হিন্দুরা পাকিস্তানে ফেরত যেতে চাইছেন!
২৬ জুলাই ২০১৮কেউ বলছেন, জোর করে ধর্ম পরিবর্তন করানোর ভয়ে তাঁরা পাকিস্তান ছেড়েছেন৷ কারও দাবি, মহিলাদের ওপর ক্রমশ অত্যাচার বাড়ছিল বলেই দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন তাঁরা৷
ভারতের পশ্চিমের রাজ্য গুজরাট ও রাজস্থানে পাকিস্তান থেকে চলে আসা হিন্দুদের সংখ্যাটা নেহাৎ কম নয়৷ তবে সরকারি কোনো তথ্য নেই৷ যতদূর জানা গেছে, গত তিন বছরে পাকিস্তান থেকে এই দুই রাজ্যে এসে বসবাস করছেন পাকিস্তানের প্রায় ২,০০০ হিন্দু নাগরিক৷ তাঁদেরই দাবি, বহু হিন্দুকে জোর করে মুসলিম ধর্ম গ্রহণ করতে বাধ্য করা হচ্ছে৷
পাকিস্তানে আশেপাশের দেশ থেকে বহু মানুষ যাচ্ছেন৷ ফলে সরকারের ওপর চাপ বাড়ছে৷ আফগানিস্তানের মতো দেশ থেকে যাঁরা আসছেন, তাঁরা প্রায় সবাই মুসলিম৷ ক্রমশ সেদেশে এমন এক পরিস্থিতি তৈরি হচ্ছে, যাতে নাকি হিন্দুদের অসুবিধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে৷ তার ফলে তাঁরা ভারতসহ অন্য দেশে চলে যেতে চাইছেন৷
এখন ভারতে কট্টর হিন্দুত্ববাদী বিজেপি-শাসিত সরকার রয়েছে৷ সরকারে আসার পর থেকে বহুবার হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার কথা বলেছে শাসক দল ভারতীয় জনতা পার্টি৷ তাদের মেন্টর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘের পক্ষেও তেমনই দাবি করা হয়েছিল৷ কিন্তু বাস্তবে হিন্দুদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া আজও সেই জটিল হয়ে রয়েছে৷ যদিও সরকার পক্ষের বক্তব্য, গত কয়েক বছরে পাকিস্তান থেকে কয়েক হাজার মানুষ এদেশে এসেছেন৷ সরকার তাঁদের স্বাগত জানিয়েছে৷ তাদের এদেশে থাকা, ব্যবসা করা, শিশুদের লেখাপড়া করানোর সুযোগ দেয়া হয়েছে৷ তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে৷
নাগরিকত্ব পেতে লাগে ১৭ বছর!
এখানেই প্রশ্ন উঠেছে, নাগরিকত্ব দেওয়ার দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতিটি কবে পরিবর্তন হবে? গোটা দুনিয়ায় কোনো দেশে নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য সর্বোচ্চ ৫ বছরের বেশি সময় লাগে না৷ সেখানে ভারতে একজন ব্যক্তিকে নাগরিকত্ব পেতে কমপক্ষে ১৭ বছর অপেক্ষা করতে হয়৷ পরিবারের সব সদস্যদের নাগরিকত্ব পেতে ২৫ বছরের বেশি সময় পার হয়ে যায়৷
