মার্কস এবং এঙ্গেলস সাহেব অনেক চিন্তাভাবনা করে জানিয়েছিলেন, কীভবে ক্যাপিটালিস্ট সিস্টেমকে ভেঙে ফেলতে হবে৷ আর তাদের ভাবধারায় চলা সিপিএম সহ অন্য বামপন্থি দলগুলি সেই পথ থেকে সরে এসে আরেকটি যুগান্তকারি ও বৈপ্লবিক তত্ত্ব আবিষ্কার করে ফেলেছিল৷ সিস্টেমকে দখল করে নিয়ে কীভাবে তা দলের অনুগামীদের দিয়ে দলের স্বার্থে চালানো যায়৷ পশ্চিমবঙ্গে তাদের দীর্ঘ ৩৪ বছরের শাসনে বামেরা শিক্ষার সিস্টেমকে ঠিক শাসন করেছে৷ আর তৃণমূলনেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রায় প্রতি পদে বামেদের অনুসরণ করেন এবং তাদের ছাপিয়ে যাওয়ার চেষ্ট করেন৷ এক্ষেত্রেও তাই করেছেন৷ তিনি এক্ষেত্রে বামেদেরও ছাপিয়ে গেছেন৷ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ও কলেজের অধ্যক্ষ নিয়েগের সময় তো বটেই, শিক্ষক, অধ্যাপক নিয়োগের সময়ও নাকি আগে বিবেচনা করা হয়, তিনি কোন রঙের? নীল, লাল, গেরুয়া নাকি অন্য রঙের?
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা পরে হবে, আগে বাম আমলের দিকে একবার ফিরে তাকানো যাক৷ আটের দশকের কথা৷ জ্যোতি বসু সরকারের আপত্তি অগ্রাহ্য করে সন্তোষ ভট্টাচার্যকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেছিলেন রাজ্যপাল৷ সন্তোষ ভট্টাচার্য যেদিন দায়িত্বভার নিতে যাচ্ছেন, সেদিন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বারভাঙ্গা বিল্ডিংয়ের সিঁড়ি থেকে দোতলায় উপাচার্যের অফিস পর্যন্ত সিপিএমের কর্মচারী সমিতির নেতা-কর্মীরা দাঁড়িয়ে ছিলেন৷ চমৎকার অভ্যর্থনা জানানোর জন্য৷ সন্তোষ ভট্টাচার্য ঢুকছেন এবং স্লোগান চলছে, ‘সন্তোষ ভট্টাচার্য মুর্দাবাদ’, ‘সন্তোষ ভট্টাচার্য নিপাত যাক’, ‘গো ব্যাক সন্তোষ ভট্টাচার্য’৷ সেই সময়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকার সময় দেখেছি, বোধহয় এমন একটা দিন ছিল না, যখন সন্তোষ ভট্টাচার্যের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দেখানো হয়নি৷ তার অপরাধ কি ছিল? তিনি সরকার বা দলের পছন্দের মানুষ নন৷ অথচ, সন্তোষ ভট্টাচার্যও বামপন্থি, কিন্তু সিপিএমের সঙ্গে তখন কিছু বিষয়ে তার মতের অমিল হয়েছে৷ তাই তিনি হয়ে গেলেন শত্রুপক্ষ৷
একটা ছোট ঘটনার কথা জানিয়ে সন্তোষ-পর্ব শেষ করব৷ কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের চার দশক ধরে অধ্যাপনা করা সুশীল চৌধুরী আনন্দবাজারে ২০১৪ সালে একটি চিঠি লিখেছিলেন৷ সেখানেই তিনি এই কাহিনি শুনিয়েছেন৷ সন্তোষ ভট্টাচার্যের কাছে গেছেন৷ এমন সময় কর্মচারী সমিতির ২৫-৩০ জন সদস্য ঘরে ঢুকে বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করলেন৷ একজন বিড়ির টুকরো ছুঁড়ে দিলেন তার দিকে৷ আধঘন্টা ধরে স্লোগান-সহ বিক্ষোভ চলল৷ পুরো সময়টা মাথা নীচু করে বসেছিলেন উপাচার্য৷ শুধু বলেছিলেন, রোজকার ব্যাপার৷ এই অপমান সহ্য করেও শিরদাঁড়া সোজা রেখে তিনি কার্যকাল পূরণ করেছেন৷ প্রবল প্রতাপশালী সরকার ও সিপিএমের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন৷ আর ছাত্রছাত্রীদের, সাধারণ মানুষের অঢেল ভালোবাসা পেয়েছেন৷ দেখিয়ে দিয়েছেন, শাসকের শক্তি উপেক্ষা করে কী করে সৎ থেকে লড়াই করা যায়৷
