1. কন্টেন্টে যান
  2. মূল মেন্যুতে যান
  3. আরো ডয়চে ভেলে সাইটে যান

বডি শেমিং রয়ে গেছে সারা দুনিয়াতেই

মোস্তফা মামুন
১ এপ্রিল ২০২২

আমাদের মধ্যে শফিকের পেট ছিল একটু বড়৷ একটু মানে বেশ বড়৷ তার শার্ট পেটে আটকে থাকত, প্যান্ট পড়ে থাকত কোমরের নীচে৷

https://p.dw.com/p/49JeV
Symbolbild Ernährung & Übergewicht
ছবি: Dominic Lipinski/empics picture alliance

শফিক গাছে চড়তে পারত না, দৌড়াতে গেলে সবার পেছনে পড়ে যেত৷ এসব নিয়ে তার বিশেষ কোনো সমস্যা ছিল না৷ সমস্যা ছিল অন্যদের৷ শফিক যে নানা স্বাভাবিক কাজে ব্যর্থ হচ্ছে সেটা বাকিদের জন্য এত আনন্দের ছিল যে মনে হত, শফিকের পেট বড় হওয়ার ব্যাপারটা ঘটেইছে অন্যদের তৃপ্তির জন্য৷

শৈশব থেকে এসব দেখতে দেখতে শফিকের মধ্যে অভ্যস্ততা তৈরি হয়ে গিয়েছিল৷ সে ধরেই নিয়েছিল, সবাই ওকে পেটলা বলবে, ওর পেট নিয়ে হাসাহাসি করবে৷ একবার একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল৷ ঢাকা থেকে ট্রান্সফার হয়ে আসা একটা ছেলে স্কুলে ভর্তি হয়ে শফিকের দিকে হাত বাড়িয়ে জানতে চাইল, ‘বন্ধু তোমার নাম কি?’
শফিক বিস্মিত হয়ে হাত বাড়াতে ভুলে গেল৷
ছেলেটি হাসে, ‘তোমার কি নাম নেই নাকি?’
‘আছে৷ শফিক৷’
ছেলেটি নিজের নাম বলল৷ আরও কিছু কিছু কথা হল তাদের৷ আর শফিক কান্নায় ভেঙে পড়ল৷
শফিক যেমনই হোক আমাদের পুরনো বন্ধু, ওকে কাঁদিয়েছে মানে বিরাট অপরাধ৷ বিহিত করাটা দায়িত্ব মনে হল আমাদের৷
ছেলেটাকে ধরা হল, ‘এই তুমি শফিককে কী বলেছ?’
‘কী আবার বলব?’
‘তাহলে শফিক কাঁদছে কেন?’
‘শফিক কাঁদছে?’ সে অবাক৷
আমরা ছুটলাম শফিকের কাছে৷ সুনির্দিষ্ট অভিযোগ জানতে৷ শফিক আমাদের কথা শুনে আবার কাঁদতে শুরু করল৷ একজন অভয় দিয়ে বলল, ‘বল কী বলেছে তোকে৷ তোকে কোনো খারাপ কথা বলেছে?’
‘না৷’ শফিক কান্নাভেজা চোখে বলে৷
‘তাহলে মেরেছে৷’
‘তা-ও না৷’
‘তাহলে?’
‘আমার পেট নিয়ে কোনো কথা বলেনি৷ শুধু আমার নাম জানতে চেয়েছে৷’
এটা কী করে কান্নার কারণ হয় বুঝতে না পেরে আমরা একটু হতবুদ্ধি৷ শফিক বলে, ‘জীবনে এই প্রথম কেউ আমার পেটের কথা জিজ্ঞেস করার আগে আমার নাম জিজ্ঞেস করেছে৷ এই প্রথম..’
শফিক আবার কান্নায় ভেঙে পড়ে৷ সেই কিশোর বয়সে আমাদের কাছে বিষয়টা গোলমেলে লাগে৷
রহস্যভেদে নতুন ছেলের কাছে আবার গেলাম৷ বিব্রত কৌতূহলে জিজ্ঞেস করি, ‘এই তুমি শফিকের পেট দেখোনি?’
‘দেখেছি তো৷’
‘তাহলে কেন এই নিয়ে একটা কথাও বলোনি৷’
ছেলেটি একটু ভাবে৷ তারপর বলে, ‘কারো সে-ই খারাপ জিনিস নিয়ে কথা বলতে নেই, যেটার জন্য সে নিজে দায়ী নয়৷’
‘মানে কী? আমরা তো মজা করি৷’
‘এসব নিয়ে মজা করতে নেই৷ আমাদের সামান্য মজা ওর জন্য অনেক কষ্টের৷’
‘কিন্তু শফিক তো কষ্ট পায় না৷ সে তো কোনোদিন বলেনি৷’
‘বললে কেউ শুনবে না বলে বলে না৷ তখন আমরা আরও হাসাহাসি করবে বলে উপায় না দেখে নিজেও উপভোগের ভান করে৷ আসলে কষ্ট লুকায়৷’
ছেলেটা আমাদেরই বয়সী৷ কিন্তু কথাগুলো কেমন যেন বড়দের মতো৷ ও এসব শিখল কোত্থেকে৷
বলল, ‘আমার কাকা বলেছেন৷ উনি ভার্সিটিতে পড়েন৷’