নব্বইয়ের দশকে ভারতে এসে গুজরাটের আমেদাবাদে উঠেছিলেন পাকিস্তানি চিকিৎসক ডাঃ রাজেশ মাহেশ্বরী৷ কয়েকবছর আগে তিনি ভারতীয় নাগরিক হতে পেরেছেন৷ এখন তিনি লড়ছেন পাকিস্তান থেকে চলে আসা অন্য হিন্দুদের জন্য৷ ডাঃ মাহেশ্বরী ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘ভারতে ভিনদেশিদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ক্ষেত্রে বর্তমান নিয়ম হলো, যে-কোনো ব্যক্তির পিতা, প্রপিতামহের যদি এদেশে জন্ম হয়ে থাকে, তাহলে তাঁকে ৭ বছরের মধ্যে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়৷ তা না হলে এবং ১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্টের পর কারও জন্ম হলে তাঁকে নাগরিকত্ব দিতে অনেক বেশি সময় লাগে৷''
মাহেশ্বরীর দাবি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব নাগরিকত্ব আইন পাস হোক সংসদে৷ তাঁর কথায়, ‘‘গুজরাট, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশসহ যে যে রাজ্যে পাকিস্তানি হিন্দুরা এসে বসবাস করছেন, তাঁরা সমস্যায় পড়েছেন৷ বর্তমান পদ্ধতিতে পরিবারের প্রধানের নাগরিকত্ব পেতে ১৫-১৭ বছর সময়ের প্রয়োজন৷ গোটা পরিবারের ক্ষেত্রে নাগরিকত্ব পেতে কমপক্ষে ২৫ বছর সময়ের প্রয়োজন৷ এটা সঠিক পদ্ধতি নয়৷ এই সমস্যার সমাধানে সংসদে নাগরিকত্ব বিল এনেছিল নরেন্দ্র মোদী সরকার৷ এই বিষয়ক সংসদীয় কমিটি এই সময়সীমাকে সর্বোচ্চ ৫ বছর এবং একসঙ্গে পরিবারের সব সদস্যদের নাগরিকত্ব দেওয়ার ব্যবস্থা করার বিষয়টি বিবেচনা করছে৷''
২০১৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০১৮ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত দু-বছর নাগরিকত্ব দেওয়ার বিষয়টি দেখভালের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে সংশ্লিষ্ট জেলাশাসকদের৷ পাকিস্তান থেকে গুজরাটে এসে বসবাস করছেন প্রায় ৫ হাজার অভিবাসী৷ এঁদের মধ্যে ৩ হাজার মানুষ আমেদাবাদ শহরের আশেপাশে বসবাস করছেন৷ বাকি দু-হাজার মানুষ রাজ্যের অন্যান্য জায়গায় রয়েছেন৷ তাঁদের অনেকেই হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন৷
পশ্চিম রাজস্থানের বহু এলাকায় কয়েক দশক ধরে পাকিস্তান থেকে আসা হিন্দুরা বসবাস করছেন৷ তাঁদের এদেশের নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য সরকারি শিবির খোলা হয়েছিল৷ ফর্ম পূরণ করানো হয়েছিল৷ কিন্তু কেউই এখনও নাগরিকত্ব পাননি৷
আদালতে জমা দেওয়া সিআইডি-র এসপি শ্বেতা ধানকরের একটি হলফনামা থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০১৫ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত ৯৮৬ পাকিস্তানি হিন্দু তাদের দেশে ফিরে গেছেন৷ সূত্রের খবর, গতবছর পাকিস্তানে ফিরে গেছেন ৪৪ জন হিন্দু৷ চলতি বছর এখনও পর্যন্ত সেই সংখ্যা ৫৯৷ ২০১৬ সালে সংখ্যাটা ছিল ৯৷
দাবার ঘুঁটি?
