ভাস্কর্য: শিক্ষক ও পড়ুয়ারা যা বলছেন
ভাস্কর্য, না মূর্তি- এই বিতর্ক নিয়ে ডয়চে ভেলে কথা বলেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের কয়েকজন শিক্ষার্থী ও শিক্ষকের সঙ্গে৷
শিল্প এবং ধর্ম এখন সম্পূর্ণ পৃথক বিষয়
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের ভাস্কর্য বিভাগের চেয়ারম্যান ও সহকারী অধ্যাপক নাসিমা হক বলেন, শিল্পসাহিত্য বিকাশের এই যুগে ভাস্কর্য এবং মূর্তি নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই৷ ভাস্কর্য অথবা অন্যান্য যে-কোনো শিল্প নিছকই একটি আধ্যাত্মিক অনুভূতির মাধ্যম, যা একটি দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে ধারণ করে৷ শিল্পকে এখন আর ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার সুযোগ নেই৷
উদ্দেশ্যটাই মুখ্য
ভাস্কর্য বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক মুকুল কুমার বাড়ৈ বলেন, ‘‘সবই আসলে ভাস্কর্য৷ পার্থক্যের বিষয়টি চলে আসে সেটি কোন প্রয়োজনে ব্যবহার করা হচ্ছে, সেই উদ্দেশ্যের ভিত্তিতে৷ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে বাংলাদেশ ও মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস অবিচ্ছেদ্য, তিনি আমাদের দেশের জন্য আইকনিক একজন ব্যক্তিত্ব৷ সুতরাং তাঁর ভাস্কর্যকে ধর্মীয়ভাবে দেখার সুযোগ আদৌ আছে বলে আমি মনে করি না৷’’
এ বিতর্ক রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে
ভাস্কর্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক নাসিমুল খবির বলেন, ‘‘ভাস্কর্য বা মূর্তির বিষয়টি বহু আগে থেকেই সামাজিক, রাষ্ট্রীয় এমনকি ধর্মীয়ভাবে মীমাংসিত৷ এমনকি মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্রগুলোতেও ভাস্কর্য আছে৷ সুতরাং আমরা বুঝতেই পারছি বাংলাদেশে এখন যে ঘটনাটি ঘটছে, সেটি একধরণের রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং অহেতুক বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার পায়তারা ছাড়া কিছুই নয়৷’’
সংজ্ঞাগত পার্থক্য সামান্য
ভাস্কর্য বিভাগের স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষার্থী মৃৎমন্দির গুঞ্জন কুমার বলেন, ‘‘কে কীভাবে ভাস্কর্যটিকে উপস্থাপন করছে, সেটিই মুখ্য বিষয়৷ মূর্তি এবং ভাস্কর্যের মাঝে দ্বান্দ্বিক কোনো পার্থক্য নেই৷ অনেক ভাস্কর্য আছে যেটি মূর্তি নয়৷ আসলে মূর্তি যখন অনুভূতি বা নান্দনিকতার জন্য তৈরি হয় তখন তা ভাস্কর্য হয়ে ওঠে৷’’
শব্দ দুটির প্রেক্ষাপট ভিন্ন
তৃতীয় বর্ষে পড়ছেন লামিয়া নোশিন নকশি৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি বলেন, ‘‘চারুকলার একজন ছাত্রী হিসেবে আমার মাথায় প্রথমেই যা আসে সেটা হচ্ছে শব্দ দুটির প্রেক্ষাপট এবং অর্থের ভিন্নতা৷ ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে কিছু ক্ষেত্রে মূর্তি নির্মিত হয়ে থাকলেও ভাস্কর্যের ব্যাপারটি পুরোপুরি শৈল্পিক৷’’
ভাস্কর্যে নান্দনিকতা থাকে
তৃতীয় বর্ষের আরেক শিক্ষার্থী সৌম্যক সাহা ধ্রুব বলেন, ‘‘মূর্তি এমন এক ত্রিমাত্রিক গঠন, যা কোনো কিছুকে মূর্ত করে, এটি বিমূর্ত নয়৷ পাশাপাশি মূর্তি যখন উপাসনার উদ্দেশ্যে তৈরি করা হয়, তখন তাঁকে প্রতিমা বলা হয়৷ মূর্তি বা প্রতিমা ভাস্কর্যেরই প্রকারভেদ৷ ভাস্কর্যে মূলত নান্দনিকতাটাই প্রাধান্য পায়৷’’
ভাস্কর্য ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে লালন করে
ভাস্কর্য বিভাগের শেষ বর্ষের শিক্ষার্থী পল্লব সমাদ্দার বলেন, ‘‘প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে মানুষ বিভিন্ন প্রয়োজন ও বিশ্বাসের উপর ভিত্তি করে ভাস্কর্য তৈরি করে আসছে৷ ভাস্কর্য এবং মূর্তির মাঝে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও আমার মনে হয় দুটি বিষয় শেষ পর্যন্ত একই সুতোয় গাঁথা৷’’
যাহা পানি, তাহাই জল
চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের প্রাক্তন ছাত্রী তাহসিনা ফেরদৌস রিনিয়ার মতে, কিছু বিখ্যাত শিল্পকর্মের ক্ষেত্রে ভাস্কর্য নাকি মূর্তি এ নিয়ে কিঞ্চিৎ দ্বন্দ্ব থাকলেও এই ধারণার ভিত্তি বা গোড়া কিন্তু একই৷ তিনি ভাস্কর্য এবং মূর্তির পার্থক্যের কথা এভাবে ব্যাখ্যা করেন, ‘‘সকল মূর্তিই ভাস্কর্য, কিন্তু সকল ভাস্কর্য মূর্তি না৷’’
অমিল আছে, কিন্তু দ্বন্দ্বপূর্ণ নয়
চারুকলার দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী নাবিলা তাবাসসুম বলেন, ‘‘মূর্তি অবধারিতভাবে মানুষ বা প্রাণীর আকৃতি হলেও ভাস্কর্যে প্রাণী বা কাল্পনিক ধারণা ফুটে উঠতে পারে৷ ভাস্কর্য দৃশ্যমান শিল্পের একটি শাখা, যা তৈরি করার পদ্ধতি মূর্তি থেকে ভিন্ন৷ ভাস্কর্যে শিল্পের নান্দনিকতার ছোঁয়া থাকবে এবং এর আকার যে-কোনো প্রকারের হতে পারে৷’’