কিন্তু সন্তোষ ভট্টাচার্যরা হলেন ব্যতিক্রম৷ বাম আমলে একটা কথা চালু ছিল, শিক্ষার অনিলায়ন৷ অনিল বিশ্বাস তখন রাজ্য সিপিএমের সম্পাদক৷ তিনিই নাকি সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতেন৷ কে উপাচার্য হবেন, কে অধ্যক্ষ হবেন, কার কোথায় বদলি হবে, সব৷ বলা হয়, সিপিএমের একটা সুন্দর সিস্টেম ছিল৷ সিপিএমের ক্যাডাররা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় ভালো ফল করতেন৷ তারপর তারা দ্রুত অধ্যাপনার চাকরি পেয়ে যেতেন৷ কেউ বা শিক্ষকের চাকরি৷ তখন কলেজ সার্ভিস কমিশনে নিয়মিত নিয়োগ হতো৷ তাতে যোগ্য প্রার্থীরা চাকরি পেতেন, সেই সঙ্গে দলের পছন্দের মানুষরাও৷ কিন্তু উপাচার্য হতে গেলে বামপন্থি হতে হবে৷ এটা ছিল সাধারণ নিয়ম৷ তার কিছু ব্যতিক্রম থাকতেই পারে৷ এভাবেই সিস্টেমটাকে নিজেদের মতো করে নিয়েছিলেন সিপিএম নেতারা৷ না হলে ৩৪ বছর ক্ষমতায় থাকা যাবে কী করে, দলের মানুষদের চাকরি দেয়ার কাজটাই বা হবে কী করে? দলতন্ত্র না চললে তো সর্বনাশ! পশ্চিমবঙ্গে শিল্পের বারোটা ততদিনে বেজে গেছে৷ ফলে শিল্পক্ষেত্রে চাকরি নেই৷ পরিষেবা ক্ষেত্র এখনকার দিনের মতো ছিল না৷ ফলে ভদ্র চাকরি, যেখানে দেদার ফাঁকিবাজি করেও চাকরি বজায় রাখা যায়, সেই শিক্ষকতার চাকরিই আদর্শ৷ ফলে নিজেদের সিস্টেম তৈরি করো৷ আর এইভাবে যে উপচার্য, অধ্যক্ষদের নিয়োগ করা হলো, তারা যে দলের কথা শুনবেন, তা বলার অপেক্ষা রাখে না৷ তখন নিয়োগ করা উপাচার্যের মধ্যে পবিত্র সরকারের মতো পণ্ডিত ও শ্রদ্ধেয় মানুষরা যেমন ছিলেন, তেমন প্রচুর বেনোজলও ছিল৷
সেই সময়ের আরেকটা কাহিনি বলে বর্তমান সময়ে আসব৷ আমার এক বন্ধু অধ্যাপনার জন্য ইন্টারভিউতে প্রথমবার আটকে গিয়েছিল৷ তাকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, বক্রেশ্বর নিয়ে মত কি? তখন সিপিএমের স্লোগান ছিল রক্ত দিয়ে বক্রেশ্বর গড়ব৷ আমার স্পষ্টভাষী বন্ধু বলে দিয়েছিলেন, এটা গিমিক হতে পারে, এভাবে উন্নয়ন হয় না৷ সে বছর তিনি আর চাকরি পাননি৷ পরের বছর অবশ্য পেয়েছিলেন৷ তার অভিজ্ঞতা বলছে, সেই পরিস্থিতি আরো খারাপ হয়েছে৷
এরপর এল তৃণমূলের শাসন৷ রংটা রাতারাতি লাল থেকে বদলে নীল হয়ে গেল৷ রাস্তাঘাট, শহিদ মিনারের চূড়া থেকে শুরু করে সর্বত্রই নীল রং৷ শিক্ষাক্ষেত্রও বা বাদ যায় কেন! সবার রঙে রং মেলাতে হবে যে৷
মমতার আমলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হয়েছিলেন সুগত মারজিত৷ তিনি সোজাসাপটা সত্যি কথাটা বলে দিলেন, ''অপছন্দের লোক হলে সরকার আমায় নিয়োগ করতেন না৷ রাজ্যপাল আর সরকারই তো অস্থায়ী উপাচার্য হিসেবে আমার মেয়াদ বাড়িয়েছেন৷ তাদের পছন্দের লোক না-হলে কি এটা হতো?’’
