বাংলাদেশের দাবি টেকসই ও সহজলভ্য জলবায়ু অর্থায়ন
৫ নভেম্বর ২০২১স্কটল্যান্ডের গ্লাসগোতে জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ২৬-এর শুরুতে এভাবেই চোখের সামনে বদলে যেতে শুরু করা পৃথিবীর বর্ণনা করেছে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থা-ডাব্লিউএমও৷
২০২১ সালের ‘দ্য স্টেট অব দ্য ক্লাইমেট রিপোর্ট'এ- ডাব্লিউএমও ২০০২ সাল থেকে গত ২০ বছরের গড় তাপমাত্রা হিসাব করে দেখিয়েছে৷ ৩১ অক্টোবর প্রকাশিত ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পৃথিবীর তাপমাত্রা এবারই প্রথম প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বেড়ে যাওয়ার পথে রয়েছে৷ সমুদ্রপৃষ্ঠও এ বছর পৌঁছেছে নতুন উচ্চতায়৷ ২০১৩ সাল থেকে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা টানা বাড়ছে৷
উষ্ণায়নের কারণে পৃথিবীর জলবায়ু বদলে যাওয়ার পেছনে অনুঘটক হিসেবে যেসব জিনিস কাজ করছে তার অন্যতম গ্রিনহাউজ গ্যাস৷ বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউজ গ্যাসের ঘনত্ব রেকর্ড পর্যায়ে পৌঁছে যাওয়ায় এ বছরসহ গত সাত বছরে পৃথিবীর তাপমাত্র্রা আগের সব রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে৷
শিল্পোন্নত ধনী চার দেশ (চীন, যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ভারত৷ সঙ্গে আছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন) মূলত বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরণের জন্য দায়ী৷ অথচ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলা করতে হচ্ছে অনুন্নত বা স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে৷
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ ১০-এ রয়েছে বাংলাদেশের নাম৷ এবারের সম্মেলনে সবথেকে ঝুঁকিপূর্ণ ৪৮ দেশের জোট ‘ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরাম সিভিএফ-এর সভাপতিত্ব করছে বাংলাদেশ৷
গত ১ নভেম্বর গ্লাসগোয় কপ২৬-এর মূল অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জয়বায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় নিজেদের দাবি-দাওয়ার কথা তুলে ধরেন৷
প্রধানমন্ত্রী হাসিনা বলেন, যেসব উন্নত দেশ বায়ুমণ্ডলে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের জন্য মূলত দায়ী, তাদেরকে উচ্চাভিলাষী এনডিসি (ন্যাশনাল ডিটারমিন্ড কন্ট্রিবিউশন) প্রণয়ন এবং তা বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে৷
#এছাড়া, জলবায়ুর ক্ষতি কাটাতে উন্নত দেশগুলোর প্রতিশ্রুত বার্ষিক ১০০ কোটি ডলারের তহবিল গঠন এবং অভিযোজন ও প্রশমনে তা আধাআধি বরাদ্দ করতে হবে৷
#সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে সাশ্রয়ী মূল্যে পরিচ্ছ্ন্ন ও সবুজ প্রযুক্তি প্রদাণ এবং সিভিএফ দেশগুলোর উন্নয়নে সহায়তার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনা করা৷
#সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী ভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে বাস্তুচ্যুত জলবায়ু অভিবাসীদের জন্য বিশ্বব্যাপী দায়বদ্ধতা ভাগ করে নেওয়াসহ লোকসান ও ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে উঠার বিষয়টি অবশ্যই সমাধান করার দাবি জানান তিনি৷
গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশনের প্রধান নির্বাহী প্যাট্রিক ভারকুইজেনের সঙ্গে এক যৌথ নিবন্ধেও এসব বিষয় নিয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন তিনি৷
যেভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বাংলাদেশ
বিশ্ব ব্যাংকের তথ্যানুযায়ী, গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশের তাপমাত্রা ০ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে৷ এভাবে বড়লে ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের তাপমাত্রা ১ দশমিক ৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে৷
বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির ফলে পৃথিবীর উত্তরগোলার্ধে বরফ গলছে, বাড়ছে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা৷ ফলে দক্ষিণের অনেক দ্বীপ দেশ তলিয়ে যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে৷ বাংলাদেশের উপকূলীয় এলাকাও সেই ঝুঁকিতে৷ এইসঙ্গে উপকূলীয় এলাকায় লবণাক্ততা বাড়ছে৷ চাষাবাদের অনুপযোগী হয়ে পড়ছে কৃষিজমি৷
