বাংলাদেশের শিক্ষা কমিশন ও শিক্ষানীতি
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল৷ বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদা এর প্রধান ছিলেন৷
বাংলাদেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞানী ড. কুদরাত-ই-খুদাকে চেয়ারম্যান করে দেশের প্রথম শিক্ষা কমিশন গঠিত হয়েছিল৷ কুদরত-ই-খুদা কমিশন নামে পরিচিতি পাওয়া এই কমিশন ১৯৭৪ সালে রিপোর্ট পেশ করেছিল৷ এতে শিক্ষার সবস্তরে ধর্মনিরপেক্ষ শিক্ষাব্যবস্থা চালু এবং কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছিল৷
উল্লেখযোগ্য সুপারিশ
প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে বড় ধরনের পরিবর্তনের সুপারিশ করেছিল কুদরত-ই-খুদা কমিশন৷ প্রাথমিক শিক্ষার মেয়াদ প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত এবং মাধ্যমিক শিক্ষার মেয়াদ নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার সুপারিশ করেছিল৷ উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে একটি চার বছর মেয়াদি সম্মিলিত ডিগ্রি কোর্স এবং এক বছরের মাস্টার্স কোর্স চালুর সুপারিশ করা হয়েছিল৷
কমিটি গঠন
কুদরত-ই-খুদা কমিশনের সুপারিশের আলোকে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও সিলেবাস প্রণয়নের জন্য অধ্যাপক সামছুল হুদাকে প্রধান করে ১৯৭৬ সালে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল৷ কমিটি ১৯৭৬, ১৯৭৭ এবং ১৯৭৮ সালে সাত খণ্ডে সরকারের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছিল৷ সুনির্দিষ্টভাবে একমুখী ও সমরূপ মাধ্যমিক শিক্ষা পদ্ধতি প্রবর্তনের সুপারিশ করেছিল ঐ কমিটি৷
মজিদ খান শিক্ষা কমিশন, ১৯৮২
এরশাদ সরকারের শিক্ষা উপদেষ্টা ড. আবদুল মজিদ খানের নেতৃত্বাধীন শিক্ষা কমিশন ১৯৮২ সালে একটি শিক্ষা নীতি প্রস্তাব করেছিল৷ এতে প্রথম শ্রেণি থেকে বাংলার সঙ্গে আরবি ও দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে ইংরেজি ভাষা বাধ্যতামূলক করার কথা বলা হয়৷ এছাড়া যারা ৫০ শতাংশ ব্যয় বহন করতে পারবে, ফল খারাপ হলেও তাদের উচ্চশিক্ষার সুযোগ দেওয়ার কথা বলা হয়েছিল৷ কিন্তু পরে তীব্র আন্দোলনের কারণে কমিশনের কোনো সুপারিশ বাস্তবায়ন করা হয়নি৷
মফিজউদ্দীন আহমদ শিক্ষা কমিশন, ১৯৮৭
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর মফিজউদ্দীন আহমদকে প্রধান করে ১৯৮৭ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়৷ তাদের রিপোর্টে তিন বছর মেয়াদি ডিগ্রি কোর্স এবং দুই বছরের মাস্টার্স কোর্স প্রবর্তন এবং ডিগ্রি কলেজগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও শিক্ষার সুযোগ সম্প্রসারণের সুপারিশ করা হয়৷ এছাড়া বড় জেলা, বিভাগীয় শহর ও রাজধানীতে একটি করে কলেজকে বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছিল৷
শামসুল হক শিক্ষা কমিশন, ১৯৯৭
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক এম শামসুল হককে চেয়ারম্যান করে ১৯৯৭ সালে একটি শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়৷ শিক্ষার্থীদের মধ্যে নৈতিক, মানবিক, ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক মূল্যবোধ গড়ে তোলার ক্ষেত্রে সহায়তা দান, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় তাদের অনুপ্রাণিত করার কথা বলেছিল ঐ কমিশন৷ এছাড়া কমিটি একটি শিক্ষানীতিও প্রণয়ন করেছিল, যেটি ২০০০ সালে সংসদে গৃহীত হয়৷ কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি৷
এম.এ বারী শিক্ষা কমিশন, ২০০১
ড. এম এ বারীর নেতৃত্বাধীন এই কমিটি ২০০২ সালে রিপোর্ট পেশ করে শিক্ষাক্ষেত্রে কতিপয় সংস্কার ও পরিবর্তনের সুপারিশ করে৷ এসব সুপারিশ ২০০৩ সালে মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বে গঠিত শিক্ষা কমিশন কর্তৃক বিবেচনায় আনা হয়৷
মনিরুজ্জামান শিক্ষা কমিশন, ২০০৩
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর অধ্যাপক মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মিয়ার নেতৃত্বাধীন এই কমিশনের রিপোর্ট তিন ভাগে বিভক্ত ছিল: সাধারণ শিক্ষা, পেশাগত শিক্ষা, বিশেষায়িত শিক্ষা৷ ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, লিঙ্গ, আর্থিক অবস্থা ও ভৌগোলিক অবস্থানের পার্থক্য নির্বিশেষে সবার জন্য শিক্ষালাভের সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং গ্রামাঞ্চলে শিক্ষার অধিকতর সুযোগ সৃষ্টির সুপারিশ করেছিল৷
কবির চৌধুরী শিক্ষা কমিশন, ২০০৯
২০০০ সালের শিক্ষানীতিকে সময়োপযোগী করার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে জাতীয় অধ্যাপক কবির চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠন করা হয়৷ এই কমিটি ১৯৭৪ সালের কুদরাত-ই-খুদা কমিশন রিপোর্ট এবং ১৯৯৭ সালের শামসুল হক শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের আলোকে একটি নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন করে৷ সেটি ২০১০ সালে সংসদে গৃহীত হয়৷
বাস্তবায়ন কত দূর?