এই পছন্দের মানুষকে উপাচার্য করার প্রথার শিকড় আরো গভীরে চলে গিয়েছে৷ উপাচার্য়রা শাসক গোষ্ঠীকে সমর্থন করেছেন এমন উদাহরণও এসেছে৷ ২০২০-র ঘটনা৷ রাজ্যপাল জগদীপ ধনখড় উপাচার্যদের বৈঠক ডাকলেন৷ ভার্চুয়াল বৈঠক৷ রাজ্যপাল বিশ্ববিদ্যালয়গুলির আচার্য৷ কিন্তু একজন উপাচার্যও সেই বৈঠকে এলেন না৷ কারণ, তখন রাজ্য সরকার বনাম রাজ্যপাল বিরোধ তুঙ্গে৷ ফলে উপাচার্যরা আর কী করবেন? তারা তো রাজ্য সরকারকে চটাতে পারেন না৷ রাজ্য সরকার তো বলেই দিয়েছিল, আচার্যের এই বৈঠক ডাকার অধিকার নেই৷ জগদীপ ধনখড় নানা বিতর্কিত কাজ করেছেন, কিন্তু তিনি রাজ্যপাল৷ আর সেই হিসাবে আচার্য৷ আচার্যর বৈঠক উপাচার্যরা বয়কট করবেন?
রবীন্দ্রনাথের বিশ্বভারতীর উপাচার্য নিয়োগ করে কেন্দ্রীয় সরকার৷ সেখানে আবার উল্টো গল্প৷ সেখানে রবীন্দ্র ভাবধারা, তার চিন্তাচেতনায় থাকা ব্যক্তিত্বরা নন, অগ্রাধিকার পাচ্ছে অন্য মাপদণ্ড৷ তাই বিশ্বভারতীর বর্তমান উপাচার্যকে নিয়ে প্রতিদিন বিতর্ক৷ প্রতিদিন সেখানে বিরোধ, অশান্তি৷
শেষ করার আগে আরেকটা কাহিনি বলা জরুরি৷ এটাও শুনিয়েছেন অধ্যাপক সুশীল চৌধুরী৷ সাতের দশকের কথা৷ তখন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সত্যেন্দ্রনাথ সেন৷ তাকে মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থশঙ্কর রায় ডেকে পাঠিয়ে বলেছিলেন, আপনি উপাচার্য, আর এই বিষয়টা বলতে পারছেন না৷ সত্যেন্দ্রনাথ কথাটা কংগ্রেসের কিছু নেতাকে বলেন৷ সেটা পৌঁছে যায় ইন্দিরা গান্ধীর কাছে৷ সেই ইন্দিরা গান্ধী, যিনি ভারতে জরুরি অবস্থা জারি করেছিলেন৷ তিনি দিল্লিতে সিদ্ধার্থশঙ্কর রায়কে বলন, ''কলকাতা ফিরেই তুমি প্রথমে সত্যেন্দ্রনাথ সেনের কাছে ক্ষমাপ্রার্থনা করবে৷'' ভুলে যেও না, তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য৷ সিদ্ধার্থশঙ্কর সেই নির্দেশ মেনে ক্ষমা চেয়েছিলেন উপাচার্যের কাছে৷
জরুরি অবস্থার ভয়ংকর দিনগুলি এখন অতীত৷ বর্তমান হলো, শিক্ষাক্ষেত্রে দলতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা৷ সিস্টেমের মধ্যে ঢুকে তাকে দলের কাজে যে এভাবে ব্যবহার করা যায়, তা এভাবে দেখতে না পেলে বোধহয় বিশ্বাসই করা কঠিন হতো৷