ভারতের স্বাস্থ্যখাত: বাইরে ঝকঝকে, ভেতরটা ফাঁপা
১৯ জুন ২০২০এরপর বছর ঘুরেছে৷ ধীরে ধীরে সত্যি সত্যিই সেজে উঠেছে শতাব্দীপ্রাচীন মেডিকেল কলেজ, আরজি কর হাসপাতাল, এনআরএস কিংবা বাঙুর মেডিক্যাল কলেজ এবং হাসপাতাল৷ বড় বড় ফটক লেগেছে রাস্তার উপর৷ আধুনিক আলো লেগেছে৷ ইংরেজ আমলের লাল রং বদলে হয়েছে নীল-সাদা৷ ব্যস, ওইটুকুই৷
বিশেষজ্ঞরা বলেন, শহরের হাসপাতালগুলি বাইরে থেকে দৃষ্টিনন্দন হয়েছে কেবল৷ ভিতরে কোনও সংস্কার হয়নি৷ করোনাকালে বোঝা গেল, পুরো ভারতের স্বাস্থ্য পরিকাঠামোর অবস্থাই কার্যত কলকাতার মতো৷ উপর থেকে চকচকে, ভিতরটা ফাঁপা৷
সম্প্রতি রাজধানী দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল একটি সাংবাদিক বৈঠক করেছেন৷ সেখানে তিনি বলেছেন, যে হারে করোনার সংক্রমণ বাড়ছে, তাতে হাসপাতালগুলিতে রোগীদের বেড দেওয়া সম্ভব হবে না৷ বেসরকারি হাসপাতালগুলির কাছেও সহায়তা চেয়েছিলেন তিনি৷ তাতে দেখা গিয়েছে, অধিকাংশ বেসরকারি হাসপাতালে পর্যাপ্ত আইসিইউ বেড নেই৷ নেই ভেন্টিলেটর৷ অগত্যা, ব্যাঙ্কোয়েট হল, স্টেডিয়ামে বিকল্প হাসপাতাল তৈরির কথা ভাবছে সরকার৷ কেন সরকারকে এমনটা ভাবতে হচ্ছে?
২০২০-২১ সালে স্বাস্থ্যখাতে বাজেট হয়েছে ৬৭ হাজার ১১২ কোটি টাকা৷ গত বছরের পরিবর্ধিত বাজেটের থেকে যা ৩.৫ শতাংশ বেশি৷ বাজেট এবং পরিবর্ধিত বাজেটের মধ্যে সময়ে সময়ে আকাশ পাতাল তফাত হয়ে যায়৷ সরকার যখন সকলের সামনে বাজেট পেশ করে, তখন অনেক খাতেই অতিরিক্ত বরাদ্দ ঘোষণা করা হয়৷ বছরের মাঝামাঝি গিয়ে পরিবর্ধিত বাজেটে বরাদ্দ কমিয়ে দেওয়া হয়৷ স্বাস্থ্যখাতেও এমন ঘটনা ঘটে৷ ফলে বছরের শুরুতে সরকার যে বাজেট দিয়েছে, বছরের শেষেও তা থাকে কি না, সে প্রথম দেখার বিষয়৷ দ্বিতীয় বিষয় হলো, এই বিপুল বাজেট খরচ হয় কোথায়? বিশেষজ্ঞদের অনেকেরই বক্তব্য, কর্মীদের বেতন দিতে এবং লোক দেখানো টেন্ডারে বহু অর্থ ব্যয় হয়ে যায়৷ সরকার জানে, মানুষকে খুশি করতে হলে বাহ্যিক চাকচিক্য প্রয়োজন৷ ফের টেনে আনতে হয় কলকাতার উদাহরণ৷ সেখানকার হাসপাতালগুলিকে বাইরে থেকে দেখলে সত্যিই মনে হয় পাঁচতারা হোটেল৷ ভিতরে ঢুকলে বোঝা যায় পরিকাঠামোর খামতি৷ দক্ষিণের কয়েকটি শহর বাদ দিলে দেশের অন্য নগরগুলিরও একই অবস্থা৷ অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হয়ে যায় বাইরের চাকচিক্যে৷ পরিকাঠামোগত উন্নয়ন হয় না৷ যদি হতো, দেশের প্রায় প্রতিটি সরকারি হাসপাতাল আজ এভাবে ভুগতো না৷ আইসিইউতে বেড নেই৷ পর্যাপ্ত ভেন্টিলেটর নেই৷ চিকিৎসকদের জন্য যথেষ্ট পিপিই কিট নেই৷