বাংলাদেশের দক্ষিণের জেলা বাগেরহাটের কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যানুযায়ী ২০০৭ সালের ঘূর্ণিঝড় সিডরে জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হওয়ার পর ওই এলাকায় লবণাক্ততা অস্বাভাবিকহারে বেড়ে যায়৷ নিয়মিত জোয়ারের পানি ঢোকায় অনেক এলাকায় এখন স্থায়ী জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে৷ মাটি অতিরিক্ত লবণাক্ত হয়ে পড়ায় তা কৃষিকাজের অনুপযোগী হয়ে পড়েছে৷
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশের মানুষ গ্রীষ্ম দীর্ঘায়িত হতে দেখছে, তাপমাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি৷ শীতকালেও গড় তাপমাত্রা বেশি থাকছে৷ বর্ষা প্রলম্বিত হয়ে ফেব্রুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত গড়াচ্ছে, যার ফলে বন্যা ও নদী ভাঙনের মতো দুর্যোগ বাড়ছে, ঘূর্ণিঝড়ের তীব্রতাও বাড়ছে৷
নদী ভাঙনের শিকার ফরিদপুরের চরভদ্রাসনের বাসিন্দা মো. সেলিম মা-বাবা, ভাই-বোন এবং অন্তঃস্বত্তা স্ত্রীকে নিয়ে প্রায় এক মাস ধরে স্থানীয় একটি স্কুলে আশ্রয় নিয়ে আছেন৷
পেশায় রাজমিস্ত্রি সেলিমের পরিবার আরো দুইবার নদী ভাঙনের শিকার হয়েছেন৷ তিনি ডয়চে ভেলেকে বলেন, ১৯৯৮ সাল প্রথম নদী তাদের ঘরবাড়ি ভেঙে নিয়ে যায়৷ ১০/১২ বছর আগে আরো একবার নদী ভাঙনে বাড়ি-ঘর সব হারিয়েছিল সেলিমের পরিবার৷ নতুন করে যেখানে বসত গড়েছিলেন, এবার সেই ভিটাও নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে৷ আর কোনো জমি না থাকায় এখন পরিবার নিয়ে স্কুল ঘরে আশ্রয় নিয়েছেন তিনি৷
বলেন, ‘‘আগুনে পুড়লে তবু ভিটামাটি থাকে, নতুন করে ঘর তৈরি করে নেয়া যায়৷ কিন্তু নদীতে ভাঙলে কিছুই থাকে না৷’’
পৃথিবীর তাপমাত্রার বিপদজনক বৃদ্ধি আটকাতে ২০১৫ সালে বিশ্বের প্রায় দুইশ দেশ একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হয় যা এখন প্যারিস জলবায়ু চুক্তি নামে পরিচিত৷ ওই চুক্তিতে বিশ্বনেতারা বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা বৃদ্ধি প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে আটকে রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের বিষয়ে একমত হন৷
এজন্য চুক্তিভুক্ত দেশগুলো, বিশেষ করে শিল্পোন্নত দেশ তাদের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা অনেক কমিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেন৷ কিন্তু কার্যত সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষায় উল্লেখ করার মতো পদক্ষেপ এখনো কোনো দেশই নেয়নি৷
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার ভাষণে প্যারিস জলবায়ু চুক্তির কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে বিশ্ব নেতাদের প্রতি নিজেদের প্রতিশ্রুতি পূরণের আহ্বান জানিয়েছেন৷
প্যারিস জলবায়ু চুক্তিতে উন্নত দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের মতো ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে সহায়তা দিতে বছরে যে ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তহবিল গঠনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তা এখনো আলোর মুখ দেখেনি৷
একে দুর্ভাগ্যজনক বলে বর্ণনা করেছেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী৷ তিনি বলেন, ‘‘পর্যাপ্ত, টেকসই ও সহজলভ্য জলবায়ু অর্থায়ন ছাড়া কার্যকর কর্মপরিকল্পনা সম্ভব নয়৷’’
জলবায়ু পরিবর্তনের ভয়ঙ্কর পরিণাম থেকে পৃথিবীকে রক্ষা করতে প্যারিস জলবায়ু চুক্তি বাস্তবায়নে কমনওয়েলথ ও সিভিএফ-কে একসঙ্গে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি৷ সিভিএফ-এর পক্ষ থেকে বাংলাদেশ একটি জরুরি জলবায়ু চুক্তি করার চেষ্টাও করছে৷
প্যারিস জলবায়ু চু্ক্তির বাস্তবায়ন নেই৷ এবারের সম্মেলনেও নানা প্রতিশ্রুতি আসছে, আসবে৷ সেগুলো কতটা পূরণ হবে, পৃথিবীকে বাসযোগ্য রাখতে কে কতটা ভূমিকা পালন করবে সেটা ভবিষ্যতই বলে দেবে৷