নতুন রাষ্ট্রপতি রামনাথ কোবিন্দ?
২০ জুন ২০১৭হ্যাঁ, প্রণব মুখার্জির পর তিনিই হয়ত দেশের সর্বোচ্চ সাংবিধানিক পদে বসতে চলেছেন৷
ভারতের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর রাজনৈতিক গুরুর নামটিই ছিল বহুচর্চিত৷ নরেন্দ্র মোদী ও অমিত শাহ'রা আচমকা রামনাথ কোবিন্দের নাম চূড়ান্ত করায় সবচেয়ে বেশি ধাক্কা যদি কারও লেগে থাকে, তবে সেটা আদবানি শিবিরের লেগেছে৷ এখন প্রমাণিত যে, মোদী যা চাইবেন, সেটাই বিজেপিতে শেষ কথা৷ প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী অবশ্য এবারও প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে তাঁর চমকের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছেন৷ তাই বিহারের বর্তমান রাজ্যপাল তথা দলিত নেতা রামনাথ কোবিন্দই ভারতের সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি৷ তাঁর জন্ম উত্তর প্রদেশের কানপুরে৷ উত্তর প্রদেশ থেকে এর আগে ৯ জন প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন৷ এই প্রথম একজন রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন৷
এখনও অবধি অঙ্কের হিসেব অন্তত সেরকমই বলছে৷ তবুও নির্বাচন তো, কাজেই নিশ্চিত হওয়া কঠিন৷ সেজন্যই কি এক ঢিলে অনেকগুলো পাখি মারলেন নরেন্দ্র
মোদী? দলিত নেতার মনোনয়নের বিরুদ্ধে কারও মুখ খোলার সম্ভাবনা নেই৷ তাছাড়া ২০১৯-এর জন্য উত্তর প্রদেশ খুব গুরুত্বপূর্ণ৷
দলিত কোরি সমাজের প্রতিনিধি কোবিন্দ৷ উত্তর প্রদেশে দলিত সমাজের সংখ্যার বিচারে জাটব ও পাসিদের পরে তৃতীয় স্থানে রয়েছে এই কোরি সম্প্রদায়৷ সে রাজ্যে উচ্চবর্ণ ও অনগ্রসরেরা সরকারে বা দলে গুরুদায়িত্ব পেয়েছেন৷ এবার রাজ্যের এক দলিত নেতাকে মোদী পাঠাতে চাইছেন রাষ্ট্রপতি ভবনে৷ এখন বিরোধীরা কোনও দলিতকে প্রার্থী না করলে বিরোধী শিবিরের অনেক দলই এনডিএ-র সঙ্গে চলে আসবে৷
সব জল্পনার বাইরে থাকা কোবিন্দের নাম স্থির করার পরে অবশ্য বিজেপি নেতারা প্রায় সব বিরোধী নেতার সঙ্গে কথা বলেছেন৷ কিন্তু একতরফা নাম ঘোষণায় ক্ষুব্ধ মমতা ব্যানার্জি, কংগ্রেস, সিপিএমসহ বিরোধীদের অনেকেই৷ এমনকি খুশি নয় বিজেপির অন্দরে আদবানি-শিবিরও৷ প্রমাণ হয়ে গেল, আদবানি আর বিজেপির ‘পিতামহ' নেই৷ বরং উপদেষ্টামণ্ডলীর একজন সদস্য হয়েই থেকে গেলেন৷
২০১৪ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী যখন সরকার গড়লেন, তারপর থেকেই সব মহলে দেশের পরবর্তী রাষ্ট্রপতি হিসেবে আদবানির নাম শোনা যাচ্ছিল৷ মুরলী মনোহর যোশির নামও প্রায়ই ভাসত৷ কিন্তু, শেষমেশ তা হলো না৷ হাইপ্রোফাইল নেতাদের পরিবর্তে নাম উঠে এলো লো-প্রোফাইল এক ব্যক্তির৷ বিজেপির একটি সূত্র জানাচ্ছে, রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ার প্রবল ইচ্ছে ছিল এই দুই নেতার৷ কিন্তু দিন কয়েক আগেই আদবানি ও যোশিকে নিজেদের সম্ভাব্য সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দিয়েছিলেন মোদী ও শাহ৷ একসময় আদবানি ছিলেন সম্ভাব্য প্রধানমন্ত্রী৷ এবার সম্ভাব্য রাষ্ট্রপতি৷ কোনোবারই শিঁকে ছিঁড়ল না৷ দুই প্রবীণ নেতার মতোই ‘সম্ভাব্য' হয়ে থেকে গেলেন বিদেশমন্ত্রী সুষমা স্বরাজও৷ ঘটনাচক্রে, এই তিনজনই ২০১৪'র ভোটের অনেক আগেই মোদীকে দলের মুখ হিসাবে তুলে ধরার সিদ্ধান্তের বিরোধী ছিলেন৷
বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতিশ কুমারতাঁর রাজ্যের রাজ্যপাল রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হওয়ায় ব্যক্তিগতভাবে সন্তোষ প্রকাশ করলেও সমর্থনের প্রশ্নে স্পষ্ট ইঙ্গিত না দিয়ে বলেছেন, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে বিরোধীদের বৈঠকে৷
২২ তারিখে ইউপিএ ও সহযোগী দলগুলি প্রার্থী নিয়ে বৈঠকে বসবে৷ ইতিমধ্যে মায়াবতী জানিয়ে দিয়েছেন, দলিত প্রার্থীর প্রতি তাঁদের মনোভাব অবশ্যই সদর্থক, তবে বিরোধীরাও দলিত প্রার্থী দিচ্ছেন কিনা দেখে নিয়ে তাঁরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন৷
