‘শিক্ষকের গোঁড়ামি ছাত্রের মধ্যে সঞ্চারিত হয়’
২৯ মার্চ ২০২৪এসব বিষয়ে ডয়চে ভেলের সঙ্গে কথা বলেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান।
ডয়চে ভেলে : কিছু হলেই আমরা বলছি, অনুভূতিতে আঘাত লেগেছে। আসলে অনুভূতি কী?
অধ্যাপক ড. সিদ্দিকুর রহমান : অনুভূতি হলো মানুষের এক ধরনের সংবেদনশীলতা। মানুষ যে তার চিন্তা ধারা আশা আকাঙ্খা, যা সে আশা করে, যা সে দেখতে চায় এর পরিপন্থী যদি কিছু হয় তখনই অনুভূতিতে আঘাত লাগে। যেমন ধরেন আমরা বাংলাদেশের মানুষ চাচ্ছি যে, সব জায়গায় সবাই শান্তিতে থাকুক, কিন্তু প্যালেস্টাইনে মানুষ মরছে এটা আমাদের আশার বিপরীতে ঘটছে। এটা আমাদের চাওয়া পাওয়া চিন্তাধারার বিপরীতে হচ্ছে।
সাধারণভাবে অনুভূতি কেমন হওয়া উচিৎ? অনুভূতির গুরুত্ব কতটুকু?
অনুভূতি ব্যক্তির ক্ষেত্রে তারতম্য হয়। পার্থক্য দেখা যায়। মানুষের অভিজ্ঞতা, তার অতীত জীবন, তার বর্তমান জীবন এগুলোর সঙ্গে সম্পৃক্ত। একটা উদাহরণ দেই, একজন যদি সব সময় সুখে থাকে তার কোন অভাব ছিল না। খেলাধুলা করে বড় হলো। এখন যদি তার একটা বিপদ হয় তাহলে তার অনুভুতিতে আঘাত লাগবে। আরেকটা ছেলে যে দুঃখকষ্টে বড় হয়েছে পথশিশু। কখনও খাওয়া পেয়েছে, কখনও খাওয়া পায়নি। এখন যদি কেউ তাকে একটু আদর করে, যত্ন করে, একটু ভালোবাসা দেয় তাহলে তার একটা ইতিবাচক অনুভূতির সৃষ্টি হবে। সে অনেক কিছু পেয়ে গেছে মনে করবে। অনুভূতি দুই রকমের হতে পারে। এটার মাত্রাও আছে। ভালো অনুভূতির মাত্রা কমবেশি আছে, খারাপ অনুভূতিরও মাত্রা কমবেশি আছে। খারাপ জিনিসে সবাই ব্যথা পায়।
আমাদের শিক্ষা কারিকুলামে কী অনুভূতির বিষয়টা আছে?
বর্তমানে যে কারিকুলাম সেটার সঙ্গে আমি জড়িত নেই। তবে ২০১২ সালে আমরা যে কারিকুলাম করেছি সেটা গত বছর পর্যন্ত চালু ছিল। এটা সঙ্গে আমি যুক্ত ছিলাম। সেখানে অনুভূতির বিষয়টা ছিল উপরের ক্লাসে। এইচএসসিতে ছিল মনোবিজ্ঞানে। অনুভূতির কিছু বিষয় পরোক্ষভাবে ছিল। যেমন মানুষ মানুষের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করবে ওইটা আমরা নৈতিক শিক্ষায় অর্ন্তভুক্ত করেছি। আমি অন্যের সঙ্গে কেমন ব্যবহার করব, তার উপর অন্যের অনুভূতিনির্ভর করছে। আমি যদি তার সঙ্গে ভাল ব্যবহার করি, তাহলে তার এক ধরনের অনুভূতি হবে। আমি যদি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করি, যেটা সে আশা করেনি তখন তার নেতিবাচক অনুভূতি হবে। নৈতিক শিক্ষার মধ্যে অনেক কিছু ছিল। যেমন নৈতিক শিক্ষা পরিবার থেকে শুরু হয়। স্কুলেও এটা থাকা দরকার। আমি স্বীকার করি, আগের কারিকুলামে এটা প্রত্যক্ষভাবে ছিল না। এ বছর যে নতুন কারিকুলাম শুরু হল সেখানে এটা কতটা আছে আমি বলতে পারব না।
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে অনুভূতি নিয়ে শিক্ষার্থীদের কী কোন ধারণা দেওয়া হয়?
উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে যারা মনোবিজ্ঞান নিয়ে পড়ে তাদের দেওয়া হয়। অন্য বিষয়গুলোতে খুব একটা দেওয়া হয় না। আমি যতটুকু জানি।
ধর্মীয় অনুভূতির বিষয়ে শিক্ষার্থীদের কী ধরনের ধারণা দেওয়া হয়?
