রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধ
২৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭সোমবার এইচআরডাব্লিউ'র ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনে রাখাইনে মানবতাবিরোধী অপরাধের ৪টি ক্ষেত্র শনাক্ত করা হয়েছে৷ ১. কোনো জনগোষ্ঠীকে স্থানান্তরিত ও বাস্তুচ্যুত হতে বাধ্য করা ২. হত্যা ৩. ধর্ষণ ও অন্যান্য যৌন সন্ত্রাস এবং ৪. আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) রোম বিধিমালার বিবেচনায় নিপীড়নমূলক কর্মকাণ্ড৷
তারা বলছে, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের ওপর বিস্তৃত ও কাঠামোবদ্ধ হামলা চালিয়েছে৷ আগে স্যাটেলাইটে ধারণকৃত ছবিতে দেখা গেছে, জ্বালাও পোড়াওয়ের আলামত রাখাইন রাজ্যের ১০০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত৷ ২০১৬ সালের অক্টোবর থেকে নভেম্বরে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর জ্বালাও পোড়াওয়ের তৎপরতা নির্দিষ্ট এলাকা থেকে ২০ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল৷
২৫ আগস্ট থেকে রাখাইনেরোহিঙ্গাদের ওপর মিয়ানমার সেনাবাহিনী যে নিপীড়ন চালিয়েছে তাতে সবগুলো অপরাধেরই আলামত বা প্রমাণ পাওয়ার কথা বলেছে এইচআরডাব্লিউ৷ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এর আগে ২০১২ এবং ২০১৬ সালে উগ্র বৌদ্ধ ভিক্ষু এবং রাখাইনের বিভিন্ন জাতিগত গোষ্ঠীর অন্তর্ভূক্তরা রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা বাহিনীর সহায়তায় যে হত্যাকাণ্ড চালিয়েছিল, তখনও মানবতাবিরোধী অপরাধ সংঘটনের জন্য মিয়ানমার সরকারকে দায়ী মনে করে এইচআরডাব্লিউ৷
প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, মিয়ানমারের সেনাবাহিনী রোহিঙ্গাদের হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের মাধ্যমেও বাস্তুচ্যূত হতে বাধ্য করেছে৷ আইসিসি এসব অপরাধকে মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবেই বিবেচনা করে৷
আইসিসির রোম বিধি'র সংজ্ঞা অনুযায়ী, মানবতাবিরোধী অপরাধ হলো এমন এক উদ্দেশ্যমূলক কর্মকাণ্ড, যা বেসামরিক জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বিস্তৃত ও কাঠামোবদ্ধ হামলার মধ্য দিয়ে সংঘটিত হয়৷ এ ধরনের হামলা অবশ্যই রাষ্ট্রীয় অথবা সাংগঠনিক নীতির অংশ হতে হবে৷ আন্তর্জাতিক বিচারব্যবস্থা অনুযায়ী, এ ধরণের হামলা বিস্তৃত অথবা কাঠামোবদ্ধ৷ বিস্তৃত হামলার মানে হলো,‘অপরাধের মাত্রা কিংবা ঘটনার শিকার মানুষের সংখ্যা' এবং কাঠামোবদ্ধ হামলার মানে হলো পদ্ধতিগত পরিকল্পনা করে হামলা৷
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক মানবতাবিষয়ক আইনে বলা আছে মানবতাবিরোধী অপরাধ যে কেবল সামরিক হামলার ক্ষেত্রে হবে, তা নয়৷ মানবতাবিরোধী অপরাধ সশস্ত্র সংঘাতমুলক প্রেক্ষাপটের মধ্যে কিংবা এর বাইরেও হতে পারে৷ আর মানবতাবিরোধী অপরাধ মানে যে কেবল একটি এলাকার গোটা জনগোষ্ঠীর ওপর হামলা পরিচালনা করা, তা নয়৷
এর আগে চলতি মাসের তৃতীয় সপ্তাহে টেলিভিশনে প্রচারিত জাতির উদ্দেশে দেওয়াঅং সান সু চি'র ভাষণের প্রতিক্রিয়ায় এইচআরডব্লিউ স্পষ্ট বিবৃতিতে জানায়, ওই ভাষণের মধ্য দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে হারানো গ্রহণযোগ্যতা ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা নিয়েছেন সু চি৷ তবে বক্তব্যে সু চি দেশের রোহিঙ্গাবিরোধী জনতা এবং সেনাবাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ এড়িয়ে গেছেন৷ মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর ওপর অবরোধ ও অস্ত্র নিষেধাজ্ঞা আরোপে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানায় মানবাধিকার সংস্থাটি৷
মিয়ানমারের নিরাপত্তা বাহিনী বাংলাদেশ সংলগ্ন সীমান্তে স্থল মাইন পুঁতে রাখছে বলে প্রমাণও হাজির করে এইচআরডব্লিউ৷ প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ, স্বাধীন সংবাদকর্মীর প্রতিবেদন আর এ সংক্রান্ত বিভিন্ন আলোকচিত্রের তথ্য বিশ্লেষণ করে তারা জানায়, ‘‘গত কয়েক সপ্তাহেও অ্যান্টি-পার্সোনেল মাইন ব্যবহারের প্রমাণ মিলেছে৷ এই মাইনের ব্যবহার আন্তর্জাতিকভাবে নিষিদ্ধ৷ মিয়ানমারকে অবিলম্বে ওই নিষিদ্ধ অস্ত্রের ব্যবহার বন্ধ করে ১৯৯৭ সালের মাইন নিষিদ্ধকরণ চুক্তিতে সই করার আহ্বান জানিয়েছে এইচআরডাব্লিউ৷''
এদিকে বাংলাদেশের মানবাধিকারকর্মী এবং আইন ও সালিশ কেন্দ্রের সাবেক নির্বাহী পরিচালক নূর খান কয়েক সপ্তাহ ধরে কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির এলকায় অবস্থান করছেন৷ তিনি এবং তাঁর সহকর্মীরা নির্যাতনের মুখে রাখাইন থেকে পালিয়ে আসারোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলছেন৷বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে ঘুরে ঘুরে তাঁদের বক্তব্য রেকর্ড করছেন৷ নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘রাখাইনে আসলে গণহত্যা চলছে৷ সেখানকার অবস্থা মানবাধিকার সংস্থার প্রতিবেদনে যা বলা হচ্ছে তার চেয়েও ভয়াবহ৷''
তিনি বলেন, ‘‘এখানে যাঁরা এসেছেন, নির্যাতনের ভয়াবহতায় তাঁদের একটি অংশ এখন ট্রমাটাইজড৷ গত দুই দিনে সমাজসেবা অধিদপ্তরের কর্মীরা এক হাজার দু'শ রোহিঙ্গা শিশুকে তালিভুক্ত করেছে যারা তাদের বাবা-মা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে৷ ধারণা করা যায় তাদের বাবা-মা হত্যার শিকার হয়েছেন বা নিখোঁজ আছেন৷ একসপ্তাহ তালিকাভূক্তির কাজ চললে চিত্রটি কী হবে তা ভাবতেই গা শিউরে উঠছে৷''
তিনি আরো বলেন, ‘‘মিয়ানমারের এই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য আন্তর্জাতিক আদালতে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট সাক্ষ্য-প্রমাণ আছে৷''