১৯৭৯ সালে আফগানিস্তানে যুদ্ধ শুরু হলে সোভিয়েত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য বাংলাদেশে থেকে যোদ্ধা পাঠানো শুরু হয় জিয়ার আমলে৷ এরশাদ ক্ষমতা দখলের পর সেটা অব্যহত থাকে এবং কয়েক হাজার বাংলাদেশি যুদ্ধে অংশ নেয়৷ যুদ্ধের শেষভাগে দেশের পাহাড়ি অঞ্চলে ঘাঁটি গড়ে যোদ্ধারা দেশি ও রোহিঙ্গা যুবকদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া শুরু করে৷
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়া ক্ষমতায় আসলেও আফগান যুদ্ধফেরত ব্যক্তিদের সকল তৎপরতা চলতে থাকে৷ প্রশিক্ষণ ঘাঁটিগুলোও বন্ধ করা হয়নি, বরং নতুন কিছু ঘাঁটি তৈরি হয়৷ যোদ্ধারা তাদের প্রাথমিক লক্ষ্য মিয়ানমারের বিরুদ্ধে নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের সাহায্য করার অবস্থান থেকে সরে এসে বাংলাদেশে ইসলামি বিপ্লবের স্বপ্ন দেখা শুরু করে৷ এক্ষেত্রে আফগানিস্থানে প্রাপ্ত সশস্ত্র যুদ্ধের অভিজ্ঞতা ও জিহাদি উদ্দীপনা কাজ করে৷
পরবর্তীতে শেখ হাসিনার শাসনামলে ১৯৯৯ সাল থেকে দেশে জঙ্গি হামলা শুরু হয়৷
খালেদার ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬
এক দশকে বাংলাদেশে বড় দুটি জঙ্গি সংগঠনের উত্থান ঘটে৷ এদের অন্যতম হচ্ছে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী বাংলাদেশ বা হুজিবি৷ অন্যটি জামায়াতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ (জেএমবি)৷
কোনো প্রতিবন্ধকতা ছাড়াই সংগঠন দুটি সারাদেশে শক্তিশালী নেটওয়ার্ক গড়ে তোলে৷ ধর্মের উগ্র এবং ধ্বংসাত্মক মতবাদ লালন করে দুটি দলই জিহাদের মাধ্যমে প্রচলিত শাসন ও বিচার ব্যবস্থাকে পালটে বাংলাদেশে ‘আল্লাহর আইন' প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সংঘবদ্ধভাবে তৎপরতা শুরু করে৷ সে সময়ের অনুকূল রাজনৈতিক ও সামাজিক অবস্থা সহায়ক ভূমিকা রাখে৷
১৯৯২ সালের ৩০ এপ্রিল খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি সরকার গঠন করার প্রায় বছরখানেকের মাথায় যোদ্ধাদের কয়েকজন জাতীয় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন করে নিজেদের হুজিবি হিসেবে পরিচয় দেয়৷ সংগঠনটি এভাবেই রাজধানী থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু হয়৷
খালেদা জিয়ার পুরো মেয়াদে হুজিবি তার কর্মকাণ্ড চালাতে থাকে৷ অনেকটা অবাধে এবং প্রকাশ্যে প্রচার-প্রচারণা, সদস্য সংগ্রহ ও এমনকি সামরিক কায়দায় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দেশে নেটওয়ার্ক বিস্তার করে এবং হামলা করার সক্ষমতা অর্জন করে৷
হুজির সামরিক প্রশিক্ষণগুলো হতো মিয়ানমার সীমান্তবর্তী পাহাড়ি অঞ্চলে৷ ১৯৯৬ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি কক্সবাজারের উখিয়া থানার পাইনখালী গ্রামসংলগ্ন লুণ্ডাখালীর জঙ্গলে সশস্ত্র প্রশিক্ষণরত ৪৩ জঙ্গিকে অস্ত্র, বিস্ফোরক ও সামরিক পোশাকসহ আটকের ঘটনা যার অন্যতম উদাহরণ৷
১৫ ফেব্রুয়ারির বিতর্কিত জাতীয় নির্বাচন ঘিরে দেশব্যাপী আওয়ামী লীগের সহিংস রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে জঙ্গি আটকের সবচেয়ে বড় ঘটনাটি চাপা পড়ে যায়৷
হাসিনার ১৯৯৬ থেকে ২০০১
উখিয়ার ঘাঁটি থেকে আটক হুজিবি সদস্যদের আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়৷ তবে কিছুদিনের মধ্যে উচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে তারা পুনরায় জঙ্গি কর্মকাণ্ডে যোগদান করে৷ এর ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের জানুয়ারি থেকে হুজিবি দেশে হামলা শুরু করে৷