যে সময়ের মধ্য দিয়ে আমরা যাচ্ছি, তা স্বাভাবিক সময় নয়৷ করোনার কারণে হাসপাতালগুলির উপর চাপ কয়েক গুণ বেড়ে গিয়েছে৷ কিন্তু একই সঙ্গে এ কথাও ঠিক, করোনা দেশের সরকারি হাসপাতালগুলির আসল চেহারা বাইরে নিয়ে এসেছে৷ শুধুমাত্র করোনার চিকিৎসায় ভেন্টিলেটর লাগে না৷ এই যন্ত্রটি এখন প্রায় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে৷ ২০২০ সালে দাঁড়িয়ে ভারত যখন বিশ্বের কাছে নিজেকে সুপার পাওয়ার হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছে, তখন সামান্য ভেন্টিলেটর থাকবে না কেন হাসপাতালগুলিতে? কেন পিপিই কিট ছাড়াই চিকিৎসা করতে হবে ডাক্তারবাবুদের? পিপিই কিট তো চিকিৎসার একেবারে গোড়ার সরঞ্জাম৷ কেন তা যথেষ্ট পরিমাণে মজুত থাকবে না? কেন বিশ্বের বিভিন্ন দেশে প্যানডেমিক ছড়িয়ে পড়ার দৃশ্য দেখেও আগে থেকে সতর্ক হওয়া গেল না? কেন সামান্য পিপিই কিট কিনতে নুন আনতে পান্তা ফুরায় অবস্থা রাজ্য এবং কেন্দ্র সরকারের? প্রশ্নগুলো সহজ, উত্তর জানা নেই৷
এ তো গেল সরকারি হাসপাতালের কথা৷ করোনার সময়ে দেশের বহু বেসরকারি হাসপাতাল কার্যত ঝাঁপ ফেলে বসে আছে৷ পাছে করোনা রোগী হাসপাতালে ঢুকে পড়ে! পাছে হাসপাতাল থেকে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ে! মাত্র একমাস আগে মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছিল দিল্লিতে৷ ৬৫ বছরের এক বৃদ্ধের হার্ট অ্যাটাক হয়৷ অ্যাম্বুলেন্সে তুলে ওই রোগীর মেয়ে বাবাকে অন্তত তিনটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যান৷ একটি হাসপাতালও রোগীকে অ্যাম্বুলেন্স থেকেই নামাতে দেয়নি৷ ইমার্জেন্সিতে পর্যন্ত নিতে দেওয়া হয়নি৷ চিকিৎসা না পেয়ে পথেই মৃত্যু হয় ওই রোগীর৷ এমন একাধিক ঘটনা ঘটেছে কলকাতায়৷ পুলিশ পর্যন্ত রোগীকে ভর্তি করতে পারেনি৷ কারণ, বেসরকারি হাসাপাতালগুলি রোগী ভর্তি করছে না৷ যুক্তি দেখাচ্ছে, তাদের করোনা সামলানোর পরিকাঠামো নেই৷ বিশেষজ্ঞদের বক্তব্য, সম্পূর্ণ ব্যবসায়িক মানসিকতা থেকেই এই কাজটি করছে বেসরকারি হাসপাতালগুলি৷ করোনার চিকিৎসার সাধারণ পরিকাঠামো তৈরি করে তারা খরচ বাড়াতে চাইছে না৷ ফলে ঝাঁপ ফেলে রাখছে৷ অথচ তাদের কাছে কিন্তু ভেন্টিলেটর আছে৷ আইসিইউ, আইটিইউ পর্যন্ত আছে৷
কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল আবার নিজেদের কোভিড হাসপাতাল বলে ঘোষণা করেছে৷ সেখানে ভর্তি হলে প্রতিদিন এক লাখ টাকা করে খরচ৷ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যে রোগের কোনও চিকিৎসাই নেই, সেই রোগে দিনে এক লাখ টাকা খরচ কীভাবে হবে, সেটাই বোঝা যাচ্ছে না৷
