রামপালে না হলে, কোথায়?
৩১ আগস্ট ২০১৬যুক্তি দিয়ে যখন এই যুক্তির বিরোধিতা করা যাচ্ছে না, তখন প্রসঙ্গ আনা হলো, তাহলে কাথায় হতে পারে রামপালের বিকল্প জায়গা? বলা হলো, আন্দোলনারীরা বলে দিক রামপালে না হলে, কোথায় হবে এই বিদ্যুৎ প্রকল্প? কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প এবং এটি কোথায় হতে পারে – তা নিয়েই এই সংক্ষিপ্ত আলোচনা৷
১. কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যে প্রয়োজন বিপুল পরিমাণ কয়লা৷ এই কয়লা বাংলাদেশে নেই৷ তাই কয়লা আমদানি করে আনতে হবে ইন্দোনেশিয়া, অস্ট্রেলিয়া বা অন্য কোনো দেশ থেকে৷ ভারত থেকেও কয়লা আমদানির কথা বলা হচ্ছে৷ যদিও ভারতে এত বিপুল পরিমাণ কয়লা নেই৷ ভারত নিজেও কয়লা আমদানি করে বিদ্যুৎকেন্দ্র পরিচালনা করে৷ ভারত একবার আমদানি করবে, সেই কয়লা আবার বাংলাদেশ আমদানি করবে – এমন উদ্ভট পরিকল্পনা চলছে কিনা নিশ্চিত নই৷
এখানেই শেষ নয়৷ কয়লা আমদানি করতে হবে বড় বড় জাহাজে৷ এর জন্যে বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাছাকাছি সমুদ্রবন্দর থাকতে হবে৷ রামপালের কাছাকাছি মংলা বন্দর আছে৷ যদিও বড় জাহাজ মংলা বন্দর পর্যন্ত আসবে না৷ গভীর সমুদ্র থেকে ছোট জাহাজে করে মংলায় আনা হবে কয়লা৷ কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দের জন্যে প্রচুর পরিমাণ পানির জোগান থাকতে হবে৷ অর্থাৎ বিদ্যুৎকেন্দ্রের পাশে পানির উৎস হিসেবে নদী থাকতে হবে৷
রামপালের পাশে পশুর নদী আছে৷ যদি রামপালের পাশে সুন্দরবন না থাকত, তবে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্যে আদর্শ জায়গা হতে পারত রামপাল৷ কিন্তু সুন্দরবনের কারণে রামপালে কোনো যুক্তিতেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হতে পারে না৷ কোনো যুক্তিতেই পারে না৷
২. যুক্তি দিয়ে না পেরে সরকার সংশ্লিষ্টরা এখন যুক্তি দিচ্ছে, তাহলে কোথায় হবে বিদ্যুৎকেন্দ্র, আন্দোলনকারীরা তা বলে দিক৷ যত রকমের যুক্তি বা তর্ক আছে, সবচেয়ে বড় কু-যুক্তি বা তর্ক এটাই! কারণ জায়গা নির্দিষ্ট করে দেয়া আন্দোলনকারীদের বিষয় নয়৷ এটা সরকারের কাজ, গবেষণার কাজ৷ তাই সুবিধাজনক জায়গা সরকারকেই খুঁজে বের করতে হবে এবং বাংলাদেশের মতো দেশে যেখানেই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চাওয়া হোক না কেন, প্রতিবাদ-প্রতিরোধ হবে৷ তার কারণ বাংলাদেশে জায়গা কম, মানুষ বেশি৷ আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সরকারের কথা-কাজের উপর জনগণের আস্থা না থাকা৷
সরকার, সরকার সংশ্লিষ্টরা যা বলেন, মানুষ তা বিশ্বাস করেন না৷ মহেশখালীর মাতারবাড়িতে একটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ার কথা৷ চট্টগ্রামের বাঁশখালীতেও আরেকটি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হওয়ার কথা৷ দু'টি জায়গাই মানুষের বসবাস, জীবন-জীবিকার সঙ্গে সম্পৃক্ত৷ বাঁশখালী থেকে অনেকগুলো পরিবারকে সরিয়ে নিতে হবে৷ বাঁশখালীর এই মানুষগুলোর ভিটেমাটি, আবাদী জমি আছে এখানে৷ লবণ চাষ করে এখানে৷ জীবন-জীবিকা, ভিটেমাটির টানে তারা প্রতিবাদ করতেই পারেন৷ প্রতিবাদ করার আগেই সরকারের উচিত ছিল, স্থানীয় জনগণের সঙ্গে আলোচনা করা৷ তারা এখন যে জীবনযাপন করে, তার সমান বা বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়ে তাদের সরিয়ে নেয়া হবে – এমন প্রস্তাবনা নিয়ে আলোচনা করলে, তাদের রাজি না হওয়ার কারণ ছিল না৷ সরকার তা করেনি৷
জোর-জুলুম করেছে৷ গুলি করে মানুষ হত্যা করেছে৷ পুলিশ-মাস্তান দিয়ে এলাকার মানুষের নানা প্রতিকূলতা তৈরি করা হচ্ছে, যাতে তারা এলাকা ছেড়ে চলে যায়৷ এই ভুল নীতিতে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ অনিবার্য৷ মাতারবাড়ির ক্ষেত্রেও প্রায় একই ঘটনা ঘটছে৷
৩. রামপালের প্রকল্পটি কোথায় সরিয়ে নেয়া যেতে পারে, তা সরকারকে নির্ধারণ করতে হবে৷ আন্দোলনকারীরা জায়গা নির্ধারণ করে দিতে পারবে না এবং যেখানেই তা করা হোক, কিছু প্রতিবাদ-প্রতিরোধ বা প্রতিবন্ধকতা মোকাবিলা করতে হবে৷ কাজটি করতে হবে, ধীরস্থিরভাবে৷ আলোচনার মাধ্যমে জনগণকে আস্থায় নিতে হবে৷ জাপান-অ্যামেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জার্মানি....সব দেশেই কয়লা পুড়িয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়, সুতরাং বাংলাদেশেও হবে৷ এগুলো খুব ভালো যুক্তি নয়৷ পৃথিবীর প্রতিটি দেশের প্রেক্ষাপট, সুবিধা-অসুবিধা ভিন্ন৷ উদাহরণ দেয়া দেশগুলোর সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা আছে৷ সরকার যা বলে, জনগণ তা মোটামুটি বিশ্বাস করেন৷ সেসব দেশ অনেক বড়, অনেক খালি জায়গা আছে৷ বাংলাদেশে সরকারের কথা মানুষ বিশ্বাস করেন না, খালি জায়গাও নেই৷ সুতরাং অন্য দেশের সঙ্গে তুলনামূলক যুক্তি দিয়ে রামপাল প্রকল্প ‘জায়েজ' করা যাবে না৷
রামপাল প্রকল্পটি সরিয়ে নিতে হবে৷ তবে যেখানেই সরিয়ে নেয়া হোক, পরিবেশ দূষণ হবেই৷ বিদ্যুতের প্রয়োজনে সেই পরিবেশ দূষণ হয়ত মেনে নেয়া যাবে৷ কিন্তু বিদ্যুতের প্রয়োজনে সুন্দরবনের ক্ষতি মেনে নেয়া যাবে না৷
আপনি কি লেখকের সঙ্গে একমত? জানান আমাদের, লিখুন নীচের ঘরে৷