'রাত দখলের' মধ্যে তাণ্ডবে কি তদন্তের কাজ ব্যাহত হবে?
১৫ আগস্ট ২০২৪আরজি কর হাসপাতালে তরুণী চিকিৎসকের ধর্ষণ ও খুনের প্রতিবাদে একটানা বিক্ষোভ চলছে। স্বাধীনতা দিবসের মধ্যরাতে 'রাত দখলের' কর্মসূচিতে সাধারণ মানুষ প্রতিবাদে সমিল হয়েছিলেন। এরই মধ্যে হাসপাতালে হামলা চালায় গুন্ডাবাহিনী।
পূর্বপরিকল্পিত আক্রমণ?
বিক্ষোভকারীদের জমায়েতের কিছুটা দূরে জড়ো হয়েছিল বিক্ষোভকারীরা। তাদের হাতে ছিল বাঁশ, লাঠি, ছোরা। বুধবার মধ্যরাতে তখন গুটিকয়েক পুলিশ হাসপাতালে সামনে। লাঠিধারী এই পুলিশ গুন্ডাদের আক্রমণের মুখে দিশাহারা হয়ে পড়ে।
হাসপাতালে ঢুকে জরুরি বিভাগে ব্যাপক ভাঙচুর চালায় দুষ্কৃতীরা। তাদের কয়েকজনের পরনে ছিল স্যান্ডো গেঞ্জি, হাফপ্যান্ট। ১৮টি বিভাগে ৪০ মিনিট ধরে তাণ্ডব চালায় তারা।
তরুণী চিকিৎসককে যে সেমিনার রুমে ধর্ষণ ও খুন করা হয়, সেটি জরুরি বিভাগের চারতলায়। তদন্তে গিয়ে সিবিআই আধিকারিকরা সেই ঘর সিল করে দিয়েছেন। সূত্রের খবর, সিল ভাঙার চেষ্টা করে দুষ্কৃতীরা। কিন্তু সেই ঘরে তারা ঢুকতে পারেনি বলে কলকাতা পুলিশের দাবি।
সূত্রের খবর, হামলাকারীদের কয়েকজনকে হিন্দি ভাষায় কথা বলতে শোনা গিয়েছে। গুন্ডারা একটা কথা বারবার বলছিল, পাকড়ো মারো জ্বলা দো। বাংলায় ধরো, মারো জ্বালিয়ে দাও। এই বাহিনী কেন হামলা চালালো? হাসপাতালে প্রমাণ লোপাট কি তাদের উদ্দেশ্য ছিল, এই প্রশ্ন উঠেছে।
কেন এই আক্রমণ?
রাতের ঘটনার প্রতিবাদে নার্সিং কর্মীরা বিক্ষোভ দেখাতে শুরু করেন। তাদের বক্তব্য, এত বড় সংখ্যায় দুষ্কৃতীরা লাঠিসোটা নিয়ে হামলা করল, তারা সেমিনার রুমের সিল ভাঙার চেষ্টা চালাল, এটা পূর্ব পরিকল্পিত নয়তো কি? অপরাধীদের যাতে ধরা না যায় সে কারণে আক্রমণ করা হয়েছে।
নার্সেস ইউনিটির সম্পাদক ভাস্বতী মুখোপাধ্যায় বলেন, "কাজের জায়গায় ভয়ের পরিবেশ তৈরি হয়েছে। এই পরিবেশে নার্সিং স্টাফরা কাজ করতে চাইছে না। আগে তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে। নইলে রোগীর দেখাশোনা করার কেউ থাকবে না।"
আন্দোলনকে ভেস্তে দেয়ার জন্য এই আক্রমণ বলে অনেকে মনে করছেন। সাবেক বাম সাংসদ ডা. তরুণ মণ্ডল ডয়চে ভেলেকে বলেন, "এটা পরিকল্পনা মাফিক ঘটানো হয়েছে। প্রমাণ লোপাট করা এবং আন্দোলনের ভরকেন্দ্রে থাকা জুনিয়র ডাক্তারদের প্রতিবাদের মঞ্চটাকে গুঁড়িয়ে দেয়া এদের লক্ষ্য ছিল। কিন্তু এতে আন্দোলন আরো শক্তিশালী হয়েছে।"
পুলিশের ভূমিকায় প্রশ্ন
পুলিশের বড় বাহিনী যখন হাসপাতালে আসে, তাদের লক্ষ্য করে ইট ছোড়া হয়। এলাকা ছেড়ে চম্পট দেয় দুষ্কৃতীরা। কাউকে সেই সময় পাকড়াও করতে পারেনি পুলিশ।
