মরক্কোর রূপকথা থামলো ফরাসি বিপ্লবে
১৪ ডিসেম্বর ২০২২২-০ গোলে মরক্কোকে হারিয়ে টানা দ্বিতীয় বারের মতো বিশ্বকাপের ফাইনালে পৌঁছে গেল ফ্রান্স, যেখানে তাদের অপেক্ষায় আর্জেন্টিনা।
টানেলে দেখা হতেই একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে হাসলেন দুই বন্ধু, কিলিয়ান এমবাপ্পে ও আশরাফ হাকিমি। বছরের বেশিরভাগ সময়েই দুজনের গায়ে থাকে একই রকম জার্সি, টানেলে দাঁড়ানও এক সারিতে। বুধবার রাতে এমবাপ্পের গায়ে ফ্রান্সের নীল, হাকিমির গায়ে মরক্কোর লাল। দুজনেই জানেন, ১৮ ডিসেম্বরের পর দুজনকেই ফিরতে হবে পিএসজির নীল আর লালে। তার আগে,আল বাইয়াত স্টেডিয়ামের কিক-অফ থেকে শেষ বাঁশি পর্যন্ত দুজনের লক্ষ্য আলাদা, বন্ধুত্ব আপাতত মাঠের বাইরে।
আল বাইত স্টেডিয়ামে খেলা শুরুর আগে অদ্ভুত এক দৃশ্য। মরক্কোর জাতীয় সংগীতে আবেগ দিয়ে গলা মেলাচ্ছেন মাদ্রিদে জন্ম নেয়া হাকিমি, ফ্রান্সে জন্ম নেয়া মরক্কোর কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই। তাদের সঙ্গে মাঠে থাকা মরক্কোর বিশাল সমর্থকগোষ্ঠী। আরব বিশ্ব, আফ্রিকা- সব জায়গার সমর্থন পাচ্ছে মরক্কো।
বিশ্বকাপে ফ্রান্সের বিপক্ষে সেমিফাইনালে খেলতে নামার আগে গোটা আসরে একটা মাত্র গোল হজম করেছিল মরক্কো, সেটাও ক্যানাডার কাছে আত্মঘাতী গোল। মরক্কোর রক্ষণ যেন এক দূর্ভেদ্য দূর্গ, সেই দূর্গের দরজা ভাংতে বিশ্বচ্যাম্পিয়নদের লেগেছে মাত্র ৫ মিনিট।
আন্তন গ্রিজমানের ক্রস থেকে এমবাপ্পের শট ফিরে আসে মরক্কোর রক্ষণ দেয়াল থেকে। এমন সময় বামদিক থেকে বক্সের ভেতরে ঢুকে যাওয়া থিও হার্নান্দেস চলতি বলে প্রায় কাঁধসমান পা তুলে যে ভলিটা করেছেন সেটাই ছিল এই বিশ্বকাপে মরক্কোর জালে প্রতিপক্ষের প্রথম গোল। কোনো বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে, খেলা শুরুর মিনিট পাঁচেকের ভেতর এর আগে গোল করেছিলেন ব্রাজিলের ভাভা। ১৯৫৮ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে, ফ্রান্সের বিপক্ষেই গোল করেছিলেন ব্রাজিলের এই স্ট্রাইকার৷ ২০২২ সালে এসে সেমিফাইনালে ফ্রান্সের থিও হার্নান্দেজ আবারও খেলা শুরুর পর দ্রুতই পেলেন গোলের দেখা।
দিদিয়ের দেশম কাতার বিশ্বকাপের জন্য প্রথমে যে ২৬ জন ফুটবলারকে ফ্রান্স দলে ডেকেছিলেন, তাদের ভেতর ছিল না রান্দাল কোলো মুয়ানির নামটা। ক্রিস্টোফার এনকুনকু চোট পেলেন, তার বদলে ডাকা হলো কোলো মুয়ানিকে। সেই কোলো মুয়ানিই বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে ফ্রান্সকে দিলেন স্বস্তি। ম্যাচের পঞ্চম মিনিটে থিও হার্নান্দেজের গোলে ফ্রান্স এগিয়ে গেলেও মরক্কো এক মুহূর্তের জন্য ছাড় দিচ্ছিল না। যে কোনো