1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

যোগী আদিত্যনাথ কি ইতিহাস পড়েননি?

স্যমন্তক ঘোষ নতুন দিল্লি
১৫ সেপ্টেম্বর ২০২০

নাম বদলে, ইতিহাসের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে ঐতিহাসিক দলিল মুছে ফেলা যায় না। যোগী আদিত্যনাথের কাছে এটুকুই বলার।

https://p.dw.com/p/3iTsy
ছবি: Reuters/P. Kumar

ইতিহাস চর্চার নানা অভিমুখ থাকে। সে জন্যই ইতিহাসের বিভিন্ন পর্ব নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ তৈরি হয়। বিতর্ক হয়। সুস্থ বিতর্ক। বামপন্থী ঐতিহাসিকের কাছে কোনও ঐতিহাসিক ঘটনার যে ব্যাখ্যা, জাতীয়বাদী ঐতিহাসিকের কাছে তার ভিন্ন অর্থ থাকতেই পারে। কিন্তু গোটা বিতর্কই দাঁড়িয়ে থাকে একটি বা একাধিক সত্যের উপর। ইতিহাসের ভাষায় ওই সত্যকে বলা হয় ঐতিহাসিক দলিল। অর্থাৎ, তথ্য।

ঐতিহাসিক দলিল বা তথ্যকে উপেক্ষা করে যখন কেউ বা কারা ইতিহাস নিয়ে বুলি আওড়ান, তখন হয় তাঁদের 'বোধহীন' অথবা 'বিকৃতমনষ্ক' বলে দাবি করতে হয়। উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ বোধহীন নন। তিনি একজন রাজনীতিবিদ। অতীতে রাজনীতির ময়দানে তিনি বহু বিতর্কিত ঘটনা ঘটিয়েছেন। বহুবার বিতর্কের কেন্দ্রে উঠে এসেছেন। এবং সেই বিতর্ক সামলেও নিয়েছেন। তিনি জানেন, রাজনীতির ময়দানে কী ভাবে কোন দিকে বল বাড়িয়ে গোল করতে হয়।

তাঁর রাজনীতি, রাজনৈতিক বোধের সঙ্গে কারো দ্বিমত থাকতেই পারে। গণতান্ত্রিক পরিকাঠামোয় বিভিন্ন মতামত, বিভিন্ন কণ্ঠ থাকবে, সেই তো স্বাভাবিক। তিনি বা তাঁর দল ইতিহাস নিয়েও আলোচনা করতে পারেন। সেই মত অনেকের সঙ্গে না-ই মিলতে পারে। কিন্তু তাঁর ইতিহাসের ব্যাখ্যা যখন তথ্যবিকৃত হয়ে যায়, তখন তাঁকে প্রশ্ন করার, কাঠগড়ায় তোলার যথেষ্ট কারণ থাকে। আঙুল তুলে তাঁকে প্রশ্ন করতেই হয়, কেন এই মিথ্যার আশ্রয় নিচ্ছেন?

২০১৫ সাল থেকে উত্তরপ্রদেশের আগ্রায় তাজমহলের কাছেই তৈরি হচ্ছে মুঘল জাদুঘর। মুঘল আমলের যাপন নিয়ে তৈরি এই জাদুঘর নিঃসন্দেহে আগ্রার মতো পর্যটন কেন্দ্রে আলাদা মাত্রা যোগ করবে। ১৫২৬ থেকে ১৮৫৭ পর্যন্ত মুঘলরা ভারতীয় উপমহাদেশে শাসন করেছে। সবমিলিয়ে তিনশ বছরের মুঘল ইতিহাস (মাঝে হুমায়ুন কিছুদিন রাজ্যহারা ছিলেন) পরবর্তীকালের ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে মিশে গিয়েছে। ভাষা থেকে প্রশাসন, খাদ্যাভ্যাস থেকে পোশাক, সাহিত্য থেকে সংগীত-- ভারতীয় সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জুড়ে আছে মুঘল সময়। আগ্রার নতুন জাদুঘরে সেই সংস্কৃতিকেই ধরে রাখার কথা ভাবা হচ্ছে।

অখিলেশ যাদব মুখ্যমন্ত্রী থাকাকালীন ওই জাদুঘরের ছাড়পত্র দিয়েছিলেন। যোগী আদিত্যনাথ সেই জাদুঘরের নাম বদলে রাখলেন মারাঠা রাজ ছত্রপতি শিবাজীর নামে। যাঁর সঙ্গে উত্তর ভারতের মুঘল ইতিহাসের কোনও সংযোগ নেই। শুধু তাই নয়, যোগী আদিত্যনাথ মহাশয় একই সঙ্গে জানিয়ে দিলেন, যে ইতিহাসে দাসত্ব প্রতিফলিত হয়, নতুন উত্তরপ্রদেশে তার কোনও চিহ্ন থাকবে না। অর্থাৎ, মুঘলদের ইতিহাস, দাসত্বের ইতিহাস।