বাংলাদেশে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ধর্ম শিক্ষা বাধ্যতামূলক। চারটা ধর্মের যে কোন একটা পড়তে হয়। ধর্ম শিক্ষার বইগুলো তৈরির জন্য আমরা লেখকদের যে ধরনের নির্দেশনা দিয়েছিলাম সেখানে অনুভূতির বিষয়টা বেশ কভার করা হয়েছে। ধর্মীয় সহিষ্ণুতা, অন্য ধর্মের প্রতি বিদ্বেষ পোষণ করব না, আমি আমার ধর্মের লোকদের যেমন ভালবাসবো, প্রতিবেশি অন্য ধর্মের লোকদেরও ভালবাসবো এগুলো ছিল। ২০১২ সালের কারিকুলামে ধর্ম শিক্ষার সঙ্গে নৈতিক শিক্ষাকে আমরা যুক্ত করে দিয়েছিলাম। শুধু বইয়ের নাম নয়, ভেতরেও এই বিষয়গুলো ছিল। বইয়ে যেভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, স্কুলগুলো ঠিক সেভাবেই পড়ানো হয়, সেটা আমি পুরোপুরি মানবো না। কারণ স্কুলে যারা ধর্ম শিক্ষা দেন, তারা কিন্তু বিভিন্ন ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে পাস করা। ধরেন দাখিল, কামিল যারা পাস করে তারা ইসলাম ধর্ম শেখায়। হিন্দু ধর্ম শেখায় পণ্ডিত যারা। তাতে বই যতই সংবেদনশীলতার সঙ্গে লেখেন, পড়াতে গেলে বইয়ের বাইরেও কিছু ছাত্রদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। সবাই করে সেটা বলছি না, তবে অনেকেই করে। যারা সুপারভাইজ করেন তাদের এদিকে নজর দিতে হবে। মৌলভী সাহেব বা পণ্ডিতরা যেটা পড়ান সেখানে বই যতটা উদারপন্থী হই না কেন তাদের মধ্যে একটা ধর্মীয় গোঁড়ামি থেকেই যায়। সেটা ছাত্রদের মধ্যে সঞ্চারিত হয়। সবার মধ্যে যে গোঁড়ামি থাকে সেটা আমি বলছি না। কিন্তু কারও কারও মধ্যে থাকে।
অনুভূতিই একজন মানুষের সম্মান? কিছুদিন আগে বুয়েটে প্রথম হওয়া আদনানকে নিয়ে যে সোশ্যাল মিডিয়ায় ট্রল হলো তা কী ঠিক হয়েছে?
এটা হওয়া ঠিক হয়নি। মানুষকে মানুষের মতো দেখতে হবে। সেটা হলে অন্যের অনুভূতিতে আঘাত লাগার কথা না। ধর্মের কথা বাদ দিলেও হতে পারে। যেমন ধরেন বুয়েটে যারা কম্পিউটারে পড়ে, ইলেকট্রনিক্সে পড়ে তারা মনে করে আমরা মেরিটে স্কোর বেশি পেয়েছি। যারা মেকানিক্যালে পড়ে বা সিভিল পড়ে তাদের চেয়ে আমরা ভালো ছাত্র। তারা যদি ওদের সঙ্গে মেলামেশা না করে, ওদের হেয় চোখে দেখে তাহলেও ওদের অনুভূতিতে এটা লাগবে।
আমরা অপরের অনুভূতিকে খুব বেশি শ্রদ্ধা করি না কেন?
আমাদের মধ্যে একটা বড়ত্ব ভাব কাজ করে। যেমন আপনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আপনি আপনার পিওনের সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করবেন সেটার ওপর নির্ভর করবে আপনার পিওনের অনুভূতিতে কতটা আঘাত লাগবে? আপনি যদি মনে করেন, সে আমার চাকর, আমার কথামতো চলবে, পান থেকে চুন খসলেই যদি আপনি তাকে হেনস্থা করেন তাহলে তো তার অনুভূতিতে দারুণভাবে লাগবে। এখানে ব্যক্তি থেকে ব্যক্তি আলাদা। কারণ হলো আপনার পারিবারিক শিক্ষা কি, আপনার প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা কি, আপনি কোন পরিবেশে বড় হয়েছেন তার উপর নির্ভর করবে। অনুভূতির বিষয়টা স্পর্শকাতর। মানুষের যে মানবিক গুণাবলি তার উপরে অনেকটা নির্ভর করে। শিক্ষায় তো থাকা উচিৎই। পাশাপাশি প্যারেন্টাল এডুকেশন দরকার। অভিভাবকেরা শিশুকে কিভাবে মানুষ করবে? তার সঙ্গে কী ধরনের ব্যবহার করবে? এগুলোও শিখাতে হবে। এটা কিন্তু আমাদের পরিকল্পনায় নেই।
কিভাবে শিক্ষার্থীদের অনুভূতি নিয়ে শিক্ষা দেওয়া যায়? এর জন্য করণীয় কী?
সরকার তো পলিসি দেবে। আর বাস্তবায়নটা হবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে। এটা কারিকুলামের মধ্যেই থাকতে হবে। আমাদের দেশে রিক্সাচালক, বাস ড্রাইভারকে যে দৃষ্টিতে দেখি ইউরোপীয় দেশগুলোতে কিন্তু সেভাবে দেখে না। সেখানে কাজের ক্ষেত্রে ছোট বড় কিছু নেই। সেখানে যদি একজন পিএইচডি রিসার্চ ফেলোর ছেলে বাস ড্রাইভার হয় তখন সে বুক ফুলিয়ে বলে আমার ছেলে বাস ড্রাইভার। কিন্তু আমাদের দেশে আমার ছেলে বাস ড্রাইভার হলে আমি সেটা লুকিয়ে রাখতাম। বাস ড্রাইভিং যে একটা ভালো পেশা, সে যে চুরি করছে না। বাস ড্রাইভারের সামাজিক মর্যাদা যদি আমরা দেই তাহলে তাদের অনুভূতিটা অন্যরকম হবে। সে তার পেশার প্রতি আরও বেশি যত্নশীল হবে। আরও ভালো সেবা দেওয়ার উৎসাহ-আকাঙ্খা বেড়ে যাবে। সমাজটা আরও সুন্দর হবে।