1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

পশ্চিমবঙ্গে ব্লাড ব্যাংকে রক্তের আকাল

পায়েল সামন্ত কলকাতা
১২ জুন ২০১৭

গরম আসতেই পশ্চিমবঙ্গে শুরু হয়েছে রক্তের তীব্র সঙ্কট৷ হাসপাতাল এবং ব্লাড ব্যাঙ্কে রক্তের আকাল৷ অনেক রোগী, রোগীর স্বজনেরা পড়েছেন সমস্যায়৷ চাহিদা পূরণে রাজ্য জুড়ে চলছে বিশেষ উদ্যোগ৷

https://p.dw.com/p/2eWb5
Situation in Krankenhäusern Kalkutta Indien
ছবি: DW/P. Samanta

রক্ত সমস্যার সমাধানে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রীকেও এগিয়ে আসতে হয়েছে৷ তাঁর নির্দেশে গরমের কটাক্ষ এড়িয়ে শুরু হয়েছে সান্ধ্যকালীন রক্তদান শিবির৷

পুলিশ থেকে পুরসভা, সাধারণ নাগরিক থেকে সমাজসেবী— সকলকেই একবাক্যে সান্ধ্যকালীন রক্তদানের উদ্যোগকে বাহবা দিয়েছেন৷ কিন্তু স্রেফ বাহবা বা পিঠ চাপড়ানি নয়, এগিয়ে আসতে হবে সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে৷

এ সত্য সবাই বুঝেছেন কি? পশ্চিমবঙ্গে রক্তদানের আসল চেহারাটাই বা এখন কেমন?

বছরে ১১ লক্ষ বোতল রক্ত দরকার হয় রাজ্যে৷ এই বিপুল পরিমাণ রক্ত সংগ্রহের জন্য স্বেচ্ছা রক্তদান শিবিরের ওপরই ভরসা করতে হয়৷ কিন্তু ইদানীং তথাকথিত স্বেচ্ছা রক্তদানের ক্ষেত্রে উঠে এসেছে উপহার বিনিময়ের অভিযোগ৷ রক্তদানের বিনিময়ে প্রেসার কুকার, রান্নার বাসন, ট্রলি ব্যাগ ঘরে নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ উঠছে রক্তদাতাদের বিরুদ্ধে৷

রক্তদানের আসল শক্তিই হচ্ছে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ততা৷ উপহারের বাড়বাড়ন্তে সেই স্বতঃস্ফূর্ততায় পড়ছে ব্যাঘাত৷ দীর্ঘদিন ধরে প্রচার চালিয়ে রক্তদান আন্দোলন নিয়ে মানুষের মনে একটা সচেতনতা গড়ে তোলা হয়েছে৷ উপহার কেনায় আর্থিকভাবে অসমর্থ ছোট ক্লাব বা সংগঠনগুলি ছিল তার মূলে৷ রক্তদানে উপহার প্রথার আগমনে অনেকেই ছোট ক্লাবে বিনা উপহারে যেতে নারাজ৷ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শাসক গোষ্ঠীর লোকজন উপহার দেওয়ায় জড়িত বলে জানা যায়৷ নিছক ওয়াটার ফিল্টার বা প্রেসার কুকার পাওয়ার লোভে এখন রাজ্যে রক্তদান শিবির পরিণত হয়েছে প্রতিযোগিতা আর উৎসবে৷

এর ফলে রক্তদানের সঙ্গে যুক্ত সংগঠন এবং ব্লাড ব্যাঙ্কের সদস্যরা প্রমাদ গুনছেন৷ তবে উপহারের তত্ত্ব খারিজ করে এগিয়ে এসেছেন দুর্গাপুজোর উদ্যোক্তারা৷ ‘মায়ের জন্য রক্তদান’ শীর্ষক শিবিরের আয়োজন করে তাঁরা হাত বাড়িয়েছেন রক্ত সঙ্কটের মোকাবিলা করতে৷ এখানে রক্তদাতারা পাবেন দুর্গাপুজোর ভিআইপি পাস৷ চলতি সপ্তাহে ক্ষুদিরাম অনুশীলন কেন্দ্রে মায়ের জন্য রক্তদান শিবির বসেছিল৷ সেখানে ৯০০ জন রক্ত দিয়েছিলেন৷ এছাড়া কলকাতা পুরসভার তরফে দক্ষিণ কলকাতায় ব্লাড ব্যাঙ্ক খোলার কথাও জানানো হয়েছে৷ এর ফলে রক্তের সঙ্কট অনেকটাই মিটবে বলে আশা করা হচ্ছে৷

একজন ব্যক্তি বছরে চারবার রক্ত দিতে পারেন: বরুণ কুমার পাণ্ডা

পশ্চিমবঙ্গের রক্তদান আন্দোলন অনেক পুরনো৷ এ ব্যাপারে অগ্রণী সংগঠন ‘অ্যাসেসিয়েশন অফ ভলান্টিয়ারি ব্লাড ডোনার্স, ওয়েস্ট বেঙ্গল’৷ এই সংগঠনের পক্ষে বরুণ কুমার পাণ্ডা জানান, ১৯৮০ সালের ২০ জানুয়ারি তাঁদের প্রতিষ্ঠানের পথ চলা শুরু৷ এই ধরণের সংগঠন মূলত চারটি ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে৷ এক, জনতাকে সচেতন করতে হবে৷ তাদের রক্তদানের প্রয়োজনীয়তা বোঝাতে হবে৷ দুই, সাধারণ মানুষকে রক্তদানের জন্য অনুপ্রেরণা জোগানো৷ অর্থাৎ তাদের মধ্যে রক্তদানের আগ্রহ জাগিয়ে তোলা৷ তিন, রক্তদান শিবির সংগঠন৷ সচেতন ও রক্তদানে আগ্রহী ব্যক্তি যদি রক্ত দিতে চান, তাহলে কোথায় দেবেন? সে জন্য তার বাড়ির কাছাকাছি শিবিরের আয়োজন করা হয়৷ চার, রক্তদানের স্বীকৃতি৷ একজন ব্যক্তি বছরে চারবার রক্ত দিতে পারেন, সংগঠকরা পদক বা প্রশংসাপত্রের মাধ্যমে রক্তদানকারীকে স্বীকৃতি দেন, যাতে তিনি ফের শিবিরে এসে রক্তদান করেন৷