এখানেই ইতিহাসের ভুল তথ্য দেওয়া হলো। মুঘল আমলের সঙ্গে দাসত্বের কোনও সম্পর্ক নেই। বরং ভারতীয় উপমহাদেশের এগিয়ে যাওয়ার সম্পর্ক রয়েছে। মুঘল আমলে অন্যায় কি হয়নি? নিশ্চয় হয়েছে। সব আমলই ভালো খারাপ মিশিয়ে হয়। সম্রাট আকবর আর সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মুঘল যুগ একরকম ছিল না। কিন্তু সার্বিক ভাবে যখন ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করতে হবে তখন মুঘল আমলকে অস্বীকার করার উপায় নেই। তাকে অন্ধকার বা দাসত্বের আমল বলে চালিয়ে দেওয়ারও সুযোগ নেই।

বলতে দ্বিধা নেই, যোগী আদিত্যনাথ মহাশয়ের ইতিহাসের যথেষ্ট জ্ঞান নেই। তা নিয়ে তিনি যে আজগুবি কথা বলছেন, তার পিছনে আবার একটি মস্ত চক্রান্ত রয়েছে। গৈরিক ঐতিহাসিকরা ভারতীয় ইতিহাস চর্চায় নতুন ব্যাখ্যার আমদানির চেষ্টা চালাচ্ছেন। তথ্যের উপর দাঁড়িয়ে সেই বিতর্ক হলে তর্ক করতে অসুবিধা নেই। কোনও কোনও ক্ষেত্রে তা হচ্ছেও। কিন্তু যোগী যে ইতিহাস বলছেন, তা বিতর্কেরও অযোগ্য। ভাবতে অবাক লাগে, তাঁর পারিষদগণ, তাঁর আধিকারিকরা মুখ্যমন্ত্রীকে ভুল ধরিয়ে দিতে পারেন না। বা ভয় পান।

Syamantak Ghosh
স্যমন্তক ঘোষ, ডয়চে ভেলেছবি: privat

ছত্রপতি শিবাজীর নামে আলাদা জাদুঘর হতেই পারে, কিন্তু মুঘল জাদুঘর তাঁর নামে হলে তা যে হাস্যকর হবে, বিশ্বের সামনে ভারতকে হাসির কারণ করে তোলা হবে, তা বোঝার জন্য ইতিহাসের ছাত্রও হতে হয় না। সামান্য বোধ থাকলেই হয়। ওই যে বললাম, যোগী আদিত্যনাথ বোধহীন, এ কথা বলার কারণ নেই। প্রখর বোধের পরিচয় দিয়েই তিনি ভারতের সব চেয়ে বড় রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর চেয়ারে বসেছেন। তিনি আসলে ঐতিহাসিক তথ্যকে বিকৃত করে রাজনীতি করার চেষ্টা করছেন। হিটলারের মতো অনেক স্বৈরাচারী এটা করার চেষ্টা করেছেন। যোগীর রাজনীতিটা হচ্ছে হিন্দুত্বের রাজনীতি। তাই অতীতের অ-হিন্দু শাসন তাঁর কাছে দাসত্ব ছাড়া আর কিছু নয়। সে জন্যই হিন্দুত্ববাদীদের আইকন শিবাজির নামে জাদুঘরের নাম রাখা। সে জন্যই ইতিহাস বদলে দেয়ার চেষ্টা। এটা কট্টর মাসনিকতাকে তুষ্ট করবে, তাঁর প্রশাসনিক ব্যর্থতা থেকে নজর অন্যদিকে ঘোরাবে। হয়তো বা ভোট পেতেও ঢালাও সাহায্য করবে। তবে বলে রাখা ভালো, এক বা একাধিক ব্যক্তি শত চেষ্টা করলেও ইতিহাস বদলাবে না। ঐতিহাসিক দলিল আগুন দিয়েও পুড়িয়ে ফেলা যায়, কিন্তু সত্যকে আড়াল করা যায় না।

ভারতীয় ইতিহাসে একটি কথা বহুল প্রচলিত। রাজার ইতিহাস। এই যোগী আদিত্যনাথরাই বলেন, মুঘল রাজারা তাঁদের মতো করে ইতিহাস রচনা করিয়েছেন। তাই মুঘলদের অন্ধকার দিকটি অনেকের চোখে পড়ে না। যোগীরাও ঠিক সেই কাজটিই করার চেষ্টা করছেন। নিজেদের ক্ষমতা দেখিয়ে ইতিহাস নিজেদের মতো লিখিয়ে নিচ্ছেন। কিন্তু একশ বছর পর কোনও ঐতিহাসিক যখন এই সময়ের অন্ধকার দিকটি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেবেন, তখন কি তা খুব গৌরবের হবে? 

ডয়চে ভেলের দিল্লি প্রতিনিধি স্যমন্তক ঘোষ
স্যমন্তক ঘোষ ডয়চে ভেলে, দিল্লি ব্যুরো