আর জেএমবির যাত্রা শুরু এর নয় মাস আগে ১৯৯৮ সালের এপ্রিলে৷
হুজির সাথে যুক্ত হতে ব্যর্থ হয়ে জামালপুরের মাওলানা মোঃ আব্দুর রহমান একটি বাহিনী গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয়৷ জিহাদের মাধ্যমে বাংলাদেশে শরিয়া মোতাবেক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করার লক্ষ্যে দলটি গঠন করে আব্দুর রহমান, পরবর্তীতে যিনি শায়খ আব্দুর রহমান নামে পরিচিত হন৷
হুজির সাথে পাল্লা দিতে জেএমবিও তৎপরতা চালাতে শুরু করে এবং ২০০১ সালে শায়খের নিজ জেলায় ধর্মান্তরিত দুই যুবককে হত্যার মধ্য দিয়ে হামলা শুরু করে৷
হামলা করে জঙ্গিরা, ফাঁসানো হয় রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে
১৯৯৯ এর জানুয়ারি মাসে ঢাকার শ্যামলীর বাসায় হুজিবি প্রথম হামলা চালিয়ে কবি শামসুর রহমানকে হত্যার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়৷ তবে দুই মাস পরেই ১৯৯৯ সালের ৬ জুন জঙ্গি সংগঠনটি যশোরে শিল্পীগোষ্ঠী উদীচীর অনুষ্ঠানে বোমা হামলা করলে ১০ নিহত ও শতাধিক আহত হয়৷ এটাই ছিল হুজিবির প্রথম সফল হামলা৷
হামলা কারা, কী উদ্দেশ্যে করেছে তা সঠিকভাবে তদন্ত করে বের করার পরিবর্তে আওয়ামী লীগ সরকার বিএনপি নেতা তরিকুল ইসলামসহ বিএনপি ও এর অঙ্গ সংগঠনের ২৩ জনের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে বোমা হামলার অভিযোগে মামলা করে৷
২০০১ সালে বিএনপি ক্ষমতায় আসার আগ পর্যন্ত তাদের আটক ও হয়রানি করা হয়৷
২০০২ সালে ময়মনসিংহ শহরের চারটি ছিনেমা হলে জেএমবি একযোগে বোমা হামলা করে ২১ জন নিরীহ মানুষকে হত্যা করে৷ ক্ষমতাসীন বিএনপিও আওয়ামী লীগের পথ অনুসরণ করে৷ এই হামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে সাবের হোসেন চৌধুরীসহ আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনের ৩১ নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়৷ তাদের আটক করে রিমান্ডে নির্যাতন করা হয়৷
সে সময় অধিকাংশ জঙ্গি ঘটনা নিয়ে দল দুটি এমন নোংরা রাজনীতির খেলা খেলেছে৷ সঠিক তদন্তের মাধ্যমে সত্যিকার হামলাকারীদের ধরে বিচারের মুখোমুখি না করে দলদুটি একে অপরকে দোষারোপ করে৷
অবশেষে কঠোর অবস্থান
খালেদা জিয়ার দ্বিতীয় মেয়াদে (২০০১-২০০৬) জঙ্গিরা ভয়ংকর রূপ ধারণ করে৷ বিভিন্ন স্থানে হামলা চালালেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া দূরের কথা বরং অনেক ক্ষেত্রেই প্রচ্ছন্নভাবে আশ্রয় ও প্রশ্রয় দেয়া হয়৷ ফলে হামলার মাত্রা বাড়তেই থাকে৷
সশস্ত্র হামলা ছাড়াও সে সময় জঙ্গিরা কয়েকটি এনজিও প্রতিষ্ঠান ও ব্যাংকের শাখায় অভিযান চালিয়ে লুট করে৷ তারা মাজারেও হামলা করে মানুষ হত্যা করে৷ বেশ কয়েকবার জঙ্গিরা পুলিশের উপর হামলা করে৷ কিন্তু বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার থাকে নির্বিকার৷
তবে সবকিছুকে ছাড়িয়ে যায় যখন ২০০৪ সালে বাংলা ভাইয়ের নেতৃত্বে জেএমবি রাজশাহী, নাটোর ও নওগাঁর বড় এক অঞ্চল জুড়ে তাদের আধিপত্য বিস্তার করে৷ প্রকাশ্যে মানুষদের ধরে পিটিয়ে হত্যা করলেও সে সময় পুলিশ ও প্রশাসন নীরব ভূমিকা পালন করে৷ বিএনপি-জামায়াত সরকারের প্রচ্ছন্ন সহায়তাও পায় তারা৷
