বিএনপিকে ‘নির্মূল করতেই’ কি এত মামলা?
২ এপ্রিল ২০১৯একটি দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে হাজার হাজার মামলা৷ সেসব মামলার অনেকগুলোর আসামি আবার অজ্ঞাত৷ মানে চাইলে যে কাউকেই সেসব মামলায় গ্রেপ্তার করা যেতে পারে৷ এভাবে মামলার পর মামলা দিয়ে দলটিকে কি ‘শেষ’ করে দেয়ার চেষ্টা হচ্ছে?
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর৷ দলটির শীর্ষ নেতা যখন ‘দুর্নীতির দায়ে’ কারাভোগ করছেন, আর ভবিষ্যতে যিনি দলটির হাত ধরবেন বলে ধারণা করা হয়, তিনি দেশান্তরী, তখন আলমগীরই যতটা সম্ভব দলটি ধরে রাখার চেষ্টা করছেন৷
বিএনপির এই মহাসচিব একজন সৎ রাজনীতিবিদ হিসেবে পরিচিত৷ চরম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও শান্ত থেকে নিজের দলকে ধরে রাখার চেষ্টা করেছেন তিনি৷ সংলাপের মাধ্যমে রাজনৈতিক সংকট থেকে উত্তরণের পথ বেছে নিয়েছিলেন আলমগীর৷ তাতে অবশ্য দলটির সংকট কাটেনি৷ বরং একাদশ সংসদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে বিএনপি ভুল করেছে বলে যাঁরা মনে করেন, তাঁরা এই ভুলের জন্য আলমগীরকেই দায়ী করেন৷
জাতীয় নির্বাচনের আগে থেকে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, অনেকে কারাভোগ করেছেন৷ খোদ মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বিরুদ্ধেও অন্তত ৪৬টি মামলা হয়েছে৷ তাঁর কাছে জানতে চেয়েছিলাম, আপনার দলের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে যে এত মামলা দেয়া হয়েছে, সেটার কারণ কী? জবাবটা তিনি এক কথাতেই দিয়েছেন: ‘বিএনপিকে সম্পূর্ণ নির্মূল করতে এত মামলা করা হয়েছে, হচ্ছে৷'
কিছুদিন আগেই গণমাধ্যমকে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জানিয়েছেন, গত এক দশকে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে প্রায় লাখখানেক মামলা দায়ের করা হয়েছে৷ এসবের আসামি ২৫ লাখের মতো মানুষ৷
আলমগীরের দেয়া এই পরিসংখ্যান স্বাধীনভাবে যাচাই করা সম্ভব হয়নি৷ তবে শুধু সর্বশেষ নির্বাচনের আগ অবধি একবছরের পত্রিকা ঘাঁটলেই দেখা যায় কীভাবে অসংখ্য মামলায় জড়ানো হয়েছে বিএনপির নেতা, কর্মী, সমর্থকদের৷ নির্বাচনের আগে পরিস্থিতি এমন হয়েছিল যে গ্রেপ্তারের ভয়ে অনেক বিএনপি প্রার্থীর পক্ষে রাজপথে নির্বাচনি প্রচারণা চালানোও সম্ভব হয়নি৷ শুধু প্রার্থী নন, সুযোগ পেলে তাদের আশেপাশের মানুষদেরও নানা মামলায় গ্রেপ্তারে কার্পণ্য করেনি পুলিশ৷ দলটির মোটামুটি পরিচিত নেতাকর্মীদের পক্ষে নির্বাচনের সময় নিজ বাড়িতে ঘুমানো পর্যন্ত সম্ভব হয়নি৷ এভাবে নির্বাচনের আগে রাজনীতির মাঠ মোটামুটি বিএনপি শূণ্য করে দিতে সক্ষম হয়েছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, যার পুরো সুবিধা পেয়েছে ক্ষমতাসীন দল৷
ঢাকায় নির্বাচনের আগের কয়েকদিন দেখেছি ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীরা হাজার হাজার কর্মী সমর্থক নিয়ে বর্ণাঢ্য নির্বাচনী মিছিল করছেন৷ তাদের পোস্টারে ঢেকে গিয়েছিল ঢাকা শহর৷ অথচ বিএনপির একটি পোস্টার অবধি খুঁজে পাওয়া ছিল দায়৷ ধানমন্ডি এলাকায় শুধু একটি রিকশায় একটি মাইকে করে বিএনপির এক প্রার্থীর পক্ষে প্রচারণা শুনেছিলাম, তাও খুব স্বল্প সময়ের জন্য৷
বাংলাদেশের অন্যতম বড় রাজনৈতিক দল বিএনপির নেতাকর্মীদের উপর এখন মামলার পাহাড় বলা যায়৷ মির্জা ফখরুল ইসলামের সঙ্গে শুক্রবার যখন ফোনে কথা হয়, তখন তিনি জানালেন বিএনপির বিরুদ্ধে যত মামলা করা হয়েছে তারমধ্যে পঁচিশ হাজারের মতো আছে ‘গায়েবি মামলা'৷ সেসব মামলায় আসামির সংখ্যাও লাখ দশেকের মতো হবে বলে মনে করেন তিনি৷ দলটির অনেক নেতাকর্মীর এখন সময় কাটে আদালতে হাজিরা দিয়ে আর আগাম জামিন নেয়া নিয়ে দৌড়াদৌড়ি করে৷
এসব গায়েবি মামলা নিয়ে গণমাধ্যমে অনেক প্রতিবেদন হয়েছে৷ মূলধারার পত্রিকাতেই খবর প্রকাশ হয়েছে যে অনেকগায়েবি মামলার অভিযোগগুলো প্রায় একইধরনের৷ কিন্তু বাস্তবে সেসব ঘটনা ঘটেছে এমন প্রমাণ নেই৷ ঢাকায় এরকম কয়েকটি ঘটনা অনসুন্ধান করে দেখেছেন সাংবাদিকরা৷ কিন্তু বাস্তবে এমনটা ঘটেছে, সে প্রমাণ পাওয়া যায়নি৷
শুধু তাই নয়, অনেক মামলায় এমন এমন ব্যক্তিদের আসামি করা হয়েছে যাঁরা ঘটনার সময় দেশে ছিলেন না, কিংবা তাঁরা শারীরিকভাবে কোনো ধরনের সহিংসতায় অংশ নিতে সক্ষম নয়৷ এমনকি মৃতব্যক্তিদেরও নানা মামলায় আসামি করার খবর গণমাধ্যমেই প্রকাশ হয়েছে৷
বলছি না বিএনপির সব নেতাকর্মী ধোয়া তুলসি পাতা৷ মানুষ পোড়ানোর রাজনীতি করার অভিযোগ অতীতে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে উঠেছিল, এখন বিএনপির বিরুদ্ধে উঠছে৷ এধরনের অপরাধ যে দলের সদস্যরাই করুক, তাদের বিচার হওয়া অত্যন্ত জরুরি৷ কিন্তু সেই অপরাধের পরিধি এতটাই বিস্মৃত নয়, যে লাখ লাখ মানুষ তার জন্য দায়ী হবেন৷ সুনির্দিষ্ট অপরাধের বিচার হোক, কিন্তু ‘গায়েবি মামলায়’ অসংখ্য মানুষকে যখন অপরাধী করার চেষ্টা করা হয় তখন সেটাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিতই মনে হয়৷
প্রিয় পাঠক, আপনার কি কিছু বলার আছে? লিখুন নীচের মন্তব্যের ঘরে৷