কারও পেট, যে পেটটা সত্যিই হাসাহাসির যোগ্য, তা নিয়ে একটু মজা করা কী করে অন্যায় হয় সেটা তখনও স্পষ্ট হয় না৷ তবু ভার্সিটিতে পড়া কাকার বিষয়টা মাথায় লাগে৷ এমন একজন শিক্ষনীয় কাকা সঙ্গে থাকলে বোধহয় অনেক কিছু একটু বেশি জানা যায়৷
বডি শেমিং, অন্যের শারীরিক অসঙ্গতি নিয়ে কথা বলা যে বড় রকমের অপরাধ সেটা আমরা আসলে ধরতেই পারি না৷ পারিবারিক বা সামাজিকভাবে অন্য কিছুর তুলনায় এটাকে এত ছোট অপরাধ বলে দেখা হয় যে ধরিয়ে দেয়ার কথা করো মনেই থাকে না৷ আমাদের পরিবার শেখায়, মিথ্যা বলা অপরাধ, অন্যের জিনিস না বলে নেয়া অপরাধ এবং আরো অনেক কিছু কিন্তু কারো শারীরিক অসঙ্গতি নিয়ে তাচ্ছিল্য না করার শিক্ষাটা কি সেভাবে দেয়া হয়! হয় না বলে ব্যাপারটা সামাজিকভাবে গৃহীত হয়ে যায়৷ এটাকে দুষনীয় ভাবার সামগ্রিক বোধটাই তৈরি হয় না৷ শফিকরা তাই এসব মেনে নিয়েই বড় হয়৷ কষ্ট জমে বুকে৷ সেজন্যই কি না অস্কারের মতো আয়োজনে সেদিনের দৃশ্যটা দেখলে দেখবেন উইল স্মিথের স্ত্রী পিংকেট রসিকতাটা একদম উপভোগ করছিলেন না৷ বোঝা যায়, এই চুল কমে যাওয়ার বিষয়টা নিয়ে নানারকম কথা হয় বলে সেটা তার অস্বস্তির জায়গা৷

সবক্ষেত্রে নানান সামাজিক ভদ্রতার সীমা মানতে গিয়ে মানুষ প্রতিবাদ করে না৷ সবার অত সাহসও নেই৷ আবার কখনও কখনও জমতে জমতে এমন পাহাড় হয়ে যায় যে ওরা আর বহন করতে পারে না একসময়৷ মানসিক বৈকল্যের ঘটনা ঘটে৷ এমনকি ঘটে আত্মবিধ্বংসী আরও বড় অঘটনও৷

