এই লেখাটা যখন লিখছি, তখনও ফেসবুকে ভেসে বেড়াচ্ছে কিছু ছবি৷ তিন ব়্যাব সদস্য এবং তাদের দুই সোর্স ‘এক চোরকারবারী ধরতে' গিয়ে ভারতের সীমান্তে ঢুকে গিয়েছিলেন৷ সেখানে তাদের বেধড়ক মারধর করে ফিরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ বাংলাদেশের অন্যতম শক্তিশালী একটি আইনপ্রয়োগকারী সংস্থার চোখ এবং হাত বাঁধা আহত সদস্যদের কাদায় পড়ে থাকা ছবি দেখে ফেসবুকে কেউ কেউ খুশিও হচ্ছেন৷ কিন্তু আমার চোখে জল এসে গেছে৷ দু'জন মানুষকে বর্বরভাবে পেটানো কোন যুক্তিতেই আমার কাছে সমর্থনযোগ্য নয় তা তারা যাই হোক না কেন৷
এটা সত্য যে তাদের এভাবে সীমান্ত পেরিয়ে অন্য দেশে যাওয়াটা অবৈধ ছিল৷ কিন্তু এই অবৈধ কাজের পরিনতি কী হতে পারে সেটা নিয়ে সুস্পষ্ট আইন রয়েছে৷ সেই আইন অনুযায়ী তাদের সাজা হতে পারতো৷ আর তাতে আমার বিন্দুমাত্র আপত্তি নেই৷
বাংলাদেশ এবং ভারতের মানুষের মধ্যকার সম্পর্ক আমার বিবেচনায় অসাধারণ৷ আমি নিজে বেশ কয়েকবার ভারতে গিয়েছি৷ জার্মানিতে গত এক যুগে অনেক ভারতীয়র সঙ্গে কথা হয়েছে, সখ্যতা হয়েছে৷ মোটা দাগে আমার কখনো মনে হয়নি ভারতীয়দের মধ্যে বাংলাদেশিদের নিয়ে কোন ব্যক্তিগত ক্ষোভ বা ঘৃণা রয়েছে৷
আর বাংলাদেশিদের ভারতীয় পণ্যের প্রতি টান কতটা সেটাতো আমরা সবাই জানি৷ ঈদ-পুজার পোশাক বলেন কিংবা কোরবানির গরু - ভারত থেকে যাই, যেভাবে আসুক বাংলাদেশিরা সেটা বেছে নিচ্ছেন৷ এমনকি বাংলাদেশিদের বিনোদনের একটা বড় উৎস ভারতীয় টিভি সিরিয়াল আর সিনেমা৷ দেশটির প্রতি আমাদের আগ্রহ অনেক৷ ফলে এখানেও মোটা দাগে ভারতের প্রতি কারো ব্যক্তিগত ঘৃণা বা ক্ষোভ আমি দেখতে পাই না৷
তবে, সরকারি পর্যায়ে একধরনের বৈষম্য, বিদ্বেষ সৃষ্টির চেষ্টা আমি দেখতে পাই৷ আর সেক্ষেত্রে ভারত সরকার গত এক যুগের বিবেচনায় বেশ এগিয়ে৷ বাংলাদেশের জনগণের চেয়ে আওয়ামী লীগ দলকে আপন করে নেয়ার একটি নীতি ভারত পরিস্কারভাবে ফুটিয়ে তুলেছে৷ আর আওয়ামী লীগও ভারতকে তুষ্ট রাখতে নিজের দেশের মানুষের আশা-আকাঙ্খার চেয়ে প্রতিবেশির ইচ্ছাকে কয়েকগুণ বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে৷ এটা দিবালোকের মতো পরিষ্কার৷
আমার কাছে মনে হয়, দুই দেশের সরকারের এরকম নীতি আপাতদৃষ্টিতে তাদের জন্য লাভজনক হলেও দীর্ঘ মেয়াদে দুই দেশের মানুষের মধ্যে বৈরিতা সৃষ্টি করছে, করবে৷ আর এমন নীতির সমালোচনা করতে গিয়ে যখন কাউকে প্রাণ দিতে হয়, যখন সীমান্তে আহত-নিহত বাংলাদেশিদের পড়ে থাকতে দেখা যায়, তখন ঘৃণাও সৃষ্টি হয়৷ প্রশ্ন হচ্ছে, রাষ্ট্র দু'টি কি তাদের নাগরিকদের মধ্যে ঘৃণার বসতি গড়বে, নাকি ভালোবাসারক্ষেত্র গড়ে দেবে?
জার্মানিতে দীর্ঘদিন থাকি, সাংবাদিকতা করি৷ তাই মাঝেমাঝেই ইউরোপের সঙ্গে দক্ষিণ এশিয়ার তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরতে মন চায়৷ অফিসও কখনো কখনো সেটাই প্রত্যাশা করে৷ এখানে তাই জার্মানি আর ফ্রান্সের মধ্যকার সম্পর্কের একটা উদাহরণ টানতে চাই৷ জার্মানি সম্পর্কে আমার যে আগ্রহ, তা গড়তে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন সৈয়দ মুজতবা আলী৷ আমার প্রিয় লেখকের ‘চাচা কাহিনী' পড়ে জার্মান সংস্কৃতি সম্পর্কে খানিকটা ধারনা পেয়েছিলাম৷ হিটলারকে নিয়ে তাঁর লেখা পড়ে বুঝেছি অনেক কিছু৷
তো, সেই চাচা কাহিনীতে এক জার্মান কর্ণেলের কথা ছিল যিনি প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর কার্যত নিঃস্ব হয়ে গিয়েছিলেন৷ কর্ণেলের একটা মেয়ে ছিল৷ শেষ জীবনে তিনি সেই মেয়েকে ত্যাজ্য করেছিলেন শুধুমাত্র একটি কারণে৷ মেয়েটা এক ফরাসি তরুণকে বিয়ে করেছিল৷ জার্মান এবং ফরাসিদের মধ্যে তীব্র বৈরি সম্পর্কের একটা ছোট্ট উদাহরণ এটি৷ এমন উদাহরণ অনেক৷ কয়েক শতক ধরে চলেছে এই বৈরিতা৷
কিন্তু, অনেক ক্ষতিসাধণের পর দু'দেশই একসময় বুঝতে পেরেছে যে বৈরিতা লালন করার চেয়ে সম্পর্কটা ভালোবাসায় রূপ দেয়াটা অনেকবেশি লাভজনক৷ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী জার্মানির প্রথম চ্যান্সেলর কনরাড আডেনাউয়ার ও ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট শার্ল দ্য গোল তাই ১৯৬৩ সালে এলিসে চুক্তি করেন৷ সেই চুক্তির পর দেশ দু'টির এবং দেশ দু'টির মানুষের মধ্যকার সম্পর্কে অনেকটাই বদলে গেছে৷ বৈরিতা রূপ নিয়েছে ভালোবাসায়৷
আজকে যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ব্রিটেন চলে গেলেও নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে পারবে বলে আশা করছে, সেটা ঐ ফরাসি আর জার্মানিদের মধ্যকার গভীর সম্পর্কের কারণে৷ ইউরোপের এই ইতিহাস যখন মনে পড়ে তখন ভাবি, ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যেতো শত শত বছরের শত্রুতা ছিল না৷ বরং একসময় এক ছাতার তলেই ছিল সবাই৷ তাহলে এখন কেন এত বৈষম্য, ঘৃণা সৃষ্টির চেষ্টা? আমাদের রাজনীতি কি শুধু মানবতার পরাজয় দেখার জন্য?
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