাবে মন্তব্য করেছিলাম।’’ শূন্যপদের আনুমানিক সংখ্যাই বলেছিলেন বলেও জানান ব্রাত্য।
তথ্য ঘিরে বিতর্ক
রাজ্যে বিভিন্ন স্কুলে ছাত্রের অনুপাতে পর্যাপ্ত শিক্ষক নেই। এজন্য কোথাও কোথাও বিশেষ শাখা, যেমন বিজ্ঞান কিংবা গণিতের মতো বিষয়ের ক্লাস করানো যাচ্ছে না বলে অভিযোগ। দীর্ঘদিন নিয়োগ না হওয়ার ফলে এই পরিস্থিতি। নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় অনেকের চাকরি চলে গিয়েছে। সেসব মামলার নিষ্পত্তি ঝুলে রয়েছে।
হাজার হাজার চাকরিপ্রার্থী নিয়োগের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করছেন। তাদের দাবি, বিপুল সংখ্যায় শিক্ষক নিয়োগ করা না হলে সুষ্ঠুভাবে পঠনপাঠন সম্ভব নয়। এমন পরিস্থিতিতে শূন্যপদের সংখ্যা মাত্র ৭৮১ হয় কী করে? এই প্রশ্ন ওঠে। এছাড়া মন্ত্রীর দাবির সঙ্গে তার দপ্তরের আদালতে পেশ করা বক্তব্যের মিল হচ্ছিল না। সেখানেও কয়েক হাজার শূন্যপদের কথা বলা হয়েছে।
অ্যাডভান্স সোসাইটি ফর হেডমাস্টার্স অ্যান্ড হেডমিস্ট্রেস-এর রাজ্য সাধারণ সম্পাদক চন্দন মাইতির বক্তব্য, ‘‘গত ২৯ জুলাই হাইকোর্টে শিক্ষা দপ্তর চারটি স্তরে যে শূন্যপদের সংখ্যা জানিয়েছিল, তার সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রীর দেয়া তথ্যের সাযুজ্য নেই। প্রায় পাঁচ বছর ধরে নিয়োগ হচ্ছে না। নিয়মিত শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীরা অবসর নিচ্ছেন। তাই সর্বশেষ শূন্যপদের সংখ্যা জানানো সরকারের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’’
ধোঁয়াশা কি কাটলো?
বিতর্কের জন্ম হওয়ার ২৪ ঘণ্টার মধ্যেই তা নিরসনের চেষ্টা করেছেন শিক্ষামন্ত্রী। এক লাফে শূন্যপদের সংখ্যা পৌছে গিয়েছে ৪৫ হাজার ৮৮৫ তে। ‘তাৎক্ষণিক মন্তব্যের’ পরের দিন শিক্ষামন্ত্রীর নয়া তথ্য কি চাকরি প্রার্থী বা শিক্ষকদের মনের ধন্দ মেটাতে পারলো?
চাকরির দাবিতে হবু শিক্ষকরা পথের ধারে বসে অবস্থান আন্দোলন করে চলেছেন মাসের পর মাস। তাদের অন্যতম আবু নাসের বলেন, ‘‘শিক্ষামন্ত্রীর দুদিনের বক্তব্য আমাদের ধোঁয়াশার মধ্যে ফেলেছে। দপ্তরের আধিকারিকরা স্বাভাবিক নিয়মেই বদলে যাবেন। কিন্তু মন্ত্রীকে সর্বশেষ তথ্য জানতেই হবে। কতজন অবসর নিলেন, কত শূন্যপদ তৈরি হল ইত্যাদি। আর শুধু পদ তৈরি করলেই হবে না, নিয়োগ দিতে হবে।’’
শিক্ষানুরাগী ঐক্য মঞ্চের সাধারণ সম্পাদক কিংকর অধিকারী বলেন, ‘‘বিতর্কের মুখে শিক্ষামন্ত্রী তথ্য সংশোধন করতে বাধ্য হয়েছেন। এতেই হবে না, দ্রুত নিয়োগের ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে ছাত্রছাত্রীরা বছরের পর বছর পড়াশোনা থেকে বঞ্চিত হবে।’’
মামলা নিষ্পত্তির অপেক্ষা
স্কুলের শিক্ষক নিয়োগ নিয়ে একগুচ্ছ মামলা আদালতে বিচারাধীন। সুপ্রিম কোর্ট নিয়োগ দুর্নীতির মামলা নিষ্পত্তির সময় বেধে দিয়েছে। মামলার নিষ্পত্তি হলেই যে নিয়োগ হবে যোগ্য চাকরিপ্রার্থীদের, এমন নিশ্চয়তা কি আছে?
এই সংশয়ের মধ্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলায় চাকরি বাতিল হওয়া পরীক্ষার্থীদের নিজেদের মত জানানোর সুযোগ দিল কলকাতা হাইকোর্ট। ২০১৬ সালের স্কুল সার্ভিস কমিশনের পরীক্ষায় নিয়োগপ্রাপ্ত ২৩ হাজার ৫৪৯ জনের চাকরি বাতিল করেছিল কলকাতা হাইকোর্ট। এই মামলা সুপ্রিম কোর্টে যায়। শীর্ষ আদালত এদের প্রত্যেককে নোটিস পাঠাতে বলেছে রাজ্য সরকারকে।
যাদের চাকরি বাতিল হয়েছে তারা নিজেদের বক্তব্য আদালতে জানাতে পারবেন। ৯ জানুয়ারি মধ্যে এই মামলার নিষ্পত্তি করতে হবে হাইকোর্টের ডিভিশন বেঞ্চকে। এই সময়ের মধ্যে সিবিআই চূড়ান্ত রিপোর্ট দেবে। আর এক মাসের মধ্যে বোঝা যেতে পারে, প্রায় ২৪ হাজার শিক্ষক-শিক্ষিকা ও শিক্ষাকর্মীর মধ্যে কাদের চাকরি বহাল থাকবে। এসব ক্ষেত্রে নিয়োগের প্রশ্ন আসবে তারও পরে।