অনেকের আবার শিক্ষা হয় অদ্ভুতভাবে৷ আমাদের আশির দশকেরই আরেকটি গল্প৷ দুষ্টু ও দুরন্ত প্রকৃতির এক ছেলে সবাইকে ক্ষেপিয়ে বেড়াত৷ মনে হত, জগতের যাবতীয় অসঙ্গতি দেখার এবং দূর করার দায়িত্ব তার উপরই বর্তেছে৷ কেউ লম্বায় একটু কম হলে ওকে নিয়ে মেতে উঠত৷ তার জন্মের সময় কেউ ওর মাথায় থাবড়া মেরে দিয়েছিল সে আর লম্বা হতে পারছে না৷ কারো চুল কম থাকলে সে কিপ্টা প্রকৃতির বলে নাপিতের খরচ বাঁচিয়ে দিতে প্রকৃতি এই ব্যবস্থা করেছে এমন তত্ত্ব৷ আমাদের এক কঠোর ধরনের স্যার ছিলেন৷ তার মাথায় টাক পড়ে গেল৷ সে আবিস্কার করল, ছেলেদের খেলতে দেন না বলে নিজের মাথা স্টেডিয়াম হয়ে গেছে৷ এখানে খেলা হবে৷ মেয়েদের বিষয়ে আরও নিষ্ঠুর সব পর্যবেক্ষণ ছিল, যার বেশিরভাগই বলার মতো নয়৷ একদিন সে চুপ৷ সড়ক দুর্ঘটনায় পড়ে নিজের পরিবারের এক সদস্যকে খুড়িয়ে হাঁটতে হচ্ছে৷ ওর ভয়, এখন তাকে নিয়ে সবাই মজা নিতে পারে৷ সেদিন বুঝলাম, নিজের উপর আসলে তখনই মানুষ আসলে অন্যের কষ্টটা বুঝতে পারে৷ এবং সেখান থেকেই মনে হয়, সমাধান ওটাই৷ আক্রান্তের জায়গায় নিজেকে বসানো৷ সত্যি বললে, এই একটা কাজ করলে জগতের অনেক সমস্যারই সমাধান হয়ে যায়৷ অন্যের কষ্ট তখনই আমাদের কাছে কষ্টের যখন বুঝতে পারি নিজে এই অসুবিধায় পড়লে কী কষ্ট হত৷ কিন্তু কষ্ট দিয়ে কষ্ট বোঝার প্রক্রিয়া কারো জন্যই সুখের নয়৷ তাই পরিবারে-সমাজে সহমর্মিতার বোধ তৈরিই সবচেয়ে জরুরি৷

সাংবাদিক মোস্তফা মামুন
সাংবাদিক মোস্তফা মামুনছবি: MIRFARID

সমাজ সময়ে এগিয়েছে৷ চিন্তার গভীরতা বেড়েছে৷ ধীরে ধীরে একসময় তুচ্ছ মনে করা এসব জিনিসও ধতর্ব্যরে মধ্যে এসেছে৷ তাই মনে হচ্ছিল বডি শেমিং এর মতো ব্যাপারগুলো আস্তে আস্তে দূর হয়ে গেছে৷ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম আসার পর জানলাম, মোটেও দূর হয়নি৷ চক্ষুল্জ্জা-প্রতিবাদের ভীতি এসব কারণে একটু চাপা পড়েছে মাত্র৷ ফেসবুকের সুবিধা এই যে মানুষকে দেখা যায় না বলে চক্ষুলজ্জার বিষয়টা নেই৷ আর অচেনা মানুষদের প্রতি নিষ্ঠুরতারও শেষ নেই৷ এখানে শেমিং যে কতভাবে চলে! তুচ্ছ একটা অসঙ্গতি নিয়ে মেতে উঠি, সৃষ্টিশীলতার নানান ডানা ছড়িয়ে কার্টুন-কবিতা-ছবিতে সেটাকে দেয়া হয় নানান মাত্রা৷ এসবের মধ্যে মচমচে আনন্দের একটা ব্যাপার থাকে৷ আক্রান্তের দগদগে দুঃখটা আর ঠিক দেখি না এই ঝলকানিতে৷ রসিকতা আর তুচ্ছতার মধ্যে যে সূক্ষ ভেদরেখা আছে সেটা দেখার চোখই নেই এই রঙিন চশমার সমাজের৷

প্রথমবার যখন ইউরোপে যাই তখন এমন আনন্দ হয়েছিল৷ চকলেট-বিয়ার এসবের কারণে প্রচুর স্থুলকায় মানুষ৷ আবার আফ্রিকা থেকে আসা মানুষদের রং এবং শারীরিক নানান বৈচিত্র্য৷ মেয়েরা দিব্যি সংক্ষিপ্ত পোশাক পরে ঘুরছে৷ কেউ এসব নিয়ে গা করছে না৷ তুলনা করে মনটা একটু খারাপ হল৷ ঢাকা শহরে সামান্য একটু অন্যরকম কাউকে দেখল্ইে কত কথা৷ মেয়েদের অন্যরকম সাজসজ্জায় দেখলেই শিস-টিপ্পনি৷ আরও প্রত্যন্ত অঞ্চলে গেলে আরও ভয়াবহ দৃশ্য৷ অস্কারের অনুষ্ঠান দেখাল পশ্চিমা সভ্যতায়ও বডি শেমিং কী কেমন কুশ্রীভাবে সচল!

স্কিপ নেক্সট সেকশন এই বিষয়ে আরো তথ্য