বৃহস্পতিবার সকালে সমাজমাধ্যমে পুলিশ কয়েকটি ছবি পোস্ট করে। লাল বৃত্তে হামলাকারীদের চিহ্নিত করা হয়। এদের সম্পর্কে তথ্য দিতে আহ্বান করা হয় জনতাকে। তাণ্ডবের অভিযোগে নয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সেই সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত নার্সদের দাবি, রাত দখলের কর্মসূচি থাকলেও পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ছিল না হাসপাতাল চত্বরে। পুলিশ ভয়ে বাথরুম, লিফট, স্ত্রী রোগ বিভাগে আশ্রয় নেয়। এক নার্সের বয়ান অনুযায়ী, "হামলার সময় পুলিশই আমাদের কাছে আশ্রয় চেয়েছিল। আমাদের বাঁচানোর বদলে তারা হাসপাতালের ভিতর লুকিয়ে পড়ে। এমনকী রোগীর কম্বলের ভিতরে আশ্রয় নেয়ার চেষ্টা করে।"
অথচ গত মঙ্গলবার বিকেলে পুলিশ ব্যারিকেড করে রুখে দেয় বিক্ষোভকারীদের। বাম কর্মীদের পাশাপাশি অন্য হাসপাতালের প্রতিনিধিরাও ভিতরে ঢুকতে পারেননি। কয়েকজনকে চুলের মুঠি ধরে, মারতে মারতে বার করে দেয় পুলিশ। সেই বাহিনী গুন্ডাদের হামলার সামনে এমন অসহায় হয়ে পড়ল কেন, এই প্রশ্ন উঠেছে।
চিকিৎসক খুনের পর থেকেই সন্দেহের চোখে দেখা হচ্ছে পুলিশের ভূমিকাকে। অস্বাভাবিক মৃত্যু, আত্মহত্যা বলে এই হত্যাকে চিহ্নিত করতে চেয়েছিল তারা, এই অভিযোগ উঠেছে। কলকাতা হাইকোর্ট পুলিশের ভূমিকায় অসন্তোষ প্রকাশ করে সিবিআইয়ের হাতে তদন্তভার দেয়।
আরো প্রতিবাদ
প্রতিবাদের মধ্যে হামলার ঘটনায় আরজি করের পরিস্থিতি আরো জটিল। শুক্রবার ১২ ঘন্টার সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়েছে এসইউসিআই। দুপুর দুটো থেকে চারটে পথ অবরোধ করবে বিজেপি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বাড়ি পর্যন্ত মোমবাতি মিছিল করবে বিজেপির মহিলা মোর্চা।
রাজ্যের মন্ত্রী ফিরহাদ হাকিম বলেন, "হাসপাতালের অধ্যক্ষ কোনও অন্যায় করলে তার বিচার হবে। সিবিআই দ্রুত তদন্ত করুক। এর সঙ্গে প্রশাসনকে জুড়ে দেয়া হচ্ছে।"
বাম ও বিজেপি মুখ্যমন্ত্রীর পদত্যাগ চেয়েছে। বিজেপি রাজ্য সভাপতি সুকান্ত মজুমদার বলেন, "যারা হামলা চালিয়ে প্রমাণ লোপাট করতে চেয়েছে, তাদের পিছনের মাথাদের ধরতে হবে। এই সার্বিক ব্যর্থতার দায় মুখ্যমন্ত্রীর।"
বৃহস্পতিবার পথে নামছেন মুখ্যমন্ত্রীও। রবিবারের মধ্যে অপরাধীর ফাঁসির দাবিতে তিনি পদযাত্রা করবেন। রাজ্যপাল সিভি আনন্দ বোস বৃহস্পতিবার আরজি কর হাসপাতালে যান। আন্দোলনকারীদের পাশে থাকার আশ্বাস দেন।
সিবিআই তদন্ত
তদন্তে তৎপরতা বাড়িয়েছে সিবিআই। এদিন তারা নিহত চিকিৎসকের বাড়িতে গিয়ে তার পরিবারের সঙ্গে কথা বলে। দিল্লি এইমসের কয়েকজন চিকিৎসক ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞ তদন্তকারীদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।
সূত্র জানাচ্ছে, ঘটনার পিছনে কি শুধু সিভিক ভলান্টিয়ার ছিল, নাকি আরো কেউ জড়িত, সেই বিষয়টি সিবিআই তদন্ত করে দেখছে। অভিযুক্তর কল রেকর্ড ও মেসেজ খতিয়ে দেখা হচ্ছে। তার ফোনের লোকেশনও দেখা হচ্ছে। তবে সিবিআই তদন্তে কী উঠে আসে, তার দিকে চেয়ে আছে গোটা পশ্চিমবঙ্গ।