যিনি রক্ত দিলেন, তাঁর সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি অন্যের জীবন বাঁচানোর গৌরব ও সামাজিক দায়িত্ব পালনের তৃপ্তি৷ একইসঙ্গে রক্তদানের ফলে তাঁর হাতে আসা কার্ডটি বিপদে-আপদে রক্তদানকারী বা তাঁর প্রিয়জনের জীবনরক্ষা করতে পারে৷

অনেক শিবির ঘিরে উপঢৌকন বিতরণের অভিযোগ উঠলেও নিষ্কাম রক্তদানের পরিমাণই বেশি৷ কলকাতার বাইরে রক্তের চাহিদা মেটাতে পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-গঞ্জে এখনও স্বেচ্ছা রক্তদান শিবিরের আয়োজন করা হয়৷ অবশ্য সেসব শিবিরের বিরুদ্ধে প্রায়ই অপরিচ্ছন্নতা বা সুরক্ষাহীনতার অভিযোগ ওঠে৷

উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ ব্লাড ব্যাঙ্কের ডাক্তার রাজকুমার সিং এ প্রসঙ্গে ডয়চে ভেলেকে জানালেন, ‘‘উত্তরবঙ্গের জেলাগুলিতে রক্তের চাহিদা খুবই৷ সে জন্য রক্তদান শিবিরের আয়োজন করতেই হয়৷ তবে সেগুলি যথেষ্ট স্বাস্থ্যবিধি মেনেই আয়োজিত হয়৷ এইচআইভি, হেপাটাইটিস বি ও সি, ম্যালেরিয়াসহ গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি পরীক্ষা না করে রক্তগ্রহণ করা হয় না৷’’ তবে রক্তদান শিবিরে প্রশিক্ষিত যুবক-যুবতীর অভাব কখনো কখনো সংক্রমণের ঝুঁকি বাড়ায়৷ এ তথ্য মেনে নিয়েছেন অ্যাসেসিয়েশন অফ ভলান্টিয়ারি ব্লাড ডোনার্সের বরুণ পাণ্ডা৷

উত্তরবঙ্গের বিশিষ্ট সমাজসেবী তথা কলকাতা পুলিশকর্মী বাপন দাস রক্তদান আন্দোলনের অগ্রণী সৈনিক৷ সারা বছর রক্তদান শিবিরের আয়োজন করে তিনি উত্তরবঙ্গ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে রক্তের জোগান দেন৷ ধর্ম-বর্ণ-জাতি নির্বিশেষে এমনকি পুরুষের পাশাপাশি মহিলাদেরও উৎসাহ দিতে তাঁর জুড়ি নেই৷

রক্তদান শিবিরে ৬৮ জনের মধ্যে ৬২ জনই ছিল সংখ্যালঘু (মুসলিম) সম্প্রদায়ের: বাপন দাস

সংখ্যালঘুদের মধ্যে সরকারি টিকা গ্রহণের ব্যাপারে একটা ছুঁৎমার্গ থাকে৷ তাঁদের অনেকে মূলত শিক্ষার অভাবের কারণেই  মনে করেন, এই টিকা কর্মসূচি আদতে তাঁদের জন্ম নিয়ন্ত্রণের কৌশল৷ এ কারণে পালস পোলিও টিকাকরণ থেকে তাঁরা মুখ ফিরিয়ে ছিলেন৷ এখন পরিস্থিতি বদলেছে৷ বাপন দাস বলেন, ‘‘গত ফেব্রুয়ারি মাসের একটি রক্তদান শিবিরে ৬৮ জনের মধ্যে ৬২ জনই ছিল সংখ্যালঘু (মুসলিম) সম্প্রদায়ের৷’’

রক্তদান আন্দোলনে মহিলাদের অংশগ্রহণ চোখে পড়ার মতো৷ উত্তরবঙ্গের মহিলারাও রক্তদানে এগিয়ে এসেছেন৷ একটি শিবিরে ৭২ জন স্বেচ্ছায় রক্তদাতার মধ্যে ২২ জনই ছিলেন মহিলা৷ বিধাননগর ওয়েলফেয়ার সোসাইটির প্রতিষ্ঠাতা বাপনের মতো অনেকে গ্রীষ্মকালীন রক্ত সঙ্কট মেটাতে সক্রিয় রয়েছেন৷ বাপনের মত, প্রচণ্ড গরমের জন্য এ সময় শিবির বন্ধ থাকে৷ ফলে রক্তের অভাব দেখা দেয়৷ সে কারণেই সান্ধ্য শিবিরের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়েছেন তিনি৷ গরম এড়িয়ে রক্ত দিলে অভাব মিটবে৷ তবে ইদানীংকালের উপহার দেওয়া-নেওয়ার পরম্পরা বাপন দাসের মতো উদ্যোক্তাদের আহত করে বৈকি!