ব্যাপক সমালোচনার পরও বাংলা ভাইকে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে অভিহিত করে সরকার৷ আটক না করে তাদের ছাড় দেয়া হয়৷ ফলে জঙ্গি সংগঠনটি সাড়া দেশে হামলার পরিকল্পনা করে৷
২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযোগে বোমা হামলা চালানো হয়৷ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা না নেয়ায় দেশে ও দেশের বাইরে জোট সরকারের কঠোর সমালোচনা হয়৷ এরপর র্যাব-পুলিশ সাঁড়াশি অভিযান চালিয়ে জঙ্গি নেতাদের আটক করা হয়৷ পরবর্তীতে সেনা সমর্থিত সরকারের আমলে তাদের ফাঁসি হয়৷
এই প্রথম জঙ্গি দমনে সরকার ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী আগ্রাসী নীতি অবলম্বন করে৷
হোলি আর্টিজান হামলা পূর্ববর্তী অসহায় অবস্থা
২০০৬ সালের পর জঙ্গিরা আত্মগোপনে চলে যায় এবং কয়েক বছর প্রস্তুতি নিতে থাকে৷ অপেক্ষায় থাকে সময় ও সুযোগের৷ বিএনপির সরকারবিরোধী আন্দোলন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার, আন্তর্জাতিক অঙ্গনে নতুন জঙ্গি সংগঠন আইএস-এর উত্থান সব মিলিয়ে জঙ্গিরা নতুন কৌশলে তাদের তৎপরতা শুরু করে ২০১৩ শুরুতে৷ অস্ত্র, গোলাবারুদ ব্যবহারে এবার তারা আরও পারদর্শী৷ প্রযুক্তি এনে দেয় বড় সুবিধা৷
সে বছরের ফেব্রুয়ারি থেকে আল কায়েদা ও আইএস-এর আদর্শে উজ্জীবিত জঙ্গিরা দেশে একের পর এক হামলা চালায়৷ কিন্তু আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সে হামলা রুখতে ব্যর্থ হয়৷ কারা, কীভাবে পরিকল্পিতভাবে হামলা করে মানুষ হত্যা করছে তা উৎঘাটনে ব্যর্থ হয়ে সরকার ও পুলিশ এক রকম অসহায় হয়ে পড়ে৷
জঙ্গিদের এমন পুনরুত্থান ঘটবে তা কেউ কল্পনা করেনি৷ তাই জঙ্গিদের দমনের ইচ্ছা থাকলেও সরকার ও পুলিশ বাহিনী সে সময় কিছুই করতে পারেনি৷ কেননা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদ দমনে যে প্রস্তুতি, জ্ঞান ও প্রশিক্ষণ থাকার দরকার, তা ছিল না৷
হোলি আর্টিজান হামলা পরবর্তী ধরো, মারো নীতি
২০১৬ সালের জুলাই মাসে দেশের ইতিহাসে বড় সন্ত্রাসী হামলার পর সরকার ও পুলিশ বাহিনী জঙ্গিদের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক অভিযান শুরু করে৷ একের পর এক জঙ্গিদের গোপন আস্তানা আবিষ্কার হয় এবং অভিযানে শতাধিক জঙ্গির মৃত্যু হয়, আটক হয় কয়েক হাজার৷
পুলিশ ও র্যাবের সক্ষমতা আশ্চর্যজনকভাবে বেড়ে যায়৷ হামলার আগেই জঙ্গিদের আটক করতে সমর্থ হয়, বা জঙ্গিরা অভিযানে মারা যায়৷ ফলে ২০১৬ সালের জুলাইয়ের পর থেকে দেশে আর বড় কোনো জঙ্গি হামলা হয়নি৷
এমন আগ্রাসী নীতির ফলে সরকার জঙ্গি দমনে সফলতা পেলেও এই নীতি সাময়িক সাফল্য আনে মাত্র৷ দীর্ঘ মেয়াদে এর ফাল ভালো হয় না৷ কেননা, কেবলমাত্র শক্তি প্রয়োগ করে কোনো আদর্শকে নির্মূল করা সম্ভব নয়৷
এজন্য অনেক দেশ সামাজিক-সাংস্কৃতিক কর্মসূচি গ্রহণ করেছে, যেখানে কমিউনিটির সকলকে সম্পৃক্ত করে এমন সব কাজ করা হয় যেন মানুষ জঙ্গিবাদে না জড়ায়৷ আর যারা জড়িয়ে পড়ে যাদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনতেও থাকে বিশেষ কর্মসূচি৷
তবে এক দশক ধরে আলোচনা করলেও বাংলাদেশে সরকারের পক্ষে এমন পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয়নি৷ ফলে একদিকে যেমন মানুষ জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়ছে অন্যদিকে যারা জড়িত হয়েছে তাদের সে পথ থেকে ফিরিয়ে আনারও কোনো উপায় থাকছে না, যার পরিণাম ভালো হবে না৷