শিক্ষানীতিতে বলা হয়েছিল, প্রাথমিক শিক্ষা পঞ্চম শ্রেণির বদলে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত হবে৷ কিন্তু সেটি হয়নি৷ মাধ্যমিক শিক্ষা নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত করার কথা বলা হয়েছিল৷ এজন্য উচ্চবিদ্যালয়গুলোতে একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণি সংযোজন করার কথা থাকলেও তা বাস্তবায়ন করা হয়নি৷ শিক্ষকদের জন্য পৃথক বেতনকাঠামো হয়নি৷ শিক্ষক নিয়োগে পিএসসির মতো কমিশন হয়নি৷ শিক্ষা আইন হয়নি৷ স্থায়ী শিক্ষা কমিশনও হয়নি৷
নতুন শিক্ষাক্রম
শিক্ষার্থীদের মূল্যায়ন ব্যবস্থায় বড় পরিবর্তন এনে প্রাক-প্রাথমিক থেকে উচ্চমাধ্যমিক স্তরের নতুন শিক্ষাক্রমের রূপরেখা ২০২২ সালে অনুমোদিত হয়৷ এরপর এ বছর থেকে প্রথম, দ্বিতীয়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এর বাস্তবায়ন শুরু হয়েছে৷ ২০২৪ সালে তৃতীয়, চতুর্থ, অষ্টম ও নবম শ্রেণিতে; ২০২৫ সালে পঞ্চম ও দশম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে৷ একাদশ শ্রেণিতে ২০২৬ সালে ও দ্বাদশ শ্রেণিতে ২০২৭ সালে নতুন শিক্ষাক্রম চালু হবে৷
কী আছে?
নতুন শিক্ষাক্রমে পরীক্ষার চেয়ে ধারাবাহিক মূল্যায়ন (শিখনকালীন) বেশি হবে৷ তৃতীয় শ্রেণি পর্যন্ত কোনো পরীক্ষা হবে না, পুরোটাই মূল্যায়ন হবে সারা বছর ধরে চলা বিভিন্ন রকমের শিখন কার্যক্রমের ভিত্তিতে৷ পরবর্তী শ্রেণিগুলোর মূল্যায়নের পদ্ধতি হিসেবে পরীক্ষা ও ধারাবাহিক শিখন কার্যক্রম দুটোই আছে৷
দশম পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাস
শিক্ষার্থীরা দশম শ্রেণি পর্যন্ত অভিন্ন সিলেবাসে পড়বে৷ আর তারা বিজ্ঞান, মানবিক, না বাণিজ্য বিভাগে পড়বে, তা ঠিক হবে একাদশ শ্রেণিতে গিয়ে৷ এছাড়া এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষার ধরণ এখনকার মতো হবে না৷ শুধু দশম শ্রেণির পাঠ্যসূচির ভিত্তিতে হবে এসএসসি পরীক্ষা৷ একাদশ ও দ্বাদশ শ্রেণিতে দুটি পরীক্ষা হবে৷ প্রতি বর্ষ শেষে বোর্ডের অধীনে এই পরীক্ষা হবে৷ এরপর দুই ফলের সমন্বয়ে এইচএসসির চূড়ান্ত ফল প্রকাশ করা হবে৷
শেখার ক্ষেত্র
নতুন শিক্ষাক্রমে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দশম শ্রেণি পর্যন্ত ১০ ধরনের শেখার ক্ষেত্র ঠিক করা হয়েছে৷ এগুলো হলো ভাষা ও যোগাযোগ, গণিত ও যুক্তি, জীবন ও জীবিকা, সমাজ ও বিশ্ব নাগরিকত্ব, পরিবেশ ও জলবায়ু, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি, শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য এবং সুরক্ষা, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা এবং শিল্প ও সংস্কৃতি৷ প্রাক-প্রাথমিকের শিশুদের জন্য আলাদা বই থাকবে না, শিক্ষকেরাই শেখাবেন৷
জেডএইচ/কেএম (বাংলাপিডিয়া, প্রথম আলো)