চিকিৎসক সাত্যকি হালদার ডয়চে ভেলেকে জানিয়েছেন, ‘‘আসলে এ দেশে গোটা চিকিৎসা ব্যবস্থাটাই পাতলা সুতোর উপর ঝুলে আছে৷ একটু নাড়া লাগলেই সবটা ভেঙে পড়বে৷ এতদিন ওই দোলাটা লাগেনি৷ করোনা এসে দোলা লাগিয়ে দিয়েছে৷ পুরো ব্যবস্থাটাই ভেঙে পড়েছে৷’’
একই মত চিকিৎসক সমরজিৎ জানার৷ ডয়চে ভেলেকে তিনি জানিয়েছেন, ‘‘চিকিৎসা তো অনেক পরের বিষয়৷ সাধারণ টেস্টের ব্যবস্থাই তো এখনও পর্যন্ত ঠিক করে করা গেল না৷’’ বস্তুত, সমরজিৎবাবুর বক্তব্য, সাধারণ রোগীরাও ঠিক মতো চিকিৎসা পাচ্ছেন না৷ স্বাস্থ্য নিয়ে ব্যবসা কোন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে, তা এখন সকলের কাছে স্পষ্ট হয়ে গিয়েছে৷
এ তো গেল শহরের কথা৷ গ্রামের পরিস্থিতি আরও ভয়াবহ৷ আবার তাকানো যাক পশ্চিমবঙ্গের দিকে৷ দক্ষিণ ২৪ পরগনা একটি বড় জেলা৷ সেই গোটা জেলার মধ্যে একমাত্র মাল্টি স্পেশালিটি সরকারি হাসপাতাল এমআর বাঙুর, যা কি না কলকাতায়৷ এই একটা উদাহরণেই স্পষ্ট জেলাগুলিতে চিকিৎসার অবস্থা ঠিক কী? সুন্দরবনের প্রত্যন্ত গ্রাম নয়, গোসাবায় কোনো নারীর প্রসবযন্ত্রণা হলে অন্তত দেড় ঘণ্টা লাগে তাঁকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে৷ গ্রামের মানুষ অভিযোগ করেন, এলাকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে রোগীদের ভর্তিই করা যায় না৷ নিয়ে গেলেই রেফার করে দেওয়া হয় কলকাতার হাসপাতালে৷ বস্তুত, এই স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলির এ ছাড়া আর কোনো উপায়ও নেই৷ ন্যূনতম চিকিৎসার পরিকাঠামোটুকু পর্যন্ত সেখানে থাকে না৷ ফলে চিকিৎসকরা বাধ্য হয়েই কলকাতায় পাঠিয়ে দেন রোগীদের৷ রাস্তাতেই মৃত্যু হয় বহু রোগীর৷
হাসপাতাল ভর্তি নেয় না৷ স্বাস্থ্যকেন্দ্রে পরিকাঠামো নেই৷ হাসপাতালগুলির সংস্কার হয়নি৷ এ সব কথা বোঝার জন্য করোনার প্রয়োজন হয় না৷ ভারতের অধিকাংশ মানুষ এমনিতেই এগুলি জানতেন৷ এও জানতেন যে, বেসরকারি হাসপাতালগুলি ব্যবসা ছাড়া আর কিছু বোঝে না৷ মৃতপ্রায় রোগীকে ভেন্টিলেটরে ফেলে রেখে বিল বাড়ানো হয়েছে, এই অভিযোগ প্রায় প্রতিদিনের৷ অথচ প্রয়োজনের সময় সেই ভেন্টিলেটরই পাওয়া যাচ্ছে না৷ আর তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে অনিয়ম৷ গুজরাটের সরকারি হাসপাতাল কয়েক কোটি টাকা দিয়ে একটি সরকার ঘনিষ্ঠ সংস্থার কাছ থেকে ভেন্টিলেটর কিনেছে৷ অভিযোগ, সেই ভেন্টিলেটরগুলি আসলে কাজই করে না৷ পিএম কেয়ার ফান্ড থেকে টাকা নিয়ে সেই ভেন্টিলেটর কেনা হয়েছে৷ এ অনিয়মও নতুন কিছু নয়৷ সারা বছরই স্বাস্থ্যখাতে এমন নানা অনিয়মের কথা শোনা যায়৷ করোনার সময় সেই সব কিছুকেই একেবারে সামনে নিয়ে এসেছে৷ কিছুই আর লুকনো নেই৷