ভারতের নাগরিকত্ব বিষয়ক সংসদীয় যৌথ কমিটির অন্যতম সদস্য পশ্চিমবঙ্গের রায়গঞ্জের সিপিএম সাংসদ মহম্মদ সেলিম৷ পাকিস্তানি হিন্দুরা এদেশে নাগরিকত্ব না পেয়ে ফিরে যাচ্ছেন, এই খবর নিয়ে আলোচনায় ডয়চে ভেলেকে তিনি বললেন, ‘‘যে-কোনো দেশ থেকে অন্য কোনো দেশে মানুষ যখন পাকাপাকিভাবে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় তার পেছনে কয়েকটি কারণ থাকে৷ স্বেচ্ছায় দেশ ছাড়ার প্রধান কারণ হলো, তুলনামূলক উন্নত জীবনযাপনের লক্ষ্য৷ ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তান ভাগ হওয়ার পরেও মূলত সেই কারণেই মানুষ এক দেশে থেকে অন্য দেশে যায়৷ কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত এদেশে এই বিষয়টিকে রাজনৈতিক ও ধর্মীয় কারণ হিসেবে দেখা হয়৷'' গত একবছর ধরে ভারতের সংসদে নাগরিকত্ব বিলটি ঝুলে রয়েছে৷ দীর্ঘসূত্রিতার পথ নিয়েছে সরকার৷ কেউ বলছেন, নির্বাচনি গিমিক৷ কেউ বলছেন, ভারত-পাক সম্পর্ককে কাজে লাগানোর লক্ষ্যে এই বিল এনেছিল সরকার৷
সেলিমের কথায়, ‘‘যে কারণেই হোক না কেন কেন্দ্রীয় সরকার নাগরিকত্ব আইন আনার কথা বলেছিল৷ সেই বিল সংসদে পেশ হয়েছে৷ তারপর সব চুপচাপ৷ আগে থেকেই পাকিস্তান ও বাংলাদেশে নিপীড়িত হিন্দুদের এদেশে আনার কথা বলা হয়৷ পাকিস্তান থেকে কিছু হিন্দু ধর্মাবলম্বী মানুষ এদেশে এসেছেন৷ আমরা সংসদীয় কমিটির পক্ষ থেকে যখন গুজরাট, রাজস্থান ও মধ্যপ্রদেশে গিয়েছি, তখন আমরা দেখেছি, গরিব মানুষের পাকিস্তান ছেড়ে চলে আসার কারণ, এদেশে একটু বেশি রোজগারের আশা৷ কিন্তু, তাঁরা মুখে বলছেন, ‘‘আমাদের মেয়েদের ওপর অত্যাচার হয়েছে (কিছু ঘটনা অবশ্যই ঘটছে)৷ কিন্তু এটা নাগরিকত্ব দেওয়ার কারণ হতে পারে না৷ আসলে এর পেছনে রয়েছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি৷ ভারতের মুসলিমদের পাকিস্তানে পাঠানো আবার পাকিস্তানেও সেদেশের হিন্দুদের ভারতে ফেরত পাঠানোর কথা বলে ভোট আদায় করা হয়৷ এঁরা আসলে দাবার ঘুঁটি হিসেবে ব্যবহৃত হন৷ যাঁরা পাকিস্তান থেকে এসেছিলেন, তাঁদের পেশাগত অসুবিধা হচ্ছে৷ সে চিকিৎসক হোক বা সাধারণ মজুর৷ এ থেকেই প্রমাণ হয়, তাঁরা ধর্মীয় কারণে এদেশে আসেননি৷ এসেছিলেন রুটিরুজির কারণে৷''
এক দেশ থেকে অন্য দেশে যাওয়া প্রসঙ্গে ইউরোপের উদাহরণ টেনে সেলিম আরও বলেন, ‘‘মেক্সিকো ও আমেরিকার মধ্যে সীমান্তে বরাবর যে অভিবাসন হয় তা নিয়ে গন্ডগোল দেখা দিয়েছে৷ অভিবাসন বাতিল করার কথা বলছেন অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প৷ সেক্ষেত্রেও অভিবাসন ধর্মীয় কারণে হয়না৷ সেখানে তো দু-দিকেই খ্রিস্টান৷ মানুষ আরও ভালোভাবে বাঁচার জন্য যেতে চাইছে৷ যেভাবে ভারত থেকে শিখ সম্প্রদায়ের মানুষ কন্টেনার ভর্তি হয়ে ক্যানাডা যাওয়ার চেষ্টা করে, তার কারণ কী ধর্ম? সেক্ষেত্রেও আছে ভালো জীবনযাপনের হাতছানি৷''
উল্লেখ্য, ভারত সরকার ২০১৬ সালে ঘোষণা দিয়েছিল যে, প্রতিবেশী বাংলাদেশ, পাকিস্তান ও আফগানিস্তানসহ অন্যান্য দেশের হিন্দুরা ধর্মীয় কারণে অত্যাচারিত হলে ভারত তাঁদের স্বাগত জানাবে, তাঁদের নাগরিকত্ব দেওয়া হবে৷
এ বিষয়ে আপনার কোনো মতামত থাকলে লিখুন নীচে মন্তব্যের ঘরে৷