সময়েই হুগো লরিস হজম করতে পারতেন গোল, তাতে সমতায় ফিরে খেলাটা অতিরিক্ত সময়ে টেনে নিতে পারতো অ্যাটলাসের সিংহরা। কোলো মুয়ানির গোল অনেকটাই নেই করে দেয় সেই শঙ্কা। উসমান দেম্বেলের বদলি হিসেবে নেমেছিলেন, মাঠে নামার ৪৪ সেকেন্ডের ভেতরই গোল করে ফেললেন কোলো মুয়ানি। ডি-বক্সের ভেতর চারজনের কড়া পাহারার ভেতর দিয়ে গলে বেরিয়ে পাসটা বাড়িয়েছিলেন এমবাপ্পে, কোলো মুয়ানি আলতো করে পা বাড়িয়ে সহজতম গোলে খাতা খুলেছেন আন্তর্জাতিক ফুটবলে।
থিও হার্নান্দেজ আর কোলো মুয়ানির গোলেই ফরাসিরা জিতলো ২-০ গোলে, থামিয়ে দিলো মরোক্কান রূপকথা। রবিবার লুসাইল স্টেডিয়ামে বিশ্বকাপের ফাইনালে মুখোমুখি হবে আর্জেন্টিনা ও ফ্রান্স, লিওনেল মেসির সঙ্গে দেখা হবে এমবাপ্পের।
হেরে গেলেও মাথা উঁচু করেই বিদায় নিচ্ছে মরক্কো। মাঠে ফ্রান্সের চেয়ে অনেকাংশেই এগিয়ে ছিল তারা্, কিন্তু অভাব ছিল একজন উঁচু মানের ফরোয়ার্ডের। ফ্রান্সের শট অন টার্গেট মাত্র দুটো, দুটোতেই লা ব্লু রা পেয়েছে গোলের দেখা। অন্যদিকে মরক্কোরও শট অন টার্গেট দুই, কিন্তু তারা গোলের দেখা পায়নি ফরাসি রক্ষণে জুলস কুন্দে আর ইব্রাহিম কোনাতের দক্ষতায়। তবে সবকিছুর পর আসলে ভাগ্যও লাগে, যা সেমিফাইনালে এসে আর সঙ্গ দেয়নি মরক্কোকে। না হলে প্রথমার্ধ শেষের খানিক আগে,জাওয়াদ আল ইয়ামিকের ওভারহেড কিকটা পোস্টে লাগে উগো লরিকে ফাঁকি দেবার পরও! ৫১ শতাংশ বলের দখল ছিল মরক্কোর কাছে, ১৩ বার গোলের প্রচেষ্টা নিয়েছে আফ্রিকার দলটি,দুটো শট অন টার্গেটে আর ৫টা শট গেছে অফ টার্গেটে। অ্যাটাকিং থার্ডে বল নিয়ে বেশি ঢুকেছে মরক্কোই, ফ্রান্স বরং প্রতিআক্রমণে এমবাপ্পের গতি আর গ্রিজমানের জ্যামিতির মতো নিখুঁত পাসেই বেশি ভরসা করেছে।
মরক্কোর ইউসুফ এল নাসিরি একটা সুযোগ পেয়েছিলেন, সোজা গোলপোস্টে শট না নিয়ে কাটাতে গিয়ে আর পারলেন না। পরের মিনিটেই এমবাপ্পের দৌড়, জটলা ভেঙে ভেতরে ঢুকে বল নিয়ে বেরিয়ে গিয়ে পাস দেয়া আর কোলো মুয়ানির গোল। ৭৯ মিনিটে দ্বিতীয় গোলটাই শেষ করে দেয় মরোক্কানদের সব আশা।
তবুও হাল ছাড়েনি অ্যাটলাসের সিংহরা, লড়ে গেছে শেষ পর্যন্ত। কিন্তু বর্তমান বিশ্বচ্যাম্পিয়নরা যখন টানা দ্বিতীয়বারের মতো ফাইনালে খেলার খুব কাছে পৌঁছে যায়, তখন তাদের বিপক্ষে অঘটন ঘটাতে অতিমানবীয় কিছু প্রয়োজন। দূর্ভাগ্য মরক্কোর, দল হিসেবে অসাধারণ হলেও অসাধারণ মানের কেউ তাদের দলে নেই।
মেক্সিকান রেফারির লম্বা বাঁশিতে শেষ হলো সেমিফাইনাল। এখান থেকে এমবাপ্পের গন্তব্য রবিবারের লুসাইল স্টেডিয়াম, আর শনিবার আলরাইয়ানের খলিফা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামে যাবেন হাকিমি।