আগামী ১৭ জুলাই রাষ্ট্রপতি নির্বাচন৷ ২৮ জুনের মধ্যে মনোনয়ন জমা দিতে হবে৷ গণনা ২০ জুলাই৷
‘‘বিজেপি একতরফাভাবে তাদের প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে৷ অন্যান্য বিরোধী দল সংসদীয় গণতন্ত্রের নিয়ম মেনে শাসক দলের কাছে প্রার্থীর নাম জানতে চেয়েছিল৷ সরকার কথা রাখেনি''— এমনটাই বলছেন পশ্চিমবঙ্গের বিধায়ক ডা. মানস ভু্ঁইয়া৷ তাঁর মতে, ‘‘এমন একজনকে রাষ্ট্রপতি পদে চাওয়া হয়েছিল যিনি হবেন, দেশের ধর্মনিরপেক্ষতা, ভারতের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য সম্পর্কে ওয়াকিবহাল৷ মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি ভারতের রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন৷ গতকাল নেদারল্যান্ডস যাওয়ার আগে দুবাইয়ে তিনি তাঁর প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, যা অত্যন্ত সঠিক৷ আমাদের মনে হয়েছে, শাসক দলের সদিচ্ছার অভাব আছে৷ ২২ তারিখ বিরোধীরা বৈঠকে বসছে৷ সেখানে মমতা ব্যানার্জি এবং তাঁর প্রতিনিধি মতামত জানাবেন৷ মনে হচ্ছে, এবার প্রতিদ্বন্দ্বিতা অবশ্যম্ভাবী৷''
টানা ১২ বছর রাজ্যসভার সদস্য ছিলেন রামনাথ কোবিন্দ৷ জন্মেছিলেন উত্তর প্রদেশের কানপুর দেহাতে, ১৯৪৫ সালে৷ বি-কম পাস করে তিনি আইনে স্নাতক হন কানপুর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে৷ তৃতীয়বারের চেষ্টায় আইএএস পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েও অ্যালায়েড ক্যাডারে কাজ পাবেন জেনে চাকরি নেন৷ ১৯৭৭ সালে প্রথম যখন কেন্দ্রে অ-কংগ্রেসি সরকার তৈরি হয়, তখন তিনি প্রধানমন্ত্রী মোরারজি দেশাইয়ের ব্যক্তিগত সচিব ছিলেন৷ পরে হাইকোর্ট ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী হিসেবে কাজ করতেন৷ ১৯৮০ থেকে '১৯৯৩ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় সরকারের কৌঁসুলি হিসাবে কাজ করেছেন৷
উত্তর প্রদেশে থেকে দু'বার রাজ্যসভায় মনোনীত হন (১৯৯৪–২০০৬) রামনাথ কোবিন্দ৷ তফসিলি জাতি ও উপজাতি কল্যাণ, স্বরাষ্ট্র, পেট্রোলিয়াম ও প্রাকৃতিক গ্যাস, সামাজিক ন্যায় ও ক্ষমতায়ন, আইন ও ন্যায়বিচারসহ বেশ কয়েকটি সংসদীয় কমিটির সদস্য হয়েছিলেন৷ রাজ্যসভার হাউস কমিটিরও চেয়ারম্যান ছিলেন৷ ১৯৯৮ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত কোবিন্দ বিজেপির তফসিলি মোর্চার সর্বভারতীয় সভাপতি ছিলেন৷ ২০১৫ সালের ৮ আগস্ট তিনি বিহারের রাজ্যপাল হিসেবে দায়িত্ব নেন৷ নিজের গ্রামের বাড়িটি তিনি বারাতঘর (যেখানে বিয়ে হয়) হিসেবে দান করে দিয়েছেন৷ প্রচারের আলো থেকে একটু দূরে থাকতে পছন্দ করেন কোবিন্দ৷ বিজেপির কট্টর হিন্দুত্ববাদীদের মধ্যে তাঁকে ফেলা যায় না৷ বরং তিনি সব সময়েই সক্রিয় সামাজিক ন্যায়বিচারের প্রশ্নে৷ তাঁকে রাজ্যপাল করায় অসন্তোষ জানিয়েছিলেন নীতিশ কুমার৷ কিন্তু নরম স্বভাবের মানুষটির সঙ্গে পরে বিহারের মুখ্যমন্ত্রীর খুবই ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে৷
একদিকে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে দলিত নির্যাতনকে ইস্যু করে বিরোধী দলগুলো যেভাবে বিজেপিকে চেপে ধরার চেষ্টা করছিল, তাতে কেন্দ্রের শাসক দল হিসেবে অস্বস্তি এড়াতে পারছিল না বিজেপি৷ প্রায় বছর দেড়েক ধরে দলিত ইস্যু প্রধানমন্ত্রীর মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল৷ বিহারবাসীর কাছে দলিত-দরদি বার্তা পৌঁছে দেওয়াও মোদীর অন্যতম লক্ষ্য৷ তাছাড়া, মোদী এমন লোকদেরই বেশি পছন্দ করেন, যাঁরা কম কথা বলেন, বেশি কাজ করেন৷
কোবিন্দকে বেছে নেওয়ার আর একটি কারণ হলো, তিনি স্বয়ংসেবক৷ মৃদুভাষী কোবিন্দ সুশিক্ষিতও বটে৷ কোবিন্দের নামে সংঘও বেজায় খুশি৷ কারণ, কোবিন্দের শিকড় তো সংঘেই৷